ফাদার সাগর কোড়াইয়া
“এই মুখ খুলে জোরে বল্…ক, খ- অ, আ”। স্কুলের গেটের বাহির থেকে এই শিক্ষা পদ্ধতি স্পষ্ট শোনা যেতো তাঁর মুখে। হাতে শাস্তির উৎকৃষ্ট উপকরণ নিয়ে শ্রেণীকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে মনোযোগের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীরা ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতো- এই ভেবে যে, এই বুঝি উৎকৃষ্ট উপকরণের উত্তম ব্যবহার আমার পিঠের উপরই পতিত হলো। ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। উদ্দেশ্য একটাই- ছাত্র-ছাত্রীদের সুষ্ঠ জীবন গঠন। স্কুলে কখনো অর্থাভাবে বসে থাকতে যাকে কেউ কখনো দেখেনি বরং প্রতিটি মূহুর্ত কোন না কোন কাজে যাকে সবাই ব্যস্ত থাকতে দেখেছে তিনি হচ্ছেন সাবিনা দিদিমনি। আমাদের সবার দিদিমনি হয়ে দীর্ঘ একটি সময় বোর্ণী সেন্ট মেরীস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। জোনাইল এলাকা বা আশেপাশের অন্যান্য এলাকার যারা বা যাদের আত্মীয়-স্বজন মিশন স্কুলে পড়াশুনা করেছে সবাই দিদিমনিকে সাবিনা দিদিমনি নামেই চিনে। কয়েকটি প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার কাজে দিদিমনি তাঁর এই নিবেদিত প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। জীবনের একটি দীর্ঘ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবিক গঠনদানের জন্য নিজের জীবন নিবেদন করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছেন।
সাবিনা দিদিমনির পার্থিব জীবনের সূচনা পর্বের পূর্বের ইতিহাসই দিদিমনির পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে একটি প্রচ্ছন্ন রূপ তৈরী করে দেয়। বোর্ণী ধর্মপল্লীর ইতিহাসের সূচনাতে ঢাকার ভাওয়াল এলাকা থেকে যারা বোর্ণী এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে তাদের মধ্যে বড় বাড়ির নাম প্রথম সারিতে আসে। ভাওয়াল থেকে আসার সময়ে এই গোষ্ঠীর বড় একটি সংখ্যা একসাথে এসেছিলেন বিধায় এই বাড়িকে বড়বাড়ি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আর সাবিনা দিদিমনির জন্ম এই বড়বাড়িতে। তাই বলা যায় সাবিনা দিদিমনি বড়বাড়ির মেয়ে। দিদিমনির জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে চামটা গ্রামে। পিতার নাম ইম্মানুয়েল রোজারিও ও মাতার নাম মাগদালেনা গমেজ। দিদিমনির দাদুর নাম দাগু রোজারিও; যিনি তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে বোর্ণীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সাবিনা দিদিমনির পিতা পাগলা মাষ্টার নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে চামটা গ্রামে যে স্কুল চালু ছিলো সেখানে মানুয়েল রোজারিও (পাগলা মাষ্টার) শিক্ষকতা করতেন। ধারণা করা হয় যে, তিনিই বোর্ণী ধর্মপল্লীর ইতিহাসে প্রথম শিক্ষক। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি প্রতিদিন এবং রবিবারের প্রার্থনা অনুষ্ঠানও পরিচালনা করতেন।
সাবিনা দিদিমনির বয়স যখন ৯ বা ১০ বছর তখন তিনি দিনাজপুরের বড়মিশন বা কস্বাতে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে যান। যেহেতু নিজ এলাকা ছেড়ে বহুদূরে তিনি পড়াশুনা করতে যান তাই মনোযোগের সাথেই পড়াশুনা করতে থাকেন। সাবিনা দিদিমনির একটাই লক্ষ্য ছিলো পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকুরী করা। সেই সময় অষ্টম শ্রেণী পাস করে সাবিনা দিদিমনি, পরশী দিদি (পারবোর্ণী) এবং বোর্ণী গ্রামের সি. ফিরমিনা (তখনো পর্যন্ত সিস্টার হননি) পিটিআই (তৎকালে পিটিআইকে গুরুট্রেনিং নামেও ডাকা হতো) সমাপ্ত করেন এবং বোর্ডিং-এ অবস্থান করে শিক্ষকতা করতেন। এই সময় পরশি দিদির কিডনীর সমস্যা দেখা দিলে তিনি ময়মনসিংহে চলে যান এবং পরবর্তীতে সেখানে পড়াশুনা চালিয়ে যান আর সি. ফিরমিনা সিস্টার হবার মানসে সিস্টার সম্প্রদায়ে যোগ দেন।
সাবিনা দিদিমনি চাটমোহর রেলস্টেশন থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ট্রেনে টিকিট চেকারের চাকুরী পেয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রায় ৩ মাস চাকুরীও করেন। দিদিমনির জোনাইল স্কুলেও সরকারী চাকুরী হয়েছিলো। অল্প সময় সেখানে তিনি শিক্ষকতাও করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় বোর্ণী ধর্মপল্লীর প্রাণপুরুষ ফাদার আঞ্জেলো কান্তন ১৯৫৬/৫৭ খ্রিস্টাব্দে সাবিনা দিদিমনিকে মিশন স্কুলে এনে শিক্ষকতার চাকুরী দেন। ফাদার আঞ্জেলো কান্তনের কথা, আমাদের নিজস্ব স্কুল থাকতে সাবিনা দিদিমনি অন্য স্কুলে শিক্ষকতা করবে তা মেনে নেওয়া যায় না। সাবিনা দিদিমনি বাধ্যতার নিদর্শন দেখিয়ে ফাদার আঞ্জেলো কান্তনের কথা শুনে চলে আসেন। এরপর থেকে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ শুরু করেন; যা অবসর নেবার শেষ অবধি অব্যাহত ছিলো। ৩ জানুয়ারী ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে গাব্রিয়েল রাজু মজুমদারের সাথে সাবিনা দিদিমনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ছেলে রঞ্জিত স্যারকে (প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক) কোলে অবস্থায় ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
সাবিনা দিদিমনিকে বাহ্যিকভাবে দেখলে খুবই কঠোর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হতো। কিন্তু অদৌ আভ্যন্তরীণভাবে তিনি তেমন ছিলেন না। সবার সাথে কথা বলার সময় হাসি-খুশি থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও যে কোন কাজে সময়ানুবর্তী। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুলে সর্বত্রই দিদিমনির পরিশ্রমের বিষয়টাই বৃহৎ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ব্যক্তি জীবনে যেমন পরিশ্রমী ছিলেন তেমনি তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে শতভাগই আশা করতেন। সাবিনা দিদিমনি চাইতেন যেন ছাত্র-ছাত্রীরাও পড়াশুনার ক্ষেত্রে পরিশ্রমী হয়ে উঠে। তাই অবাধ্য, অলস, দুষ্টের শিরোমণি ও ফাঁকিবাজ ছাত্র-ছাত্রীদের উত্তম মাধ্যম দিতে তিনি কখনো ভুলতেন না। তবে যে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনায় ভালো ও নিয়মিত তাদের স্নেহ -আদর ও ভালবাসতে কখনো কার্পণ্য করতেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার প্রতি অনেক গুরুত্ব দিতেন। আর যা শিক্ষা দিতেন তা যেন নির্ভূল হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন তিনি। অভাবের একটি আঘাত সকল শিক্ষকের উপরই থাকে। সাবিনা দিদিমনিও এর বাইরে ছিলেন না। পারিবারিকভাবে দিদিমনি তেমন স্বচ্ছল ছিলেন না। তাই বলে সীমাহীন চাহিদার পিছনে তিনি কখনো ঘুরে বেড়াননি। অল্পতেই কিভাবে তুষ্ট থাকা যায় তা দিদিমনি ভালোভাবেই জানতেন। সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনার জন্য দিদিমনি টিউশনী করতেন; অনেক সময় অল্প টাকার বিনিময়ে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে গিয়েও পড়াতেন। এখনো ভাবলে অবাক লাগে- সাবিনা দিদিমনি পঞ্চাশ টাকা বেতনে প্রথম শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে সর্বোচ্চ দু’হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতেন। অনেকেই সে সময়ে এই স্বল্প পরিমাণ বেতনে শিক্ষকতা করতে চাইতেন না কিন্তু দিদিমনি ঠিকই এই মহান পেশাকে ভালবেসে বিশ্বস্ততার সাথে সম্পন্ন করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সুদেব সরকার সাবিনা দিদিমনিকে স্কুলের ‘মূলভিত্তি’র সাথে তুলনা করেন।
আমরা যারা সাবিনা দিদিমনির শিক্ষা লাভ করেছি তারা দিদিমনির শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে খুবই ভালোভাবে অবহিত। প্রায়শ্চিত্তকালের শুক্রবারগুলোতে স্কুল থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গীর্জায় যেতাম ক্রুশের পথে অংশগ্রহণ করার জন্য। দিদিমনির ভয়ে আমরা কখনো লাইন ভাঙ্গতাম না। এছাড়াও দুষ্টামী করলে দিদিমনির কানমলা খাবার ভয়ে গীর্জায় অত্যন্ত ভক্তিভরে ক্রুশের পথ করতাম। দিদিমনি নিয়মিত গীর্জা-প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেবার পরও প্রতি রবিবার দিদিমনিকে খ্রীষ্টযাগে দেখা যেতো। ধর্মপল্লীর প্রশাসনের প্রতি তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ সাবিনা দিদিমনি শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নেবার পর সময় কাঁটতে চাইতো না বিধায় তিনি আবারো স্কুলে ফিরে যাবার বাসনা করতেন। প্রায় ২/৩ বছর বাড়িতে থেকেই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশনী পড়ান।
মিশন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক রঞ্জিত মজুমদার (সাবিনা দিদিমনির সন্তান) দিদিমনির সমন্ধে বলেন, দিদিমনি সব সময় আমাকে বলেন যেন কারো সাথে কখনো মুখ কালো করে কথা না বলি। ছাত্র-ছাত্রীদের সব সময় সন্তানের মতো যেন দেখি। নিজের সন্তান বলে তিনি কখনো পড়াশুনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছাড় দিতেন না। পড়া না পারায় আমাকেও শাস্তি দিতেন। বর্তমান এই বার্ধক্যের সময়ে দিদিমনি যেন অনেকটা শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন; স্কুল বা বাজার থেকে বাড়িতে গেলে চকোলেট এনেছি কিনা জিজ্ঞাসা করেন।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের একদিন বিকালবেলা সাবিনা দিদিমনির বাড়িতে যাই। উদ্দেশ্য দিদিমনিকে দেখা। বাড়ির একটু দূরে থাকতেই সাবিনা দিদিমনির কথা শুনতে পাই। কাকে যেন তিনি জোরে জোরে ডাকছেন। বাড়ির উঠানো যেতেই দিদিমনির সাথে দেখা। আশীর্বাদ নিয়ে পরিচয় দিলাম। দিদিমনি হাতে ধরে বারান্দায় চেয়ারে নিয়ে বসালেন। দিদিমনির ছেলে রঞ্জিত স্যারের স্ত্রী বের হয়ে এলেন। দিদিমনির সাথে কথা বলা শুরু করলাম। মায়াভরা, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন দিদিমনি। অতীতের কোন স্মৃতি দিদিমনি এখন আর স্মরণ করতে পারেন না। নিকট আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে মাঝে ভুলে যান। যতটুকু সময় কথা বলেছেন তা সবই অসংলগ্ন। কোন কথাই স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেন না। তিনি কয়েক মূহুুর্ত পর পরই আমাদের নাম ও বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করছিলেন। আমরাও বারে বার দিদিমনির প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। যিনি স্কুলে শিক্ষকতাকালীন আমাদের প্রশ্ন ও কথা ধৈর্য্য সহকারে শুনে এসেছেন তার কথা আমরা এই সময়ে শুনবো না তার প্রশ্নই আসে না। যতটুকু সম্ভব দিদিমনির বিষয়ে জানতে চেষ্টা করলাম। শারীরিকভাবে সাবিনা দিদিমনি দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মনের যে জোর ২৪/২৫ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন দেখেছি তা এখনো সদা বিদ্যমান। এরপর আরো ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। সাবিনা দিদিমনি বয়সের কারণে অসুস্থ্য অবস্থায় বিছানাগত। অতঃপর ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে জনসাধারণের চলাফেরায় বাধানিষেধ ছিলো তবু সাবিনা দিদিমনির অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় অনেকেই অংশগ্রহণ করেন।
দোষ-গুণ মিলিয়েই মানুষ। তাই কেউ কখনো গর্ব করে বলতে পারে না যে, তার কোন দোষ নেই। তবে যখন আমরা কোন ব্যক্তির দোষ থাকা সত্ত্বেও তা না দেখে বরং গুণগুলোকে দেখি তখন দোষগুলো আপনি সরে যায় আর গুণগুলো আরো সুন্দর হয়ে ফুটে উঠে। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীর খ্রিস্টিয় গানের বই গীতাবলীতে মানিক নাথের কথা ও সুরে একটি গান “অনেক দিয়েছ, অনেক নিয়েছি, অনেক জমেছে ঋণ”- গানটি যেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বাস্তব হয়ে উঠেছে। সাবিনা দিদিমনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই আমাদের শুধু দেবার কাজে ব্যয় করেছেন, বিনামূল্যে আমরা সে সেবা নিয়ে ঋণের বোঝা বাড়িয়ে তুলেছি; বিনিময়ে তাঁকে কিছুই দেওয়া হয়ে উঠেনি।