ঘন কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকাল। থর থর করে কাপছে এক বুড়িমা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন বুড়িমা? সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি হেসে বললেন, কেন জানেন না! আজ যে নবাই বটতলা রক্ষাকারিণীর তীর্থ উৎসব! প্রশ্ন করলাম; এই কোভিডের মধ্যে খ্রিস্টভক্তরা কী তীর্থ করতে আসবেন? বুড়িমা এক গাল হেসে উত্তর দিয়ে বললেন, আমার বিশ্বাস অবশ্যই আসবেন। যেহেতু রক্ষাকারিণী মাকে ভালবাসি, তাঁকে শ্রদ্ধা করি এবং অত্র এলাকার মানুষেরা এ মায়ের প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করেই ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তাই, এই করোনা ভাইরাসের হাত থেকেও তিনি আমাকে এবং আমাদেরকে রক্ষা করবেন এটাই বিশ্বাস করি এবং তার জন্যেই তার পানে ছুটছি। মুচকি হেসে বুড়িমা অগাথ বিশ্বাস নিয়ে মা মারীয়ার তীর্থ স্থানের দিকে এগিয়ে চললেন। এ বিশ্বাস নিয়েই প্রতিবারের ন্যায় এবারও ১৬ই জানুয়ারি, ২০২২ খ্রি: রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থ স্থানে ভাব-গাম্ভীর্য পরিবেশে ও স্বাস্থ্য রক্ষা মেনে তীর্থ উৎসব উদযাপন করা হয়। এই তীর্থ উৎসবকে কেন্দ্র করে গত ৭ই জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০:০০টা থেকে ১:০০টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪:৩০ মিনিট থেকে ৫:৩০ মিনিট পর্যন্ত নভেনা, পাপস্বীকার সংস্কারগ্রহণ ও খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে খ্রিস্টভক্তগণ তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ নভেনা অনুষ্ঠানে আশেপাশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দল এসে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

১৬ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ের একটু পরেই পর্বীয় খ্রিস্টযাগের আগে অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র ক্রুশের পথ। শুরুর দিকে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা একটু কম থাকলেও ক্রুশের পথ চলাকালীন সময়েই অনেক তীর্থযাত্রীগণ এতে অংশগ্রহণ করেন। ক্রুশের পথের পরপরই পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে তীর্থের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।

সকাল ০৯:৩০ মিনিটে শোভাযাত্রা সহযোগে পবিত্র খ্রিস্টযাগ শুরু হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। এছাড়াও ১৮জন যাজক, ৩৫জন সিস্টার ও প্রায় ৭০০০ খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন।

বিশপ মহোদয় তার উপদেশে বলেন, খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা আজ আমরা এই নবাই বটতলায় এ তীর্থ স্থানে এসেছি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের আশির্বাদ ও কৃপা লাভ করতে। সেই সাথে আমরা যে মানত করেছি তা পূরণ করতে কিংবা কেউ কেউ এসেছি নতুনভাবে মানত করতে যেন রক্ষাকারিণী মা মারীয়া আমাদেরকে আশির্বাদ করেন। ‘আমরা জানি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষাকারিণী কুমারী মারীয়ার মধ্যস্থতায় পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে এই নবাই বটতলার গ্রামবাসীগণ রক্ষা পেয়েছিলেন। সে দিনকে বা রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার সেই আর্শিবাদের কথা স্মরণ করেই এই তীর্থস্থান গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ যদি প্রশ্ন করি সেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মানুষের বিশ্বাস কী আজ আমাদের মধ্যে আছে? যদি বিশ্বাস থাকে তাহলে এখনো আমরা মায়ের মধ্য দিয়ে প্রার্থনা করলে তিনি অবশ্যই তা শুনবেন। কেননা মারীয়া সবসময় তার সন্তানদের ভালবাসেন এবং যত্ন নিয়ে থাকেন। কানা নগরে বিবাহ ভোজে জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করা তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে, বিশ্বে আবারও করোনা ভাইরাস বেড়ে চলেছে এবং এর হাত থেকেও মা মারীয়াই আমাদের রক্ষা করবেন। তাই, আসুন আজ আমরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি ঈশ্বরের কৃপা আশির্বাদ দানে আমাদের এ বিশ্ববাসীকে সমস্ত বিপদ আপদ ও ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত করেন।’

নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর খ্রিস্টভক্তদের মধ্য থেকে মিসেস স্কলাসস্টিকা বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা এই দিনটিতে রক্ষাকারিণী কুমারী মারীয়ার তীর্থ উৎসব করি, আর সত্যিই মায়ের আশির্বাদ আমরা লাভ করি। রক্ষাকারিণী মা আমাদের সকল নিবেদন পূর্ণ করেন আমাদের সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। ’

নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর আরেকজন খ্রিস্টভক্ত বলেন, ‘রক্ষাকারিণী কুমারী মারীয়া আমাদের সবার মা। তিনি আমাদের ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি আজও আমাদের এই ধর্মপল্লীর সকলকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে যাচ্ছেন।’

রক্ষাকারিনী মারীয়ার তীর্থের খ্রিস্টযাগে পর রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার তীর্থস্থান পরিদর্শন করতে এসে সকলকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলেন, আজকের দিনে আপনারা যে যেখানে থেকে আপনাদের মনের দু:খ নিয়ে কষ্ট নিয়ে এখানে এসেছেন রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার মধ্যস্থায় পরিত্রাণ চাচ্ছেন, আমিও আমার আল্লার কাছে দোয়া করি যেন আপনারা আপনাদের এ পবিত্র দিনে যে পবিত্র নিয়ত নিয়ে এসেছেন সবার সে নিয়তগুলি রক্ষাকারিনী মা মারীয়া যেন একশ ভাগ পূরণ করে দেন।

সবশেষে নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার মাইকেল কোড়াইয়া সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার কাছে আমার একটি মাত্র প্রার্থনা তিনি যেন গোটা বছর ধরে আমাদের সকলকে সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। ধর্মপ্রদেশীয় এ মহা তীর্থে আপনারা যারা অংশগ্রহণ করেছেন মা মারীয়া আপনাদেরকে শত শত অনুগ্রহ ও আশির্বাদদানে ঘিরে রাখেন।

উল্লেখ্য, নবাই বটতলায় খ্রিস্টভক্তগণ ৮ নভেম্বর, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষাকারিণী কুমারী মারীয়ার মধ্যস্থতায় পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পান। তখন থেকে প্রতি বছর এই দিনটি স্মরণ করে রক্ষাকারিণী কুমারীর প্রতি ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা নিবেদন করা হয় এবং রক্ষাকারিণী কুমারীর স্মরণে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ১৬ জানুয়ারি পর্ব উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পবিত্র খ্রিস্টযাগের পর অনেক ভক্তবিশ্বাসীগণ মায়ের আশির্বাদ গ্রহণ করেন ও নিজ নিজ মানত নিবেদন করে রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার তীর্থস্থান থেকে বিদায় নেন।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

 

Please follow and like us: