ফাদার সুনীল রোজারিও। বিশপ ভবন, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।

ভূমিকা : ভালোবাসায় আনন্দ/ ভালোবাসার আনন্দ, (Amoris Laetitia- The Joy of Love) প্রৈরিতিক প্রেরণা পত্রটিকে বলা যেতে পারে চার্চের পালকীয় জীবনে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের এক ঐতিহাসিক পূর্বাভাস। এই দলিলটি গত ২০১৪ এবং ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে “বিবাহ এবং পরিবার” নিয়ে অনুষ্ঠিত দু’টি বিশপীয় সিনোদের পূর্ণ ফলাফল বলা যেতে পারে। ভালোবাসায় আনন্দ দলিলটি চার্চের অন্যান্য দলিল, সর্বজনীন পত্র, পালকীয় পত্র এবং প্রৈরিতিক পত্র থেকে দু’টি কারণে আলাদা করে রাখা যায়, আর তা হলো- প্রৈরিতিক প্রেরণাদায়ী এই পত্রটি প্রথমতঃ প্রতিটি খ্রিস্টীয় পরিবারের জন্য পাঠ্য দলিল এবং দ্বিতীয়তঃ যারা পরিবার নিয়ে পালকীয় কাজ করেন তাদের জন্য হ্যান্ডবুক। ভালোবাসায় আনন্দ প্রৈরিতিক প্রেরণা পত্রটিতে রয়েছে মোট নয়টি অধ্যায়।

১. বিশ্বের আলো-সরূপ : প্রথমেই বলা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর কথা- তাদের মধ্যেকার ভালোবাসা যেনো হয়ে ওঠে আলো-সরূপ। প্রকৃত ভালোবাসা হলো ঈশ্বরের জীবন্ত প্রতীক, ঈশ্বরের প্রাণের প্রতীক- এবং অর্থবহ ভালোবাসা ঈশ্বরের ইচ্ছার যে পরিকল্পনা সেটাই প্রকাশ করে। “পরমেশ্বর তাদের আর্শীবাদ করলেন; পরমেশ্বর তাদের বললেন, ফলবান হও, বংশবৃদ্ধি কর, পৃথিবী ভরিয়ে তোল, তা বশীভূত কর। সমুদ্রের মাছের উপরে, আকাশের পাখিদের উপরে ও ভূমির যত সরিসৃপের উপরে প্রভুত্ব কর (আদি ১:২৮)।” সাম-সংগীতে অন্তপুরে নারী সম্পর্কে বলেছে, “তোমার গৃহের অন্তঃপুরে তোমার গৃহিনী হবে ফলশালী যেন দ্রাক্ষালতা (১২৮:৩)।” পরিবারকে বিশ্বের আলো-সরূপ হতে হলে নাজারেথের পবিত্র পরিবারের আদর্শ আমাদের পরিবারকে দেখতে হয়। তাহলে পরিবারের সন্তানরাও হয়ে ওঠবে জলপাই বৃক্ষের লতাঙ্কুরের মতো। পরিবার যেমন সুখের তেমনি কষ্টের যাত্রাপথ। পরিবারে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়- অন্যের প্রতিও তাদের থাকতে হবে ভালোবাসা (মথি ২২:৩৯)।

২. পরিবারে অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ : আধুনিক পরিবারে বহু রকমের বাস্তবতা রয়েছে। দ্রুত অগ্রসরমান সংস্কৃতি ও বিবর্তনবাদের কারণে পরিবারের ধারণায় যে অ-অনুমোদিত পরিবর্তন আসছে- তা পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন। আধুনিক সমাজে আজকের অনৈতিক ধারণার কারণে একদিকে যেমন ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে পরিবারের মৌলিক আকর্ষণ হারাতে বসেছে। পরিবারের ভালোবাসা এমন জিনিস নয় যা বাজার থেকে ক্রয় করা- কিছুদিন ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। পরিবারে চ্যালেঞ্জগুলো কি ? সন্তানদের নিয়ে, পিতামাতা ক্লান্ত- কথা বলার সময় নেই, একসঙ্গে আহার না করা না বসা, গণমাধ্যমে নেশা, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সন্তানদের ভবিষ্যত। এছাড়াও রয়েছে বিবাহ বর্হিভূত একসঙ্গে বসবাস, সিভিল ম্যারেজ, নানা রকমের বিবাহ, স্বাধীন মতো বিবাহ, ইত্যাদি।

৩. যিশুকে দেখো- পরিবারের আহ্বান : পরিবার সবচেয়ে স্পস্টভাবে দৃশ্যমান। বিবাহ হলো, “ঈশ্বরের একটি দান (১করি ৭:৭)।” ১তিমথী ৪:৩-৪ বলে, “পরমেশ্বর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা তো ভালোই।” এটাও লেখা আছে, “ঈশ্বর যাহা যুক্ত করেছেন মানুষ যেনো বিচ্ছিন্ন না করে (মথি ১৯:৬)।” চার্চের বিভিন্ন দলিলপত্রে বিবাহ সম্পর্কে নানা উপদেশ, কথা বলা হয়েছে। ভাটিকান দলিলে বলা হয়েছে, বিবাহ হলো জীবনের সমাজ, ভালোবাসার সমাজ। বিবাহ সাক্রামেন্ত কি বলে; ১. ঐশ পরিবার ২. পবিত্র পরিবার ৩. আদর্শ পরিবার। বিবাহ হলো ঈশ্বরের একটি আহ্বান। বাণী হলো বীজ এবং যা অপ্রস্তুত অবস্থা থাকে। আদর্শ পরিবার গড়ে তোলার পিছনে ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারে জীবন পরিবৃদ্ধি লাভ করে এবং সেখানে লালিত ভালোবাসার মধ্যদিয়ে সন্তানগণ পরিচালিত হয়। পরিবার নিয়েই সমাজ এবং সমাজ নিয়েই মন্ডলি।

৪. বিবাহিত জীবনে ভালোবাসা : ১করি ১৩:২-৩, “…আমি যদি আমার সমস্ত কিছুই দীন-দরিদ্রের মধ্যে বিলিয়ে দিই, এমন কি আমার নিজের দেহ-ও আগুনে সঁপে দিই, অথচ আমার অন্তরে যদি না থাকে ভালোবাসা, তাহলে তাতে আমার কোনো লাভ নাই।” আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভালোবাসা (১করি ১৩:৪-৭)। ভালোবাসা সর্বদা অন্যকে সেবা দিতে প্রস্তুত। ভালোবাসা আগ্রাসী বা অহংকারী নয়। ভালোবাসা দাম্ভিক নয়। ভালোবাসা রুক্ষ নয়। ভালোবাসা হলো দয়াশীল- প্রথমতঃ নিজেদের মধ্যে এবং পরে অন্যের প্রতি। প্রকৃত ভালোবাসা অন্যকে বিরক্ত করে না। ভালোবাসা ক্ষমাশীল। ভালোবাসা সবকিছু বিশ্বাস করে। ভালোবাসা সবকিছু আশা করে। ভালোবাসা সব সময় নীতিবাচক। ভালোবাসা স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সারা জীবনব্যাপী, আনন্দ এবং সুন্দর, ভালোবাসাকে শুভভাবে ধারণ, ভালোবাসা প্রকাশ এবং বৃদ্ধিলাভ, পরিবারে সংলাপ, সহনশীলতা, অনুরাগ। সন্তানগণ হলো ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রকাশ। পরিবারের কাজগুলোকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করা যায়।

৫. ভালোবাসা ফলপ্রসু করে তোলে : পরিবার নতুন জীবনকে অভিনন্দন জানায়। ভালোবাসা ও গর্ভধারণ, পিতা-মাতার মধ্যে ভালোবাসার জীবনস্বরূপ। পরিবারে এই ফলপ্রসুতা বৃদ্ধিকরণ সম্ভব- যেমন প্রয়োজনবোধে বা মানবিক কারণে দত্তক নেওয়া। এরূপ নানাভাবে মন্ডলিতে একদেহ হয়ে উঠা যায়- যেমন, ধনী দরিদ্রের পার্থক্য না থাকা। পত্রে যৌথ পরিবারের বাস্তবতাকে একটি বৃহত্তর হৃদয়ের মতো। ছেলে-মেয়ে হিসেবে; প্রবীণ হিসেবে, ভাই-বোন হিসেবে যৌথ পরিবার হলো বৃহত্তর হৃদয়। যৌথ পরিবারে, পরিবারের মূল্যবোধগুলো অনেক স্পষ্ট।

৬. পালকীয় দৃষ্টিভঙ্গি : খ্রিস্টীয় পরিবার হিসেবে মঙ্গলবাণীর মূল্যবোধ প্রচার করা একটা আহ্বান। পরিবারের পালকীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অন্যতম- বিবাহের জন্য দম্পত্তিকে প্রস্তুত করে তোলা, পরিবারের মধ্যে চলমান উৎসব ধরে রাখা, বিবাহিত জীবনের প্রথম বছরের আনন্দ ধরে রাখা এবং ধীরে ধীরে বিবাহিত জীবন সর্ম্পকে আরো অবগত হওয়া। এছাড়াও সংকটকালে, দুঃখ এবং কঠিন সময়ে আলো ছড়ানো- সংকট মোকাবেলা করা পরিবারের পালকীয় কাজ। পরিবারে পুরাণো ক্ষত পর্যালোচনা করে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। কোনো কারণে পরিবার আলাদা হয়ে গেলেও সান্নিধ্য দেওয়া একটি পালকীয় কাজ। কিছু জটিল অবস্থাও থাকতে পারে- যেমন, মনে রাখতে হবে, মিশ্র বিবাহ হলেও তারা দীক্ষাপ্রাপ্ত। অন্যদিকে প্রিয়জনের মৃত্যুতে ভেঙ্গে না পড়ে সবার জন্য উঠে দাঁড়ানো একটি অন্যতম পালকীয় কাজ।

৭. সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা : পরিবার হলো প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত জায়গা। পারিবারিক জীবন হলো সমস্ত শিক্ষার ব্যবস্থাপত্র। এখানেই শিখতে পারে মানবিক শিক্ষা। আবার যদি পরিবারে শিক্ষার অপব্যবহার হয়- তবে পরিণতির বীজ বোনা হয়ে যায়। পরিবারে যৌন জীবন শিক্ষার গুরুত্বও অপরিসীম। সন্তানদের বয়সের পাশাপাশি যৌন জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া সব শিক্ষার মধ্যে একটি অংশ। পরিবারে পিতা-মাতাদের বিশ্বাসের মধ্যদিয়ে জীবন অতিবাহিত করা সন্তানদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা। পিতা-মাতা যেমন, সন্তান হবে তেমন।

৮. ভালো মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা : পরিবারে পালকীয় সেবা অব্যাহত রাখা একটা স্থায়ী আহ্বান। সেই সাথে অবাস্তব/ অনিয়মিত অবস্থার প্রতি দৃষ্টিদান গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে পালকীয় দৃষ্টিভঙ্গি সজাগ রাখা- যা বাইবেলের পরিপন্থী নয়। প্রয়োজনে বিধানে পরিমার্জন করা যেতে পারে তবে মূল বিধান ভঙ্গ করে নয়। যুক্তি-তর্ক দিয়ে পালকীয় সেবা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

৯. বিবাহিত জীবনে আধ্যাত্মিকতা এবং পরিবার : পরিবারের আহ্বান হলো- ঈশ্বরের অনুগ্রহ নিয়ে, পবিত্র আত্মার শক্তিতে দিনে দিনে বেড়ে উঠা। প্রতিনিয়ত আনন্দময় পরিবেশ বহন করা। বিবাহিত জীবনে ঈশ্বরের স্তুতিগান করা পরিবারের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, মানুষের ভালোবাসার মধ্যে ঈশ্বর গভীরভাবে বিরাজিত। পুনরুত্থানের শিক্ষা হলো পরিবারের জন্য শিক্ষাঃ- খ্রিস্ট নিজের কষ্ট দিয়ে সবার জীবন দিয়েছেন। পরিবারে আধ্যাত্মিকতা হলো মুক্ত ভালোবাসা। সেবার আধ্যাত্মিকতা হলো- অন্যের প্রতিও তাই করা (মার্ক ১০:৫১)। পরিবারের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে- তবে প্রচেষ্টা থাকতে হবে সীমাবদ্ধতাগুলোকে ধ্বংসকারি হিসেবে না দেখে সেখান থেকে ভবিষ্যতে আধ্যাত্মিক শিক্ষা নেওয়া ।

উপসংহার: পরিবার হলো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। পরিবার আনন্দ বেদনার মধ্যদিয়েই এগিয়ে চলে এবং বেঁচে থাকে। সব সময় প্রচেষ্টা থাকতে হবে- পরিবারে যেন প্রাণ থাকে- শুকিয়ে না যায়। সবার সম্মিলিত ভালোবাসা থাকলে পরিবার হয় সুখের- অন্যথায় দুঃখের। দুঃখের পরিবার মরণের চেয়েও কষ্টের। মনে রাখতে হবে, ঈশ্বরই হলেন পরিবারের সৃষ্টিকর্তা।

 

Please follow and like us: