কলাম: জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

জন প্রচারক নামেই তিনি অধিক পরিচিত। অনেকে আবার জন মাষ্টার হিসেবে চিনেন। তবে সবার উপরে তিনি ছিলেন গারো পাহাড়ের পাদদেশে নিভৃতচারী খ্রিস্টপ্রচারক। সবার অলক্ষ্যে যশ-খ্যাতি বিসর্জন দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের খ্রিস্ট প্রচারক। যিশুর আদেশ “পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে দীক্ষাস্নাত কর” বাণী ছিলো জন মাষ্টারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী বনানীতে পড়াশুনাকালীন ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের কয়েকটি ধর্মপল্লীতে আমার প্রৈরিতিক সেবাকাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। ধর্মপল্লীর প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামগুলোর অবস্থান। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই থাকার সৌভাগ্য হয়। পরিচয়ের একপর্বে খ্রিস্টভক্তগণ যখন জানতে পারতেন যে আমার ধর্মপ্রদেশ রাজশাহী; তাদের কৌতুহলের শেষ থাকতো না! ধর্মপল্লীর নাম বললে তাদের কৌতুহল যেতো আরো বেড়ে। কৌতুহল বাড়ার কারণ বুঝতাম একটু পরে; যখন সবার মুখে জন প্রচারকের কথা শুনতে পেতাম। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বয়স্ক ব্যক্তিগণ জন প্রচারক বলতে অন্ধ! সে সময় জনগণের মুখে জন প্রচারকের বিষয়ে শুনতে বেশ ভালোই লাগতো। শত হলেও তিনি আমাদেরই এলাকার লোক। জন প্রচারকের নাম শুনেছি; তবে দেখার প্রশ্নই আসে না কারণ বহু আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। জনগণের মুখে জন প্রচারকের কথা শুনে কল্পনায় একটা চিত্র ঠিকই অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজনের মুখে শুনেছি জন প্রচারক এই গ্রামে কতবার যে এসেছেন। সাপ্তাহের পর সাপ্তাহ অবস্থান করে দিয়েছেন শিক্ষা। আর সেই শিক্ষার আলো আজ গারো পাহাড়ের পাদদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। জন প্রচারকের যেন হয়ে উঠেছিলেন গারোদেরই আপনজন। জন প্রচারকের মেয়ে সিসিলিয়া গমেজের সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় ‘আমার বার বার মনে হয় বাবা সেই চলন্ত ট্রেনে আজও রুমাল উড়িয়ে বলছেন, “আমি মরে যাইনি, আমি বেঁচে আছি গারো অঞ্চলের বিভিন্ন পল্লীর পথে পথে” (সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, ৩০ সেপ্টেম্বর-৬ অক্টোবর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দ)।

বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর মাহুইটেগো বাড়ির গোপাল জন গমেজ ও মতি মারীয়া দেশাই এর কোল আলো করে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর জন গমেজ জন্মগ্রহণ করেন। গোপাল জন গমেজ ও মতি মারীয়া দেশাই এর ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে বিশপ ফ্রান্সিস গমেজ দীর্ঘ বছর যাবৎ ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বিশপ ছিলেন। জন গমেজের রাঙ্গামাটিয়া মিশন প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ির পর যাজক হবার মানসে ১৯৩৪-১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বান্দুরা সেমিনারীতে অবস্থান করে হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে তিনি সেমিনারী জীবন ত্যাগ করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কৃষ্ণনগরের সাধু ডন বস্কো টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ১ বছর অতিবাহিত করে বাড়িতে চলে আসেন। এই সময় তিনি বাড়িতে কি করেন সে বিষয়ে জানা যায় না; তবে জন মাষ্টারের মেয়ে সিসিলিয়া গমেজের সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, ৩০ সেপ্টেম্বর-৬ অক্টোবর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দের একটি লেখায় পাওয়া যায়, “অবশেষে বাবা মাত্র ২২ বছর বয়সে তার কাজের হাল ধরেন এই গারোদের মধ্যে। তিনি তাদের সাথে এমনভাবে মিশেছেন যে তাদের সাথে নানা আনুষ্ঠানিক কৃষ্টিতে অংশ নিতেন”। জন মাষ্টারের জন্মসাল থেকে হিসাব করলে ২২ বছর আসলে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দেই হওয়ার কথা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের কারণে অনেকেই সহায়-সম্পত্তি ফেলে রেখে দেশান্তরী হচ্ছিলেন। আবার অনেকেই ভাগ্যান্বেষন্নে স্বদেশেই অভিবাসিত হয়েছেন। আর এরই মধ্যে দেশভাগের ১ বছর পর জন গমেজ পাবনা জেলার মথুরাপুর মিশনের জগতলা গ্রামে এসে বসতি গড়েন।

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মথুরাপুরে সাধ্বী রীতা’র প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠে; আর এই বিদ্যালয়ে ১৯৪৯-১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জন মাষ্টার শিক্ষকতা করেন। তিনি গণিত ও ইংরেজিতে বেশ দক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়। তার শিক্ষণ পদ্ধতি ছিলো অভিনব! অসম্ভাবী ছিলো মুখে মুখে হিসাব করার দক্ষতা। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল জন মাষ্টার লাউতিয়া গ্রামের সেরাও পরিবারের ভিক্টোরিয়া তেরেজা সেরাওকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। সংসার জীবনে তারা ৪ ছেলে ও ৬ মেয়ের পিতামাতা। জন প্রচারক বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বর অন্য কাজের জন্য তাকে ডাকছেন। ঈশ্বরের এই ডাক তিনি অন্তর গভীরে উপলব্ধি করেন। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশে বাণী প্রচারের জন্য চলে যান জন প্রচারক। বলতে গেলে জন প্রচারকের জীবনটা ছিলো বেশ বর্ণিল। একজন বাঙ্গালী হয়েও তিনি গারোদের সাথে যেভাবে মিশেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। ফাদার এল.টি. Bower, সিএসসি’র তত্তাবধানে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভালুকাপাড়া ধর্মপল্লীতে প্রচারকের কাজ করেন। তিনি কোন প্রকার রিক্সা, ঘোড়া বা যানবাহনে চড়ে প্রচারের কাজ করেননি বরং পায়ে হেঁটে তিনি খ্রিস্টের বাণী দূরদূরান্তে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন। জানা যায় যে, জন প্রচারক নাকি সাইকেল চালাতে জানতেন না। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পাহাড়, বন, সমতল পেরিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছেন। কোন প্রকার বিপদ-আপদ তাকে পিছুপা করতে পারেনি। অধিকাংশ গারোই তখন ছিলেন সাংসারেক ধর্মবিশ্বাসী। পূজা-পার্বণই ছিলো তাদের বিশ্বাসের বাহ্যিক আচার। এটা সত্য যে, নতুন ধর্মকে গ্রহণ করাতে ও করতে প্রথমে সবাইকেই বেশ বেগ পেতে হয়। জন প্রচারকও এর বাইরে ছিলেন না; নানা জায়গায় নানাভাবে তাকে হতে হয়েছে হয়রানির শিকার! জন প্রচারকের মুখে খ্রিস্টের মধুর বাণী শুনে অনেকেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। ফলে সাংসারেক ধর্মবিশ্বাসের মাতব্বরগণ হয়ে পড়েন শঙ্কিত। জন প্রচারককে দমন করার অন্য আর কোন উপায় না পেয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও করা হয়েছিলো।

১৯৬৪-১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জন প্রচারক ফাদার আলফ্রেড নেফ, সিএসসি’র সাথে খ্রিস্টধর্মীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভাটিকেশ্বরে সহ-প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইলের জলছত্র ধর্মপল্লীতে ফাদার ইউজিন হোমরিক, সিএসসি’র অধীনে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। কোন অখ্রিস্টান সাংসারেক ধর্মে বিশ্বাসী গ্রাম যদি দীক্ষা লাভ করতে আগ্রহী হতো তাহলে জন প্রচারক আগে থেকেই সেই গ্রামে চলে যেতেন। সাপ্তাহ ও মাসব্যাপী সেখানে অবস্থান করে গ্রামবাসীকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করতেন। গারো জনগণ যেহেতু দিনের বেলায় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাই জন প্রচারক সন্ধ্যা বা রাতের বেলায় জনগণের সাথে বসতেন। তাদের প্রতিদিনকার দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, অত্যাচার, নিপীড়ন, সমস্যা ও আনন্দের খবরা-খবর নিতেন। এরপর জনগণের আগ্রহ ভরা অন্তর দেখে শুরু করতেন বাণী প্রচার। জন প্রচারক গারো ভাষায় দক্ষ ছিলেন বিধায় প্রচারের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে বেশ। তিনি গারোদের সাথে তাদের মতো করে মিশেছেন। খাবার দাবারে কোন ধরণের অভিযোগ ছিলো না। যে খাবার পেতেন তাই খেতেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ফাদার ইউজিন হোমরিক, সিএসসি’র উৎসাহে দ্বিতীয় বিভাগে তৎকালীন মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাশ করেন। মণ্ডলিতে জন প্রচারকের সেবা ও অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে ভাটিকানে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি পুণ্যপিতা সাধু ৬ষ্ঠ পলের সাথে সাক্ষাৎসহ ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন। ভাটিকানে প্রেরণের পিছনে ফাদার হোমরিকের অবদান ছিলো অসামান্য। এরপর আরো বেশ কয়েক বছর জন প্রচারক ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অবশেষে বয়সজনিত কারণে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন জন প্রচারক কাটেখিস্টের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। পরবর্তীতে তিনি মথুরাপুর ধর্মপল্লীর জগতলা গ্রামে বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে জন প্রচারক মৃত্যুবরণ করেন।

‘বিসর্জনে অর্জন’ জন প্রচারকের জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি পার্থিব বিষয়াসক্তি বিসর্জন দিয়েছেন তবে স্বর্গে যাবার পথ অর্জন করেছেন নিশ্চিত। জন প্রচারক মানুষ হিসাবে ছিলেন সহজ-সরল; বলা চলে সাদামনের মানুষ। বস্তুগত বিষয়ের প্রতি ছিলেন অনাসক্ত। কাটেখিস্টের কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। কোন প্রকার উচ্চাকাঙ্খা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সমগ্র জীবনটা অতিবাহিত করেছেন সৎচিত্তানন্দকে খুঁজতে। আর সত্যিই খ্রিস্টকে প্রচারের মধ্য দিয়ে সে সৎচিত্তানন্দকে খুঁজে পেয়েছেন। লালন সাঁইজির গানের কলি “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” ছিলো জন প্রচারকের ধ্যান-জ্ঞান। কারণ জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি মিশেছেন মানুষের সাথে; খুঁজেছেন সেই মনের মানুষকে। খ্রিস্টকে তিনি দেখেছেন গারো পাহাড়ের পাদদেশে; আর খ্রিস্টকে প্রচারের নিমিত্তে মানুষ ভজে তিনি হয়ে উঠেছেন গারো পাহাড়ের পাদদেশের নিভৃতচারী খ্রিস্টপ্রচারক।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১। ডমিনিক গমেজ (জন গমেজের ছেলে)
২। ৩০ সেপ্টেম্বর-৬ অক্টোবর, ২০০১ খ্রীষ্টাব্দে সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে প্রকাশিত জন গমেজের মেয়ে সিসিলিয়া গমেজের লেখা।
৩। আইরিন গমেজ (জন গমেজের মেয়ে) ও মার্শেল পালমা (মেয়ের জামাই)

Please follow and like us: