ফাদার সাগর কোড়াইয়া
একটি সময় যোসেফ গমেজ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। তবে সাধু নামটি যোসেফ নামের সাথে যুক্ত হয়েছে তাঁর জীবনের মধ্য গগনে। পরবর্তীতে জোনাইল এলাকাসহ আশে পাশের অন্যান্য এলাকা ও গাজীপুরের ভাওয়াল এলাকায় সবাই তাঁকে সাধু নামেই চিনতো ও জানতো। আবার অনেকে যোসেফ নামের পূর্বে সাধু নাম যুক্ত করে সাধু যোসেফ নামে ডাকতেই পছন্দ করেন। নামের সাথে মিল রেখে এক সময় বাড়ির নামও হয়ে যায় সাধুর বাড়ি বা সাধু যোসেফের বাড়ি। সাধু যোসেফের নিজ হাতে ও যত্নে গড়ে তোলা বাগানবেষ্টিত বাড়িটি এখনো সাধু যোসেফের উপস্থিতিকে প্রকাশ করে। বাউল সাধক লালন ফকির ও বাংলা সাহিত্যজগতের দিক্পাল রবি ঠাকুরের মতো সাদা চুল ও দাঁড়িতে সাধু যোসেফকে কখনো লালন আবার কখনোবা রবি ঠাকুরের মতো দেখতে লাগতো। তবে সাধু যোসেফ নিজেকে লালন ফকিরের অনুরাগী হিসাবে পরিচয় না দিলেও নিজের মধ্যে চলন-বলন, কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে একটা বৈরাগ্যভাব সব সময় বজায় রাখতেন। ফলে বোর্ণী ধর্মপল্লীর দিক্পাল নমস্য ফাদার আঞ্জেলো কান্তনের ‘সাধু’ নামকরণ ও যোসেফ গমেজের বৈরাগ্যভাব উভয়ই তাঁকে সত্যিকারের সাধু পুরুষে পরিণত করেছিলো। বোর্ণী তথা আশে-পাশের ধর্মপল্লীসহ ভাওয়ালের ধর্মপল্লীগুলোতে তিনি সন্ন্যাসী, বৈরাগী, ভাববাদী ও সাধু পুরুষ হিসাবেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সাধু নামের বাংলা অর্থ হচ্ছে- কুশল, মঙ্গল, প্রশংসা, কল্যাণকর, মঙ্গলময়, মঙ্গলযুক্ত, মঙ্গলপ্রদ, কল্যাণপ্রদ। অন্যভাবে সাধু অর্থ কল্যাণাগমনের শ্রী যুক্ত উক্তি, সাদর সম্ভাষণ, সৎগুণের বিশেষ উক্তি, ক্ষমা প্রদান, ইতি। আবার সাধু অর্থ উৎসাহ দেওয়া, অনুমোদন করা। উপরিউক্ত প্রতিটি বিশেষণেই সাধু যোসেফ গমেজকে বিশেষায়িত করা যায়।
সাধু যোসেফ গমেজে’র জীবনটা ছিলো বিভিন্ন বর্ণে বর্ণিত। অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এই মানুষটির জন্ম হয়েছিলো প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার ঠিক ২ বছর পরে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারী তৎকালীন মাউসাইদ ধর্মপল্লীর (বর্তমানে ভাদুন ধর্মপল্লী) অধিন্যস্ত হারবাইদ মৌজার কোদালিয়া বা কোদাইল্লে গ্রামে। সাধু যোসেফ গমেজে’র পিতা জন কান্দু গমেজ ও মাতা মাগদালীনা দাগী গমেজ। পিতার নামানুযায়ী বাড়ির নাম ছিলো কান্দুর বাড়ি। পিতা জন কান্দু গমেজের প্রথম স্ত্রী মারা গেলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং এই স্ত্রীর গর্ভে তিনজন সন্তান যোসেফ গমেজ, শিমন গমেজ ও জার্মান গমেজের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে পরবর্তীতে তিনি আবারো বিয়ে করেন। জন কান্দু গমেজের জেষ্ঠ্য সন্তান যোসেফ গমেজ বিদ্যালয়ের তথাকথিত পড়াশুনা করতে না পারলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। সাধু যোসেফ গমেজ যৌবনে পদার্পণ করে ভারতের দিল্লী ও হুগলী জেলায় ব্রিটিশ ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীতে সৈনিকের চাকুরী করেন। এখনো পর্যন্ত সাধু যোসেফ গমেজে’র সৈনিকের পোশাক রক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়। ব্রিটিশ ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানী থেকে ফিরে এসে তিনি পিতার সাথে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। যৌবনাদীপ্ত বয়সে অজানাকে জানার ও অধরাকে ধরার নেশা যেমন মানুষকে প্রতিনিয়ত টানে তেমনি সাধু যোসেফও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। হারবাইদের নন্দীপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ ও সামউদ্দিনের সান্নিধ্যে এসে তিনি কবিরাজী ঔষধের বিদ্যা শিখেন ও তাঁকে ওস্তাদ মান্য করেন। সম্ভবত ওস্তাদের সান্নিধ্যেই সাধু যোসেফ গাঁজার প্রতি আসক্ত হন। এরই মধ্যে বান্দুরার হাসনাবাদ ধর্মপল্লীতে দূঃসম্পর্কের এক ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান এবং সেখানে সাভারের পালং পণ্ডিতের মেয়ে মার্থা রোজারিওকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়। মার্থা রোজারিও হাসনাবাদে অবস্থান করে পড়াশুনা করতেন। পরবর্তীতে সাধু যোসেফ গমেজ মার্থা রোজারিওকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে গাজীপুরের ভাওয়াল থেকে ভাগ্যান্বেষণে খ্রিস্টভক্তদের যে স্রোত তৎকালীন রাজশাহী ও পাবনার দিকে অভিবাসী হিসাবে প্রবাহিত ছিলো তা পরবর্তীতে আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলে। আর তারই ধারাবাহিকতায় বিলু কস্তা (ফাদার সুব্রতর দাদু) পূর্বেই বোর্ণীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। মাউসাইদ ধর্মপল্লীতে থাকাকালীন সাধু যোসেফ গমেজদের প্রতিবেশী ছিলেন বাঁশি শিকারীর (কস্তা গোষ্ঠী) ছেলে এই বিলু কস্তা। আর বিলু কস্তাকে দেখার জন্য সাধু যোসেফ গমেজ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের কয়েক মাস বা বছর পূর্বে বোর্ণীতে আসেন। সাধু যোসেফ গমেজ বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভাওয়াল থেকে ট্রেনে চড়ে যমুনা নদীর পূর্ব পর্যন্ত আসেন; তারপর উত্তাল যমুনা নদী পাড় হন এবং এরপর আবার ট্রেনে চড়ে চাটমোহর স্টেশন। অবশেষে পায়ে হেঁটে বোর্ণী ধর্মপল্লীতে আসেন (উল্লেখ্য যে, যমুনা সেতু তৈরী হওয়ার পূর্বে গাড়িতে যমুনা নদী ফেরীতে পাড়াপার করতে হতো; আর ট্রেনে চড়লে নদীর দুই পাশে দুইবার ট্রেন বদল করতে হতো)। বোর্ণী ধর্মপল্লীতে এসে সাধু যোসেফ গমেজ এই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, বড়ালের স্রোতধারা ও মানুষের সংস্পর্শকে বড় ভালবেসে ফেলেন। জোনাইল ইউনিয়নের ইন্দিরাপাড়া গ্রামের তিন ভাই গোনী মোল্লা, চাঁন্দা মোল্লা ও কোরবান মোল্লার সান্নিধ্যে এসে তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এক সময় তাঁদের জমিও সাধু যোসেফ ক্রয় করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই তিন ভাইয়ের সাথে সাধু যোসেফের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিলো। বনবাদাড় ও হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভরপুর এই এলাকার আকর্ষণে সাধু যোসেফ এখানেই স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সাধু যোসেফের পিতা জন কান্দু গমেজ ছেলের এই আগ্রহে অমত প্রকাশ করলে গোনী মোল্লা হারবাইদে এসে সাধু যোসেফের বাবাকে ধর্মের কাকা ডাকেন এবং আশ্বস্থ করেন যে, যোসেফ বোর্ণীতে ভালো থাকবে। সম্ভবত ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সাধু যোসেফ স্ত্রী এবং তিন সন্তান মনিকা করুনা, আলফ্রেড ও ফিলোমিনা গমেজকে সঙ্গে নিয়ে বোর্ণী গ্রামে এসে বসতি গড়ে তোলেন। বোর্ণীতে আসার পর সাধু যোসেফ পর্যায়ক্রমে তাঁর বাবার নামে জমি-জায়গা ক্রয় করেন। যাতে কেউ কখনো বলতে না পারে যে, সাধু যোসেফ নিজের স্বার্থ দেখেছেন। যেহেতু সাধু যোসেফ গাঁজার প্রতি আসক্ত ছিলেন তাই তাঁকে সংগ্রামপুর গ্রামের গ্যাদার ছেলে আবুলের সাথে চলাফেরা করতে দেখা যেতো ও তার সাথেই গাঁজা সেবন করতেন। এছাড়াও বন্ধুবর হিসাবে বাগবাচ্চা গ্রামের তিতু পালমা ও আদগ্রামের বেলীর বাড়ির পেদ্রু রোজারিও ছিলেন সাধু যোসেফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ইতোমধ্যে সংসারে স্ত্রীর কোল জুড়ে আসে ভালবাসার ফসল। একে একে ৩ মেয়ে ও ৫ ছেলের পিতা হন সাধু যোসেফ।
হঠাৎ একদিন সাধু যোসেফের জীবনে পরিবর্তন আসে। কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আজমীর শরিফে চলে যান। আজমীর শরীফ হচ্ছে সূফী সাধক মঈনউদ্দিন চিশতীর মাজার বা দরগা শরীফ। আজমীর শরিফে ২ বছর অতিবাহিত করার পর গেরুয়া পোশাক পরিহিত সাধু যোসেফ মুখোমণ্ডলে দাঁড়ি-গোফসহ বোর্ণীতে ফিরে আসেন। যার মন-অন্তর বৈরাগ্য জীবনের প্রতি আকৃষ্ট তার কি সংসারে মন টিকে। সাধু যোসেফের জীবনটাও যেন পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাসী ভাবধারায় রত হতে ইচ্ছুক। আবারো পরিবারের সাথে ১ বছর কাঁটানোর পর অনন্তের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সাধু যোসেফের এই নিরুদ্দেশ হওয়ার সময়গুলোতে স্ত্রী মার্থা রোজারিও সন্তানদের নিয়ে বহু কষ্টে দিনযাপন করেছেন। কিন্তু কখনোও স্বামীর ফিরে আসার বিষয়ে সন্দিহান হননি। আবারো আজমীর শরীফে ১ বছর থাকার পর শুধুমাত্র একটি সাদা পোশাক গায়ে জড়িয়ে শূন্য হাতে বাড়িতে স্থিত হন। ধারণা করা হয়, হয়তোবা তিনি এই দুইবারে ৩ বছরের নিরুদ্দেশ যাত্রায় গুরুর কাছে দীক্ষালাভ করেও থাকতে পারেন। পরবর্তীতে সাধু যোসেফ আর কখনো পরিবার ত্যাগ করেননি। কিন্তু তাঁর জীবনে একটি আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আজমীর শরীফ হতে ফিরে আসার পর তিনি কম কথা বলতেন। তাঁকে ধ্যানে অধিক সময় কাঁটাতে দেখা যেতো।
এই সময়ে বোর্ণী ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ছিলেন ইটালীয়ান ফাদার স্বর্গীয় আঞ্জেলো কান্তন, পিমে। ফাদার কান্তন শুধুমাত্র বোর্ণী ধর্মপল্লীর অবকাঠামোগত উন্নয়নই করেননি; সাথে সাথে ধর্মপল্লীর জনগণের মন-অন্তর-আত্মারও উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। আর এর জীবন্ত উদাহরণ হচ্ছেন সাধু যোসেফ। ফাদার কান্তনের সাথে সাধু যোসেফের ভালো সম্পর্ক ছিলো। ফাদার কান্তন সাধু যোসেফের মাঝে একটা সুপ্ত জ্ঞান আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও ফাদার কান্তন জানতেন যে সাধু যোসেফ গাঁজার প্রতি আসক্ত; তবু কখনো কোনদিন তাঁর গাঁজা সেবনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। এক সময় সাধু যোসেফ চোখের চিকিৎসার জন্য রাজশাহী হাসপাতালে ভর্তি হন। ফাদার কান্তন হাসপাতালে সাধু যোসেফকে দেখতে গেলে তাঁকে গাঁজা সেবন অবস্থায় দেখতে পান। এছাড়াও ডাক্তারগণ পরামর্শ দেন যে, গাঁজা সেবন ত্যাগ করতে না পারলে চোখের রোগ সারবে না। ফাদার কান্তন ডাক্তারদের পরামর্শ শুনে সাধু যোসেফর গাঁজা সেবনের ক্ষেত্রে একটি অভিনব পন্থা বেঁধে দেন। ফাদার কান্তনের ভাষ্যনুযায়ী, আমি প্রথমে তাঁকে হঠাৎ করেই গাঁজা থেকে বিরত রাখতে চাইনি। আমি গাঁজা খাওয়ার কোটা বেঁধে দিয়েছিলাম। চার ছিলিম, তিন ছিলিম, দুই ছিলিম; এভাবে কমিয়ে এনেছিলাম। এভাবে ধীরে ধীরে সে গাঁজা খাওয়া কমিয়েছিলো।
সাধু যোসেফ যেহেতু গাছ-গাছড়া ও কবিরাজীর কাজ করতেন তাই তাঁকে এলাকার সবাই চিনতো। কবিরাজী হিসাবে নামও কামিয়েছিলেন বেশ। পানি পড়া ও গাছ-গাছড়ার ঔষধে তিনি কঠিন রোগও সারিয়ে তুলতে পারতেন। একবার স্বর্গীয় আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও সাধু যোসেফকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা তুমি যে পানি পড়া দাও এটাতো কাথলিক ধর্মবিরোধী কাজ। উত্তরে সাধু বলেছিলেন, আমি এক প্রভুর প্রার্থনা ও এক প্রণাম মারীয়া বলে পানি পড়ে দিই, এতে রোগী ভালো হয়ে যায় তাতে আমার কি। কথিত রয়েছে যে, একবার ফাদার কান্তনের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীতে মারাত্মক ক্ষত বা ঘা হয়। কোন চিকিৎসকই ফাদারকে সুস্থ করতে পারছিলো না। ফাদার কান্তনের পায়ের ক্ষত এমন এক পর্যায়ে পৌঁচ্ছায় যে তাঁর পা কাঁটার উপক্রম হয়েছিলো। আর তাই ফাদার কান্তন নিজ দেশ ইটালীতে যাবার মনস্থির করেন। এই সময় সাধু যোসেফ ফাদার কান্তনকে ভরসা দিয়ে নিজে ফাদারের চিকিৎসা করার বাসনা ব্যক্ত করেন। ফাদার কান্তনও সাধু যোসেফকে অনুমতি দেন। আর এমনই আশ্চর্য যে, সাধু যোসেফের গাছ-গাছাড়ী ও কবিরাজী চিকিৎসায় ফাদার কান্তনের পায়ের ক্ষত একদম সেরে যায়। ফাদার কান্তনও সাধু যোসেফকে পুরস্কারস্বরূপ ‘সাধু’ নামে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকেই যোসেফ গমেজকে জনসাধারণ সাধু নামে ডাকা শুরু করে। সাধু যোসেফও ফাদার কান্তনকে গুরু বলে মানতেন। সাধু যোসেফ প্রায় সময়ই মিশনে পড়ে থাকতেন। মিশনের নানাবিধ কাজের পাশাপাশি তিনি মিশন প্রাঙ্গণে বহু গাছ নিজ হাতে লাগিয়ে তা যত্নও করতেন। গীর্জার বড়গেট দিয়ে ঢুকতেই বাম পাশে যে কাঁঠালগাছগুলো ছিলো তা সাধু যোসেফের হাতে লাগানো। ফাদার কান্তনের একটা ধারণা ছিলো যে, সাধু যোসেফ গাছ ভালো রোপণ করতে পারেন। বিশেষভাবে বনপাড়া ও বলদীপুকুর ধর্মপল্লীতে ফাদার কান্তন পাল-পুরোহিতের দায়িত্বে থাকাকালীন সাধু যোসেফের হাতে লাগানো বহু গাছ রয়েছে। বোর্ণী ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার কান্তনই প্রথম এই এলাকায় জমিচাষের ট্রাক্টর নিয়ে আসেন। সাধু যোসেফ এক সময় ফাদার কান্তনের এই টাক্টর চালাতেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে পিটার ড্রাইভারও (বাগবাচ্চা) মিশনের এই টাক্টর চালিয়েছেন।
জোনাইল পাগলাবাজারের গা ঘেঁষে ঠিক দক্ষিণপার্শে যে হিন্দু পাড়াটি রয়েছে তা মাঝিপাড়া নামে প্রচলিত ছিলো। এখনো মাঝে মাঝে লোকের মুখে শোনা যায় নামটি; যদিও পারবোর্ণী নামই এখন প্রচলিত। এই গ্রামেরই অনন্ত মাঝি নামে একজন বড়াল নদীতে ব্রিজ হওয়ার পূর্বে নৌকায় লোকজনকে পারাপারে সাহায্য করতেন। এছাড়াও এই গ্রামের আরো কয়েকজন মাঝির কাজ করতো। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনন্ত মাঝিকে পাকিস্তানী মিলিটারীরা হত্যা করে। এই মাঝিপাড়া গ্রামে বৈরাগী নামে একজন সন্ন্যাসধর্ম পালন করতেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ভিক্ষা করে যা পেতেন তাই দিয়ে তাঁদের দিন চলতো। বৈরাগী তাঁর ভিক্ষার ঝোলা, চাঁদ-তারার ছবি ও একটি ত্রিশূল সাধু যোসেফকে ভালবেসে দিয়েছিলেন। ফাদার আঞ্জেলো কান্তন সাধু যোসেফের নিকটে এগুলো দেখে নিয়ে যান এবং কথিত রয়েছে যে, এই তিনটি জিনিষ তিনি নিজ দেশের জাদুঘরে রেখেছেন। সাধু যোসেফের মধ্যে দেশপ্রেম ছিলো অত্যন্ত গভীর। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণ তিনি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে দেখেছেন।
সাধু যোসেফের মধ্যে মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা ফুটে ওঠেছিলো। তিনি সব সময় বলতেন, পৃথিবীতে দুটি জাত- একটি হচ্ছে নারী ও আরেকটি হচ্ছে পুরুষ। প্রকৃতির মধ্যেও আমরা তাই দেখি। বিশেষভাবে গাছের উদাহরণ টেনে তিনি বলতেন, তাল গাছের দিকে দেখ। ওদের মধ্যেও নারী এবং পুরুষ রয়েছে। আজমীর শরীফ থেকে ফিরে আসার সময় সাধু যোসেফ যে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন পরবর্তীতে সে সাদা পোশাক পড়া তিনি পরিত্যাগ করেননি। সাধু যোসেফ ছিলেন একজন প্রার্থনাশীল মানুষ। প্রার্থনা ছাড়া পরিবারের কাউকে তিনি রাতের খাবার খেতে দিতেন না। সাধু যোসেফ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা রাতে না ঘুমিয়ে প্রার্থনা করতেন বলে জানা যায়। এছাড়াও শনি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার রাতে যোগ সাধনায় বসতেন। প্রচলিত রয়েছে যে, সাধু যোসেফ অনেক ঘটনা না দেখে ও না জেনে বলে দিতে পারতেন। কথিত রয়েছে, নিজ নাতির কৈশোরে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী তিনি বহু পূর্বেই করে গিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি কবিরাজ ছিলেন তাই শনি ও মঙ্গলবার রোগীর চিকিৎসা করতেন দুপুর পর্যন্ত উপবাস থেকে। সাধু যোসেফ যে একজন সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায়ই বলতেন, সব ধর্মকে বিশ্বাস কর; কিন্তু পালন কর নিজের ধর্ম। জীবনের একটি সময়ে ভারতের আজমীর শরীফে ৩ বছর অবস্থান এবং নিজ এলাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নানা পূজা-পার্বণে সাধু যোসেফের উপস্থিতি সেই অসাম্প্রদায়িকতাকেই প্রকাশ করে। সাধু প্রতিদিনকার জীবনে কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ পেলে তা গ্রহণ করতেন এবং বিয়ে বাড়িতে যেতেন কিন্তু কখনো খাওয়া দাওয়া করতেন না। বিশেষভাবে বোর্ণী গ্রামের বিলুর বাড়ি ও পারবোর্ণী গ্রামের বৈরাগী বাড়িতেই শুধুমাত্র আহার গ্রহণ করতেন আর কোন বাড়িতে আহার করতেন না। এটা তাঁর আত্মঅহংকারের পরিচয় নয়; বরং নিজের কৃচ্ছতা ও নিজের প্রতি নিজের নিষ্ঠতারই পরিচায়ক। এছাড়াও সাধু যোসেফ মদ, গরু ও শুকরের মাংস গ্রহণ থেকে সব সময় বিরত ছিলেন। তিনি প্রতিদিন ভোরের খ্রিস্টযাগে যোগদান করে ফাদারের আশীর্বাদ গ্রহণ করতেন। প্রতি বছর পুণ্য বৃহস্পতিবারে যিশুর শিষ্যদের পা ধুয়ে দেওয়া স্মরণ করে ফাদার সাধু যোসেফের পা ধৌত করে দিতেন। তিনি অত্যন্ত ভক্তিসহকারে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। অনেক হিন্দু ও মুসলিমদের সাথে সাধুর সখ্যতা ছিলো। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই সখ্যতা তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছে। এছাড়াও মৃত্যুর পর সাধু যোসেফের শ্রাদ্ধ্যের অনুষ্ঠানে সব ধর্মের লোকজনই উপস্থিত ছিলেন। যদিও সাধু যোসেফের একটু রাগ ছিলো বেশী কিন্তু কখনো তিনি অন্যের প্রতি বিচারের ভাব পোষণ করেননি। বরং তিনি সব সময় যিশু গুরুর ক্ষমার শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। সাধু যোসেফ সব ধর্মে বিশ্বাস করতেন কিন্তু অনুশীলন করতেন খ্রিস্টধর্ম। তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেতো, ধর্ম হচ্ছে আত্মবিশ্বাস; তাই পালন কর নিজ ধর্ম কিন্তু বিশ্বাস কর সব ধর্মে। বহু অভিজ্ঞতায় ভরপুর অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী এ ধ্যানী, সৌম্য চেহারার শ্মশ্রুমণ্ডিত সাধু পুরুষ যোসেফ গমেজ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারী বার্ধক্যজনিত কারণে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এরই ঠিক ৪ বছর পর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সাধু যোসেফ গমেজের স্ত্রী মার্থা রোজারিও ইহলোক ত্যাগ করেন।
বোর্ণী মায়ের আঁচল আশীর্বাদে ভরপুর। বহু বিজ্ঞজনের জন্ম হয়েছে বোর্ণীর বুকে। আমরা এই সময়ের বোর্ণী মায়ের সন্তানরা বোর্ণীর বহু জ্ঞানী-গুণীজনকে দেখিনি। তাঁদের অবদান ও ত্যাগস্বীকার গল্পাকারে শুনেছি। আবার অনেককে দেখে থাকলেও অজান্তে তাঁদের অবদানকে নিয়ে হয়তো সেভাবে ভাবিনি বা স্মৃতির মণিকোঠা থেকে আলগোছে তাঁদের তুলে রেখেছি। তবে আমরা ভুলে গেলেও পরিবার, সমাজ, ধর্মপল্লী, ধর্মপ্রদেশ, দেশ তথা বিশ্বমণ্ডলির জন্য তাঁদের যে স্বতন্ত্র অবদান তা কখনো হারাবে না। ভাবতে অবাক লাগে, শত দারিদ্র্যতার মাঝেও তাঁরা নিজেদের খ্রিস্টীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও শিক্ষা অটুট রেখেছিলেন। বোর্ণী মায়ের আঁচল পূর্ণ করতে প্রত্যেক জ্ঞানী-গুণীজনদের অবদান আলাদাভাবে প্রশংসনীয় ও স্মৃতিতে ভাস্বর। সাধু যোসেফ গমেজও তাঁদের ভীড়ে এমনই একজন। বহু গুণে গুণান্নীত যোসেফ গমেজ বোর্ণীর রূপকার স্বর্গীয় ফাদার আঞ্জেলো কান্তন ও মানুষের ভালবাসায় এক সময় হয়ে ওঠেছেন সাধু পুরুষ। এই প্রজন্মের কাছে তিনি একজন সিদ্ধপুরুষ; যিনি কিনা প্রতিনিয়ত মহাসাধু ঈশ্বরের সন্ধানেই জীবন কাঁটিয়েছেন। সাধু যোসেফের এই মহাসাধু ঈশ্বরের সন্ধান যেন লালন ফকিরের সাধু দর্শনের আকাঙ্খার মতোই-
‘আর কি আমার সাধু দর্শন হবে
হে করুণার সিন্ধু দিনো বন্ধু
কবে পরান বিন্দু দেবে।
সাধুর ও বাগানে কি আনন্দময়
আনন্দে ভাসিছে এ পাপ হৃদয়
সাধুর দর্শনে পরশনে পশুর জনম কেটে যাবে’।
তথ্যসূত্র
– সাধু যোসেফের চতুর্থ ছেলে পিউস গমেজের সাক্ষাৎকার, কালাচাঁদপুর, নর্দা, ঢাকা।