ড. ফাদার শংকর ডমিনিক গমেজ
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য
শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষিত মানুষ তার অবস্থা বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারে। শিক্ষা লাভের কোন স্থানের প্রয়োজন হয় না। তবে শিক্ষার্থীদের সুন্দর গঠনমূলক শিক্ষা দেবার জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুবই প্রয়োজন। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন, শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নে তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকাগুলির উপলব্ধি ও সম্পাদনের চিরন্তন ক্ষমতা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থীদের সচেতন করা এবং শিক্ষাগত দর্শন এ অনুপ্রাণিত হতে উপযোগী করা। তাছাড়া, শিক্ষাদান ও উদ্ভাবনের উৎকর্ষে সক্ষম করা। আর শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণ করা।
কোভিড-১৯ সময়ে এবং এর পরবর্তীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জেসমূহ
কোভিড-১৯ সময়ে এবং এর পরবর্তীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্তরে ১০.৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৮.৩% মেয়ে। ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭মার্চ থেকে ২০২১ খ্রি: ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ছিল যা করোনার কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় দীর্ঘতম। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দেশের ৪৫% -এর বেশি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরে আসবে না। করোনা ভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে -ইউনিসেফ এর মতে। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। স্কুল হতে শিক্ষাথী ঝরে পড়ার কারণগুলি হচ্ছে –
১. দুর্বল শারীরিক অবস্থা
২. পক্ষপাতদুষ্ট সামাজিক অনুশীলন
৩. শিক্ষায় গুণমানের অভাব
৪. অর্থনৈতিক কষ্ট /দারিদ্র
৫. ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা
৬. পিতামাতার শিক্ষা
৭. অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার অসম প্রবেশাধিকার
৮. শিশু বিয়ে
কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার চ্যালেঞ্জসমূহ
১। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা
* শারীরিক দূরত্ব
* মাস্ক পরিধান
* স্যানিটেশন ও ওয়াশ ব্যবস্থা
* হাত ধোয়ার ব্যবস্থা
* জীবাণুুুমুক্তকরণের সময়সীমা
* আলো-বাতাস বা ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা
২। স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারা।
৩। দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৪। অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করা
* উপকরন
* শিক্ষকদের দক্ষতা
৫। সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা
শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক কার্যক্রমের কিছু উদাহরণ –
* খেলাধুলা
* মেডিটেশন
* যোগব্যায়াম
* গাছ লাগানো ও তার পরিচর্যা
* সঙ্গীত চর্চা
* ছবি আঁকা
* সামাজিক সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ
৬। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া
৭। সিলেবাস সম্পন্ন করা
৮। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি
* অসুস্থতা জনিত
* কোভিড-১৯ জনিত (শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের)
* পড়াশুনার প্রতি অনাগ্রহ
* উপার্জনমুখী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত পড়া
* শিশু বিয়ে
* অর্থনৈতিক কারণ
৯। কোভিড পরবর্তী পরিবেশ নিশ্চিতে অর্থের যোগান
* সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করা (পরিষ্কারক সামগ্রী/উপকরণ, স্যানিটাইজার /হাত-ধোয়ার উপকরণ, স্যানিটারি সরঞ্জাম, সাবান, কন্টাক্টলেস থার্মোমিটার)।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি উত্তরনে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
১। ক্লাসের শুরুতে শ্রেণি শিক্ষক কর্তৃক মোটিভেশনাল ব্রিফিং (৫ মিনিট) উপস্থাপন
(পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, কফ ও থুথু ফেলার শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ে)।
২। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের পরিকল্পনা
লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ; যেমন অনলাইন ক্লাস, বাড়ির কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রজেক্টভিত্তিক শিখনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করা যাতে এর মাধ্যমে যে সকল শিখনফল শ্রেণিকক্ষে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না, তা অর্জন করা যায়।
৩। শিখন পরিবেশ আনন্দঘন করতে বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
৪। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাদের মনো-সামাজিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ
– বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকগণ যাতে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন এজন্য তাদের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ।
৫। দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে পরিকল্পনা।
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনার ক্ষেত্রে দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া ও তাদের তালিকা প্রস্তুতের পরিকল্পনা গ্রহণ।
– শ্রেণি কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
– এ সকল শিক্ষার্থীর নিয়মিতকরণে অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের পরিকল্পনা।
– প্রয়োজনীয় শিখন-সামগ্রী, মাস্কসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী উপহার হিসেবে সরবরাহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ।
– ক্লাসের পড়ালেখা সম্পন করতে অতিরিক্ত সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করা।
৬। সিলেবাস সম্পন্ন করতে বিকল্প শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
অনলাইন ক্লাস, বাড়ির কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রজেক্টভিত্তিক শিখন কার্যক্রম, কুইজ প্রতিযোগিতা ।
শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তা
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্ত করানোর জন্য প্রথম এক/দুই সপ্তাহ পাঠ্যক্রমভিত্তিক শিখনের উপর গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলা ও সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ এবং শিক্ষকদের অবহিতকরণের পরিকল্পনা;
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রমে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক কার্যক্রম (যেমন- খেলাধুলা, ব্যায়াম, যোগ-ব্যায়াম) সংযুক্ত করা এবং বাড়িতেও তা অনুশীলনের জন্য উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষকদের যুক্ত করার পরিকল্পনা করা
করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া নির্দেশনাসমূহ
১. মহামারি প্রতিরোধক মাস্ক, জীবাণুনাশক এবং নন-কন্টাক্ট থার্মোমিটার সংগ্রহ করে জরুরি কাজের পরিকল্পনা প্র্রণয়নকরন।
২. শিক্ষক, শিক্ষাদান কর্মী ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ জোরদার করন। সকাল ও দুপুরে পরীক্ষার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং ‘ প্র্রতিদিনের প্রতিবেদন’ এবং ‘শূন্য প্রতিবেদন’ পদ্ধতি প্রবর্তন করন।
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষার্থী এবং বহিরাগত শিক্ষাদান কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা নিন। যাদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি পাওয়া যাবে, তাদের প্রবেশ নিষেধ করুন।
৪. শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ এবং পাঠাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা শক্তিশালী করুন। দিনে ২-৩ বার প্রায় ২০-৩০ মিনিটের মতো উন্মুক্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন। কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শীতাত পনিয়ন্ত্রকের স্বাভাবিক মাত্রা নিশ্চিত করুন। বিশুদ্ধ বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করুন এবং ফিরতি বায়ু চলাচল বন্ধ করুন।
৫. শ্রেণিকক্ষ, সর্ব সাধারণ কর্তৃক ব্যবহৃত হয়, এমন জায়গা সহ অন্যান্য জায়গার মেঝে ও ঘরের দরজার হাতল, সিঁড়ির হাতল এবং যে সব বস্তু বার বার ব্যবহৃত হয়, সে সব বস্তু ও তল পৃষ্ঠ ঘন ঘন পরিষ্কার ও জীবাণু মুক্ত করুন।
৬. খাবার থালাবাসন (পানির পাত্র) পরিষ্কার ও জীবাণু মুক্ত করন এবং প্রতিবার পরিবেশনের পরে পুনরায় ব্যবহার যোগ্য খাবার থালা বাসন (পানির পাত্র) জীবাণু মুক্ত করন।
৭. দূরে দূরে বসে খাবার গ্রহণ করুন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব থালা বাসন বা ওয়ান টাইম থালা বাসন ব্যবহার করুন
৮. প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরের আবর্জনা পরিষ্কার এবং আবর্জনা সংরক্ষণ কারী পাত্র জীবাণু মুক্ত করুন।
৯. অফিস কার্যালয়ে কাগজের সীমিত ব্যবহারকে উৎসাহিত করুন। শিক্ষাদান কর্মীদের পারস্পরিক শারীরিক যোগাযোগ কমান এবং দূরবর্তী বা অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিন।
১০. স্বাভাবিক অবস্থা না আসা পর্যন্ত কোন ও প্রকার অভ্যন্তরীণ জমায়েত বা ক্রিয়াকলাপের আয়োজন করবেন না। যে কোনও বদ্ধ বা ঘন জনবহুল স্থান বা অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন।
১১. শিক্ষক, শিক্ষাদানকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের বহির্গমন কমিয়ে দিন।
১২. শিক্ষাদান কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীরা মাস্ক ব্যবহার করুন। হাত ধোয়াসহ অন্য সব স্বাস্থ্য বিধি শক্তিশালী করন। দ্রুত হাত শুকানো জীবাণু নাশক বা জীবাণু নাশক টিস্যু ব্যবহার করুন। হাঁচি দেওয়ার সময় মুখ এবং নাক ঢাকতে টিস্যু বা কনুই ব্যবহার করুন।
১৩. মহামারি প্রতিরোধকে জোরদার করুন। শিক্ষক, শিক্ষাদানকর্মী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সময় নিয়ন্ত্রণ করুন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করুন।
১৪. শিক্ষক, শিক্ষাদানকর্মী বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর সন্দেহভাজন কোনও কেস থাকলে তাৎক্ষণিক ভাবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে জানান এবং যারা এই কেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের দ্রুত শনাক্ত ও কোয়ারেন্টিন করুন।
১৫. কোয়ারেন্টিনে অবস্থানরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী বা শিক্ষার্থীদের পিতা মাতার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করার জন্য একজন বিশেষ ব্যক্তি কে নিয়োগ করুন।
১৬. কোনও নিশ্চিত কোভিড-১৯ কেস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষেও নির্দেশ অনুযায়ী শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ু চলাচল ব্যবস্থা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করুন। মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটির পুনরায় ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত থাকুন।
১৭. একত্রে বসে খাওয়ার মতো ডাইনিং পরিষেবা বন্ধ রাখতে হবে।
কোভিড -১৯ প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য প্রতিষ্ঠান/ শিক্ষকদের প্রয়োজন হবে:
১। শক্তি ও মনোবল, ২।আবেগতব্যবস্থাপনা, ৩।মনোযোগ ও সচেতনতা, ৪।সম্পর্ক, ৫।মোকারবলা, ৬।অভ্যাস এবং লক্ষ