জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

সতীদাহ-সীতাদাহ শব্দ দুটি নারীকেন্দ্রিক। আবার গাত্রদাহ-গৃহদাহ শ্রেণীভেদে নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই বিদ্যমান। চারটি শব্দই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নেতিবাচককেই উসকানি দেয়। কোনটিই শুভ কিছু সৃষ্টি করে না। বরং ভাঙ্গনের জন্ম দেয়। একে অপরের প্রতি গাত্রদাহের কারণেই সতীদাহ-সীতাদাহ আর এই তিনটির কারণেই গৃহদাহ জ্বলে ওঠে। কোন পানিতেই নেভানো সম্ভব হয়ে ওঠে না তখন। সতীদাহ-সীতাদাহের ক্রিয়াকাল এখন আর নেই। এই দুইটি প্রচলিত রীতি-নীতি নারীকে শুধু বঞ্চনাই যুগিয়েছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে আগুনে পুড়িয়ে নারীর খাঁটিত্ব বের করার কুপমণ্ডক ধারণার একতরফারই বহির্প্রকাশই ছিলো। এখন আর সতীদাহ-সীতাদাহ নেই তবে শব্দ দুটি বেশ প্রচলিত। মুখে মুখে ব্যবহৃতও হয়। অর্থ কমবেশী সবাই জানি। তবু খোলসা করলে ভালো বৈ মন্দ না। সতীদাহ প্রথা ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা। মূলত স্বপ্রণোদিত হয়েই স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী আগুনে আত্মহুতি দিতো। গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৪০০ খ্রিস্টাব্দ) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন ছিলো বলে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়। পৌরাণিক কাহিনীতে সতীদাহকে অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। মহাকাব্য মহাভারত অনুসারে পান্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী। কারণ পান্ডুকে যৌন্যসহবাসের জন্য মৃত্যুদন্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিলো। আবার প্রাচীন রাজপুতানায় হিন্দু নারীদের জন্য একটি কঠিন ব্রত ‘জহর’ প্রচলিত ছিলো। কোন নগরী শক্রপক্ষ দ্বারা দখল হওয়ার পূর্বেই নগরীর নারীরা আত্মসন্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ, বিষ বা জহর পান করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতো। আদি সেই ভয়ঙ্কর প্রথাটি এক সময় সমগ্র ভারতবর্ষে মহামারী রূপ নেয়। পরবর্তীতে ইংরেজ আমলেও সতীদাহ প্রথা চালু ছিলো। বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতীদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এই আইনী কার্যক্রম গৃহীত হয়েছিলো রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের জন্যেই। তিনি প্রমাণ ও প্রচার করেন যে, এই প্রথা কেবল অমানবিকই নয় অপরন্তু অশাস্ত্রীয় ও আইনবিরুদ্ধ। খুব সহজেই যে রাজা রামমোহন এই নিষ্ঠুর প্রথা দূর করতে পেরেছিলেন তা নয়; বরং এর মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন। ধর্মের কুসংস্কারপূর্ণ শক্ত আবরণে সংস্কার নামক হাতুড়ির আঘাত হেনেছেন সজোরে।

অন্যদিকে সতীদাহের মতো সীতাদাহও রামায়ন মহাকাব্যে স্থান দখল করে আছে। সীতাদাহে খাঁটিত্ব পরীক্ষায় সীতাই ছিলেন ভুক্তভোগী। সীতার জন্ম নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে; সেদিকে নাইবা গেলাম। ঘটনার ঘনঘটায় রাজাধিপতি রামের সাথে সীতার বিয়ে হয়। রাম-সীতার ভালবাসা রামায়ন মহাকাব্যে এক অন্যরূপ নেয়। সীতা সব সময় রামের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে থেকেছেন। তাই রামের বনবাসে সীতাকে সহচরণী হিসাবে দেখা যায়। পরবর্তী ঘটনায় সীতাদাহ রামায়ন মহাকাব্যে সীতার প্রতি জনশ্রুতি ও স্বামীর অবিশ্বাসের বলিক্রিয়া। মহাকাব্যের অধিপতি রাম সীতাকে সঙ্গে নিয়ে বনবাস থেকে ফিরে এলে জনমহলে সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কারণ সীতা রাবণের কাছে বন্দি অবস্থায় ছিলো। অবশেষে সীতাকে তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে আগুনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। যে রাম সীতাকে এত ভালবাসতো সেই রামও সীতার অগ্নি পরীক্ষা নেবার জন্য উদগ্রীব।
যুগে যুগে কালে কালে সতীদাহ ও সীতাদাহ নারীর বঞ্চনাকে তুলে ধরেছে। সতীদাহ কোনকালে হিন্দু সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনেনি। বরং সতীদাহ প্রথার কারণে গুটিকতক স্বার্থান্বেষী স্বার্থ চরিতার্থ করেছে মাত্র। বিশেষ করে মৃত কোন ধনী লোকের সম্পত্তি অধিকারের লোভে আত্মীয়রা সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা বিধবার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে স্বামীর সাথে চিতায় পুড়িয়ে মারতো। অনেকের ধারণা ও বিশ্বাস ছিলো মৃত স্বামীর সাথে নারীর এই সহমরণের কারণে আরো অনেক আত্মীয় নারী পুণ্য লাভ করবে। এটা যে অদ্ভূত ও যুক্তিহীন বিশ্বাস- এই যুগে এসে যে কেউ এক বাক্যে বলবে। এছাড়াও বিধবাকে যে দামী স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে চিতায় তোলা হতো সেই স্বর্ণালঙ্কারের লোভ তো ছিলোই অনেকেরই। আর অন্যদিকে সীতাদাহ স্ত্রীর উপর স্বামীর অবিশ্বাস-দ্বন্ধ-কলহ আর সন্দেহের মাত্রাকে বাড়িয়েছে। বর্তমান এই যুগে সতীদাহ আর সীতাদাহ নামক নিকৃষ্ট-বর্বর প্রথা আর নেই। কোন নারীকে আর সত্যিকার অগ্নিতে দাহ করানো হয় না পুণ্যি লাভের ঐশরীক প্রত্যাশায়।

তবে সতীদাহ ও সীতাদাহ প্রথার নব্যসংস্করণ হয়েছে বর্তমানে। পরিবার ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নব্যসংস্করণগুলো আগুনের চেয়েও ঢের বেশী দাহ্য। সময় পেলেই আগুনের লেলিহান জিহ্বা বের করে গ্রাস করতে আসে। যদি বলি নারীই শুধু নব্যসংস্করণে দাহ হচ্ছেন তবে একপেশে হয়ে যাবে; অনেক ক্ষেত্রে পুরুষও সতীদাহ ও সীতাদাহে বলি হচ্ছেন। তবে পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাসে নারীর ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র সতীদাহ ও সীতাদাহ বলবৎ ছিলো। এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীই এর দ্বারা আক্রান্ত বেশী। সতীদাহ ও সীতাদাহ চলমান কালে যদি নারীকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা থাকতো তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রেই হয়তোবা প্রথাগুলো বলবৎ থাকতো এতে কোন সন্দেহ নেই। স্বামী বর্তমানে স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মৃত স্ত্রীর সাথে চিতায় তোলা হতো- কি বীভৎস -ভয়ংকর; ভাবলেই গা শিউরিয়ে ওঠে! যাক ইতিহাস কথা বলেছে অঙ্গুলী শাসানিতে। বর্তমান বাস্তবতায় নারী-পুরুষ উভয়কেই সতীদাহ ও সীতাদাহে জোর করে প্ররোচিত করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই প্রথাগুলোর মতো আরো অনেক সামাজিক-পারিবারিক প্রথা, জোর-জবরদস্থি, রীতি-নীতি ও আইন-কানুন গলার মালার মতো পরিধান করে নিতে হচ্ছে। এখানে সক্রেটিসের হেমলক পানের সাথেও তুলনীয় হতে পারে। এগুলো সতীদাহ ও সীতাদাহের চেয়ে কম কিসে! এশিয়ার প্রেক্ষিতে বলতে পারি, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর অবস্থা হয় অকুল সাগরে নিমর্জ্জনের মতো। স্ত্রীর নিজের বলে কোনদিনই কিছু পাওয়া হয়ে উঠে না। সে হোক বাপের বাড়ি আর স্বামীর বাড়িতে। স্বামীর বর্তমানে যা ছিলো স্বামীর বাড়ি; স্বামীর মৃত্যুর পর পরই তা হয়ে উঠে শশুড়বাড়ি। অবশেষে জন্মদাতা পিতার বাড়িতেই ঠাঁই নিতে হয়। আর যদি পিতা-মাতা বেঁচে না থাকে তাহলে কষ্টের শেষ নেই। আর শশুড়বাড়িতে থাকলে দিনে দিনে তা তো সতীদাহ আর সীতাদাহই হয়ে উঠে। স্বামীর ক্ষেত্রেও কম কিসে! স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীর তার শশুড়বাড়িতে কতটুকু আদর-আপ্যায়ন ও মর্যাদা থাকে সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। শশুড়বাড়ির আত্মীয়-স্বজন তো অনেক সময় জামাইকে সতীদাহ-সীতাদাহের কাষ্ঠে তুলে ছাড়েন। সতীদাহ-সীতাদাহ থেকে অবশেষে গাত্রদাহে পরিণত হয়। পরিবার ও সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা নিজেরা নিজেদের গাত্রদাহে রূপান্তরিত করে। কখনো অন্যের মাঝে ভালোর কিছু দেখা পান না। সব সময় অন্যের মাঝে নেতিবাচক দিকগুলোই বড় করে দেখে। আর নিজেকে ভালোর দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করিয়ে সতীসাধ্বীতে পরিণত করে। ভাবতে থাকে- আমিই প্রভু! অন্যের দিকে তখন অঙ্গুলীহেলনে বড়ই তুষ্ট হন। বড়ই হাস্যকর পরিস্থিতি হয় যখন দেখা যায় মাটির উপর রং লাগিয়ে সং সেজে ঢং দেখাতে সিদ্ধহস্ত। কুক্ষিগত করে তোলে সমস্ত কিছু। আমি পারি আর অন্যে পারে না এই ধুয়ো তুলে দিক্বিদিক্ মাতম তুলে। অন্যের ভালোকে ভালো না বলে বরং হিংসা নামক আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করেনা। ফলে গাত্রদাহ থেকে অতঃপর শুরু হয়ে যায় গৃহদাহ।

সতীদাহ ও সীতাদাহ ইতিহাসের আস্তাবলে নিক্ষেপিত হয়েছে। আর কোনকালে ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই। কোন নারীকেই আগুনে দাহ করা হবে না। তবুও অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সতীদাহ ও সীতাদাহে পুড়তে হয়। পারিবারিক অশান্তি-দ্বন্ধ -কলহ-সন্দেহ-ঘৃণা-অবিশ্বাস সবই সতীদাহ ও সীতাদাহের এক একটি রূপ। আর যদি সতীদাহ ও সীতাদাহের তাপ একবার সংসারে প্রবেশ করে তবে তা সত্যিকার সতীদাহ ও সীতাদাহকেও হার মানায়। তখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গাত্রদাহ থেকে শুরু করে গৃহদাহের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আর ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন-ভালবাসা। সতীদাহ-সীতাদাহ-গাত্রদাহ-গৃহদাহ কোনটিই কাম্য নয়। সবাই বাঁচুক স্বপ্ন আর ভালবাসার কুটিরে।

Please follow and like us: