জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
গুজব আর হুজুগ একসাথে যায়। তারা যেন একে অপরের সহোদর; পয়সার এপিঠ আর ওপিঠ। গুজবের পরিণাম হচ্ছে হুজুগে কিছু করে ফেলা। নিজের বাহাদুরী ও পেশীশক্তি প্রদর্শন। হুজুগ আর গুজব কখনোই ভালো কিছু দিতে পারে না। বরং কাউকে জব্দ, হেয় ও ধ্বংস করাই হচ্ছে গুজব ও হুজুগের লক্ষ্য। আবার এ সহোদর দু’জন পরিবার, সমাজ, মণ্ডলি, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক কাঠামোকে লন্ডভন্ড করে দেয়। হুজুগ ও গুজবকে তাই সমাজিক ব্যাধি বলা যায়। হুজুগ আর গুজবের মধ্যে যুক্তি-বুদ্ধি-দর্শন-চিন্তা-প্রত্যক্ষ পরীক্ষণ ও নিরীক্ষণ নিস্ক্রিয়। বরং আবেগ-অন্ধবিশ্বাস সেখানে সক্রিয়। তাই লোকমুখে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, ‘হুজুগে কিছু করতে যেয়ো না’। সমাজ ও রাষ্ট্রে হুজুগ আর গুজবে কান দেওয়ার লোক নেহাত কম নয়। গুজব আর হুজুগ শিক্ষিত-অশিক্ষিত দেখে আসে না। বরং শিক্ষিত ব্যক্তিও গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু করে ফেলতে পারে। কানকথা আর কানপড়া বলে দুটি শব্দ রয়েছে। এই শব্দ দুটি হুজুগ আর গুজবের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িত। বাঙ্গালীর একটি বদ্যাভাস অন্যের বিষয়ে কানকথা আর কানপড়া চর্চা করা। শেষে ভদ্রবেশে বহু আবেশে হুজুগ আর গুজবের সত্যতা বিচার না করে চিলের পিছে দৌড়ায়। তখন হয় লেজেগোবরে অবস্থা।
গুজব আর হুজুগের হাত বেশ প্রসারিত। গুজব ও হুজুগে কোন সত্যতা থাকে না। বরং মিথ্যা ও বানোয়াটকে কেন্দ্র করেই গুজব ও হুজুগের পথ সৃষ্টি হয়। গুজব ও হুজুগ যেন পরগাছার মতো। এরা নিজে নিজে বাঁচতে পারে না। বরং অন্যের ঘাঁড়ে চড়ে ডালপালা ছড়ায়। গুজবের ডালপালা জনমনে এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে তখন আসল সত্যকে আছড়ে ফেলে গুজবটাই সত্য হয়ে উঠে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে গুজবে বিশ্বাসী হয়ে হুজুগে মিথ্যার পিছনে দৌঁড়ানোর স্বভাব ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরেই বিদ্যমান। ফলে সত্যের বাণী নিভৃতে কাঁদে আর গুজবের বাণী ক্ষণিক সময় ধরে তরবারি শাণিত করে এক প্রকার হত্যার খেলায় মেতে উঠে। এই রকম নারকীয় পরিস্থিতিতে গুজব আর হুজুগের শক্তি যেন অন্য যে কোন শক্তিকে হার মানায়। প্রশাসনিক আইন প্রণয়ন সেখানে গৌণ্য হয়ে পড়ে। গুজব আর হুজুগকে যে একপাশে রেখে সত্যের বাণীকে সামনে এনে দাঁড় করাবে সে জ্ঞান লোপ পায়। বরং নিজের মূর্খতাকে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যাশাই গুজবে কান দিয়ে হুজুগে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার আগ্রহে ঘি ঢেলে দেয়। গুজব ও হুজুগের সাথে ধর্মীয় অন্ধত্ব, মূর্খতা ও গোঁড়ামী একসাথে যায়। যখন নিজের আমিত্বকে বড় করে দেখে অন্যের চাহিদাকে যে কোন উপায়ে বিসর্জন দেবার পায়তারা জেগে ওঠে তখন গুজব ও হুজুগের ডালপালা জেগে উঠতে থাকে।
রামায়ন মহাকাব্যের অধিপতি রাম সীতাকে নিয়ে বনবাস থেকে ফিরে এলে জনমহলে সীতার সতীত্ব নিয়ে গুজব উঠে। কারণ সীতা রাবণের কাছে অনেকদিন যাবৎ বন্দি অবস্থায় ছিলো। অবশেষে সীতাকে তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে আগুনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। মহাধিপতি রাম গুজবের কাছে পরাজিত হয়ে জনমনের হুজুগকে প্রশ্রয় দেন। জনমনকে তুষ্ট করার জন্য নিজের স্ত্রীর সতীত্বের পরীক্ষা নিতে হয় তাকে। এই রকম গুজবের ঘটনা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্যে আরো অনেক রয়েছে। আর এর ফলে এটাই প্রকাশিত হয় যে, গুজবে কান দেবার প্রবণতা আগে যেমন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিলো এখনো ঠিক তদ্রূপ বিদ্যমান। বরং এই অত্যাধুনিক যুগে এসে কোন কোন ক্ষেত্রে হুজুগ আর গুজবের ডালপালা যেন প্রসারিত হয় আরো বেশী। তবে যুগের প্রবাহে এর ধরণ পাল্টেছে। এক সময় গুজব ছড়াতো মানুষের মুখে মুখে। আর এই যুগে এসে মুখে মুখে ছড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের ডিজিটাল মাধ্যম সেই স্থান দখল করে নিয়েছে।
পৃথিবী এমন একটা ক্রান্তিকাল পাড় করছে যখন মৃত্যু দিন দিন গৌণ্য হয়ে পড়ছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে আরো মৃত্যু। বৈশ্বিক অর্থনীতির মেরুদন্ড ভঙ্গুরপ্রায়। তবু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অনবরত অব্যাহত রেখেছে প্রতিটি দেশ ও বিশেষজ্ঞগণ। আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা গুজব ছড়িয়ে অন্যকে দিয়ে হুজুগে কিছু করিয়ে ফায়দা লুটার ধান্ধায় আছে। ইতিমধ্যে সে চিত্র আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গুজুবের খবর বেশী লক্ষণীয়। যেখানে বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ব্যর্থ; সেখানে অনেকের স্বপ্নে করোনা ভাইরাসের ঔষধ আবিষ্কারের গুজব ইউটিউব, ফেসবুকে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। এমনকি রাস্তায় রাস্তায় ঔষধ বিক্রির কথাও শোনা যায়। এই রকম গুজব রটনাকারীর সমর্থনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে মিথ্যার দিকে চালিত করার পায়তারা আগে যেমন ছিলো এখনো তা বিদ্যমান। সম্প্রতি কুমিল্লার ঘটনার সাথে সারাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলে যাবার নয়। এ এক আজব দেশ! গুজব ছড়াতে সময় লাগে না; আবার গুজুবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু করে ফেলতে সিদ্ধহস্ত।
আমি, আপনি ও আমরা কি গুজব ও হুজুগের পিছনে দৌঁড়াই! কে কি বললো না বললো সেটা নিজ কানে শুনিনি, দেখিনি ও সেটার বিচার-বিশ্লেষণ নেই, সত্যতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বরং মিথ্যা, মনগড়া কিছু বলে ফেললে সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্যের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘নিজের খেয়ে অন্যের মহিষ তাড়ানো’ আমাদের অবস্থা বুঝি সেই রকম হয়েছে। গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু করে ফেললে কখনোই ভালো কিছু হয় না তা প্রায়শই হাড়ে-হাড়ে টের পাই। গুজব শুনে হুজুগে ধ্বংসাত্মক কিছু করে ফেলা অন্য কোন দেশে হয় না বলেই মনে হয়। বাঙ্গালীরা এ দিক দিয়ে একধাপ এগিয়ে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত উভয়েরই মাঝে গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু নেতিবাচক কাজ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। তবে সচেতন যিনি তিনিই শিক্ষিত আর এই সচেতন মহল কোনদিনও কাউকে কখনো কানপড়া দেয় না এবং হুজুগেও কিছু করে না। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত যারা তারা নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কতিপয়ের মাঝে গুজব ছড়িয়ে হুজুগে ফায়দা লুটার ধান্ধায় থাকে। এই জায়গাটাই আমাদের বুঝি আরো বেশী সচেতন হয়ে উঠা প্রয়োজন।
কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় বহু আগেই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার গুজবের বাস্তব চিত্র ব্যক্ত করেছেন “ঐ নিয়েছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে”। আমাদের গুজবে কান দেবার প্রবণতা যেন একটু বেশীই। গুজবে কান দিয়ে যদি চুপটি করে বসে থাকতো তাহলে না বুঝা যেতো কিন্তু ঐ যে হুজুগ নামক বায়বীয়ের প্রতি আসক্তি সেটা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আসল ঘটনার রহস্য উৎঘাটন না করে মিথ্যের পিছে দৌঁড়ে মরি। আর শেষে দেখি সবই পণ্ডশ্রম। এরই মধ্যে ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেল। ফলে অনেক সময় সত্যি সত্যিই কান হারাতে বসি। ফেসবুকে ও অন্যান্য মিডিংয়ায় খুবই দ্রুত গতিতে গুজবের ডালপালা ছড়ায়। অনেক সময় এমন ঘটনাও ঘটে যে, যাকে নিয়ে পরিকল্পিত গুজবের রটনা সেই ব্যক্তিই গুজব সমন্ধে অবগত নন কিন্তু দেশের বাইরে তার সম্বন্ধে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আর একজন ব্যক্তি এই গুজবের বলি হলে তার পরিণাম কিই না ভয়াবহ! ধনুকের তীর ও মুখের কথা একবার বের হয়ে গেলে যেমন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়; তেমনি গুজব একবার ছড়িয়ে পড়লে তা তুলে আনা যায় না। গুজব ও হুজুগের ভয়াবহতা উপমহাদেশ তথা এ দেশের মানুষ অনেকবার অভিজ্ঞতা করেছে। ৪৭- এ দেশ ভাগের আগে ও পড়ে, ৭১- এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এমন কি এই আধুনিক যুগে এসেও গুজব আর হুজুগের বলি হতে হচ্ছে অনেককে। যে গুজব আর হুজুগে কান দিয়ে মানুষ অস্ত্রের খেলায় মেতেছে সে খেলা যেন শিশুর পুতুল খেলার মতোই সন্ধ্যায় আপনি আপন ঘর ভাঙ্গার মতো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- গুজব ও হুজুগ কোনদিনই মানুষের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনেনি এবং হলফ করে বলে দেওয়া যায় কখনো কোনদিন বয়েও আনবে না। গুজব আর হুজুগের ভয়াবহতা কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় যেন এই রকম, “সুধী সমাজ: শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি, যে জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই”।
মুখরোচক খাবারের প্রতি মানুষের টান ও আকর্ষণ চিরদিনেরই। কিন্তু মুুখরোচক খাবার কোনদিনই মানব দেহের জন্য উপকারী নয়। এই ধরণের খাবার মূহুর্তে মানুষের শরীরের ক্ষতি না করলেও ধীরে ধীরে স্বল্পায়ুর দিকেই নিয়ে যায়। গুজব যেন সেই মুখরোচক খাবারের মতোই। বেশীর ভাগ মানুষের কাছে তা প্রিয়। তবে ক্ষতির পরিমাণ অপরিমাপযোগ্য। গুজব রটানোর মানুষের যেমন অভাব থাকে না তেমনি গুজব শুনে হুজুগে কিছু করে ফেলার লোকের সংখ্যাও কম নয়। গুজব যেন ‘বাতাসে তাড়িত তুষের মতো’। একটু প্রশ্রয় পেলেই গুজব তুষের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ানো যেন দিনকে দিন শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে। একবার যদি কোন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে যায় তাহলে তা আর রোধ করা যায় না। ফলে ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজবের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রনয়ণ করেছেন। এই আইন প্রনয়ণ ডিজিটাল গুজবকে কতটুকু রোধ করতে পারবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে কিন্তু একটা থেকেই যায়- আইন করে না হয় ডিজিটাল গুজব রোধ করা গেল; মানুষের অস্থিমজ্জায় যে গুজব আর হুজুগ নামক বিষ বাড়ে তা কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে! তবে এটা বলা যায় যে, সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামাজিক সচেতনতাই গুজবকে রোধ করতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই গুজব ও হুজুগ হতে সাবধান! কারণ আপনার ছড়ানো গুজবে পড়ে হুজুগে অনেকে বুঝে না বুঝে ব্যক্তি, পরিবার, মণ্ডলি ও দেশকে রসাতলে নিয়ে যেতে পারে।
প্রকাশকাল: বিডি খ্রিস্টান অনলাইন, ১২ মে ২০২০