ফাদার সাগর কোড়াইয়া

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের জন্য বিরাট ক্ষতি! কয়েকদিনের ব্যবধানে দুইজন যাজক হারালো ধর্মপ্রদেশ। এই ক্ষতি অপূরণীয়! একমাত্র সান্ত্বনা; ঈশ্বরের ডাককে অবহেলা করা অসম্ভব। কয়েক বছরের ব্যবধানে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ হারালো ৭ জন পুরোহিতকে। ফাদার সুবাস কস্তা (ফৈলজানা) বেশ কয়েক বছর পূর্বে অসুস্থ্য অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর ফাদার জন যদু রায়ও (গুল্টা) প্রায় অকালেই চলে গেলেন। ফাদার নির্মল কস্তাও (বনপাড়া) ক্যান্সারের কাছে হলেন পরাজিত। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ফাদার আন্তন মুর্মুর (রহনপুর) মৃত্যুটা আকস্মিক; মেনে নেওয়া কষ্টের। ফাদার পৌল রোজারিও, জয়গুরুর (বোর্ণী) যদিও বয়স হয়েছিলো মোটামুটি তবুও তিনি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ্যতার কাছে পরাজিত হয়ে স্বর্গবাসী হয়েছেন। ফাদার কর্ণেলিয়াস মুর্মু (মুণ্ডমালা) ও ফাদার বিকাশ হিউবার্ট রিবেরুর অকালে প্রয়াণকে মেনে নিতে হয় তবে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে।

একজন যাজক তৈরী করতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তারপর নানাজনের প্রার্থনা, ত্যাগস্বীকার ও সহযোগিতার পূর্ণফল যাজক। ধর্মপ্রদেশের বিশপের পূর্ণসহযোগী হয়ে কাজ করে যাজক নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়। বিশপের শক্তহাত হয়ে উঠে যাজকগণ। আর একজন যাজকের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই ধর্মপ্রদেশের বিশপের শক্তহাত আলগা হয়; শক্তি হারায়। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী ফাদার কর্ণেলিয়াস মুর্মু ও ফাদার বিকাশ রিবেরুর মৃত্যুর বয়স ছিলো না। তবুও ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হতে হলো এ দু’জন হাস্যেজ্জ্বল যাজককে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে দু’জনই পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন মৃত্যু সবার জন্য সত্য। এই দুইজন যুবক পুরোহিতের মৃত্যুতে বিশপের শক্তহাত আলগা হয়েছে নিঃসন্দেহে। আমার সেমিনারী জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই এই দু’জন যাজকের সান্নিধ্য পেয়েছি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি- এই দুইজন যাজকই ছিলেন প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বসিত এবং মিশুকে। দুইজনের মধ্যেই সঙ্গীতের প্রতি একটা আলাদা টান ছিলো। বিশেষভাবে ফাদার কর্ণেলিয়াস মুর্মু সাঁন্তালী কৃষ্টির সঙ্গীত সঙ্গীতযন্ত্র বাজানোতে দক্ষ ছিলেন। আর ফাদার বিকাশ রিবেরুরও বাংলা সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ছিলো। মনে পড়ে একবার বোর্ণীতে- কোন এক অনুষ্ঠানে ফাদার বিকাশকে গান পরিবেশনের অনুরোধ জানালে তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে নজরুল সঙ্গীত গেয়েছিলেন, “খেলিছ এই বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে”।

২০০০ খ্রিস্টাব্দে ফাদার বিকাশ রিবেরুর যাজকীয় অভিষেকের সময় আমি হাইস্কুলে পড়ি। ঐ দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে। ফাদার বিকাশকে আত্মিয়-স্বজনবেষ্টিত করে ধর্মপল্লীতে নিয়ে আসা হয়। সেই প্রথম আমি ফাদার বিকাশকে দেখি। ফাদার বিকাশের দৈহিক উচ্চতা ও শারীরিক অবয়োব অন্য রকম একটি ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে। মুখে সার্বক্ষণিক হাসি লেগেই ছিলো। অনেকের মাঝে দাঁড়ালে ফাদার বিকাশকে আলাদা বিশেষ্যত্ব দান করা যেতো। পরবর্তীতে সেমিনারীতে যাবার পূর্বে রাজশাহী পালকীয় কেন্দ্রে “এসো, দেখে যাও” কোর্সের পরিচালক হিসাবে ফাদার বিকাশকে পাই। একমাস যাবৎ এই কোর্সের মধ্য দিয়ে ফাদার বিকাশকে আরো ভালোভাবে অভিজ্ঞতা করার সুযোগ হয়েছিলো। শুনেছিলাম ফাদার বিকাশ একজন তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন। বনানী সেমিনারীতে পড়াশুনাকালীন তার রেজাল্ট নাকি ছিলো আকর্ষণীয়। সত্যি- আমাদের “এসো, দেখে যাও” কোর্সে ইংরেজী খ্রিস্টযাগে বাংলা বলার মতো তার ইংরেজী বলা মুগ্ধ করেছিলো; যদিওবা অনেক কিছুই তখন বুঝতাম না। পরবর্তীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়, পাবনা থেকে মাস্টার্সে ফ্রার্স্ট ক্লাস ফ্রার্স্ট রেজাল্ট করা তার সে মেধাকেই প্রকাশ করে। কোর্সে থাকাকালীন প্রায় প্রতিদিন রাতের প্রার্থনার পর ফাদার বিকাশের সাথে খাবার ঘরে বসে গল্প করতাম সবাই। সে সময় তার মধ্যে পরিচালকত্ব মনোভাব কখনো ফুটে উঠেছে দেখিনি। বরং একজন বড় ভাই ও বন্ধুর মতোই আচরণ করতেন। সে বয়সেই ফাদার বিকাশের এই গুণ আমাদের মুগ্ধ করেছিলো। ফাদার বিকাশের সাথে এ রকম আরো বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।

রমনা সেমিনারীতে ফাদার কর্ণেলিয়াস মুর্মু এক বছর আমাদের সহকারী পরিচালক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাহিরে পড়াশুনা করতেন। ফাদার কর্ণেলিয়াস তখন যুবক। আমরা রমনা সেমিনারীর ছাত্র। সেমিনারীয়ানদের সাথে তার ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সেমিনারীয়ানদের সাথে তাকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। একবার ফাদার কর্ণেলিয়াসকে কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করার সময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিলাম! কোনভাবেই বুঝতে পারছিলাম না যে কিভাবে একজন এত দ্রুত বাংলা টাইপ করতে পারে। খেলাধুলার প্রতি ফাদার কর্ণেলিয়াসের ছিলো অদ্যম আগ্রহ। ফুটবল বা অন্যান্য টুর্নামেন্ট হলে তিনি নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারতেন না। মনে পড়ে রমনা সেমিনারীতে ফাদার কর্ণেলিয়াস বুট পায়ে বল নিয়ে আগেই মাঠে নেমে পড়তেন। আমাদের মাঠে নামতে দেরী হলে তিনি শুরু করতেন ডাকাডাকি। একাকী মাঠে ফুটবল নিয়ে কসরত শুরু করে দিতেন।
যাজকীয় অভিষেকের পর ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশের সান্নিধ্যে এসে তাদেরকে অভিজ্ঞতা করার আরো বেশী সুযোগ হয়েছে। ফাদার কর্ণেলিয়াসের মধ্যে একটা শুদ্ধ সরলতা ছিলো। আমাকে ‘তুই’ ‘তুমি’ দুটো বলেই সন্মোধন করতেন। দেখা হলেই মহিপাড়াতে বেড়াতে আসতে বলতেন কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি। ফাদার বিকাশের মধ্যে অন্যের প্রশংসা করার গুণ ছিলো অসাধারণ। মাঝে মাঝে প্রশংসা করাটা অতিরিক্ত হতো জানি তবু কতজনইবা সেটা পারে! সচারাচর মানুষ যে স্কেলে কথা বলে ফাদার বিকাশ সে স্কেলের আরো এক বা দুইধাপ উপরের স্কেলে কথা বলতেন। আর সেটাই ফাদার বিকাশকে অনন্যতা দান করেছে। আমার যাজকীয় অভিষেকের দিন সংবর্ধনার পর তিনি আমার কাছে এলেন। মুখে একঝাঁক হাসি ছড়িয়ে বললেন, ভাই আমি যে কি খুশি হয়েছি! ফাদার বিকাশের এই যে ভাই ও দাদা বলে সন্মোধন তা যে কাউকে আপন করে কাছে টেনে নেবার জন্যে যথেষ্ট।
জুলাই মাসে ঢাকায় যাই। ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশ বনানী সেমিনারীতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। দু’জনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। গল্প হয় দীর্ঘ সময়। দু’জনকেই দিব্যি সুস্থ্য-প্রাণবন্ত দেখেছি। উত্তরার কোন এক হাসপাতালে তখন থেরাপি নিচ্ছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন। তাদের দু’জনের মধ্যেই দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। আর সত্যিই তো সুস্থ্যও হচ্ছিলেন। ফিরে আসার সময় একত্রে দু’জনের সাথে শেষ দেখা। এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে উঠবো। বনানী সেমিনারীর সামনে সিএনজির অপেক্ষায় আছি। একটি সিএনজি এসে সেমিনারীর গেটে দাঁড়ালো। দেখি- ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশ নেমে আসছেন। আমাকে দেখে ফাদার বিকাশ বললেন, চলে যাচ্ছ বুঝি! হ্যাঁ- বলতেই তাদের নিয়ে আসা সিএনজিটিই ঠিক করে দিলেন। চালক বেশী ভাড়া চাচ্ছিলো বিধায় ফাদার বিকাশ সিএনজি চালককে বললো, ভাই আমাদেরই লোক; বেশী ভাড়া চাচ্ছেন কেন! ফাদার বিকাশের কথা শুনে সিএনজি চালক ন্যায্য ভাড়ায় নিয়ে যেতে রাজি হলো। সিএনজিতে উঠে বসি। ফাদার বিকাশ সিএনজির কাছে এসে নীচু স্বরে বললো, ভাই ভালোভাবে যেয়ো। আপনারাও ভালো থাকবেন- বলে চলে আসি। সেই দু’জনকে শেষ একসাথে দেখা।

ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশের মানসিক দৃঢ়তা দেখে প্রত্যাশা ছিলো সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হলো। বিশপ হাউজে ফাদারদের একসাথে প্রেজবিটেরিউম, খ্রিস্টযাগ, প্রার্থনা, খাওয়া-দাওয়ায় ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশের সরব উপস্থিতি আজ শুধুই স্মৃতি। ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশ বনানী সেমিনারীতে অবস্থান করে একসাথে যেমন চিকিৎসা নিয়েছেন তেমনি আজ স্বর্গে ঈশ্বরের গৃহে একই সাথে আছেন। দু’জনকে শেষ একসাথে দেখার দিন ফাদার বিকাশ যেভাবে বলেছিলেন, ভাই ভালোভাবে যেয়ো; ঠিক একইভাবে বলতে ইচ্ছে করছে, ভাই ফাদার কর্ণেলিয়াস ও ফাদার বিকাশ ওপারে আপনারা ভালো থাকবেন।

Please follow and like us: