জন-জীবনের কথা ফাদার সাগর কোড়াইয়া
সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার কাহিনী যেন বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তব হয়ে উঠছে। সিনেমায় দেখানো হয়েছে হীরক রাজা রাজসভাতে শিক্ষামন্ত্রীকে বলছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী আজ থেকে বন্ধ পাঠশালা। এরা যত বেশী পড়ে ততবেশী জানে আর তত কম মানে’। মনে হচ্ছে যেন আমাদের দেশও ঠিক একইভাবে হিরক রাজার দেশের মতো হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবাই জানে করোনার ভয়াবহতার কথা। তাই বলে কি অন্যান্য দেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছে! আমার তো মনে হয় না। হাসির বিষয়- করোনায় অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট চলছে স্বাভাবিক নিয়মেই। অনেকে আবার সরকারি বিধি-নিষেধ না মানাটাকেই অভ্যাসে পরিণত করেছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা সঙ্গীণ! আরো সঙ্গীণ শিক্ষার্থীরা। করোনা ভাইরাসের ব্যাপকতা আটকাতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।
সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও এখন আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। করোনায় আক্রান্ত না হয়েও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মারাত্মকভাবে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থেকে হতাশা ও একঘেঁয়েমিতে ভুগছে। অনিশ্চয়তায় পড়েছে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। আটকে আছে সকল প্রকার শিক্ষা কার্যক্রম ও পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গন থেকে আহরিত জ্ঞানে ছেদ পড়েছে কল্পনাতীত। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে না পেরে নিজেদের শিক্ষার্থী ভাবতেই ভুলে যাচ্ছে। অনেক পিতা-মাতা হয়তো বাড়িতেই শিক্ষা প্রদান করছেন; কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সম্পর্কের অদৃশ্য মেলবন্ধন গড়ে উঠে তার বিপরীতে সেখানে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে স্কুল-কলেজের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ আর নেই। ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশাল চত্বরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে না পেরে হয়ে পড়ছে স্থবির। তাদের জীবন ধারায় যোগ হচ্ছে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক বিভিন্ন কার্যক্রম। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার মতোই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, করোনা শুধুমাত্র বুঝি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হামলা করবে!
গত বছর অনলাইন ক্লাসের তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো। পিতা-মাতা, অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইস কিনে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগে। মাঝখান থেকে লাভবান হয় ব্যবসায়ীরা। স্মার্টফোন, ল্যাপটপের দাম দেয় বাড়িয়ে। যাদের এই ডিভাইসগুলো ক্রয় করার সামর্থ নেই তারাও ঋণ করে হলেও সন্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষার কথা চিন্তা করে ক্রয় করে দেয়। তবে সারা বছর ধরে ঋণের বোঝা বইতে হয়। অনলাইন ক্লাস ব্যবস্থা শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য সুফল বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের সুবিধা খুব কমই ভোগ করেছে। শহরের আনাচে-কানাচে ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। যদিও বলা হয় ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়- দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে কিন্তু কার্যত সেটা যেন কথার কথাতেই সীমাবদ্ধ। কারণ গ্রামাঞ্চলে অনেক স্থানই আছে যেখানে কোন ইন্টারনেট সুবিধা নেই।
করোনার প্রকোপতা শহরের দিকেই প্রভাব বিস্তার করেছে। গ্রামের চিত্র ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। করোনা গ্রামাঞ্চলে এসেছে বলে খুব কমই শোনা গিয়েছে। অবাক করার বিষয়- দেশের গ্রাম ও শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেওয়া হয়। যেহেতু গ্রামে করোনার চিত্র নেই তাই গ্রামের স্কুলগুলো খোলা রেখে বরং শহরের স্কুলগুলোতে অনলাইনে ক্লাস নিলেই বরং ভালো হতো। এখন বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ; কবে আবার চালু হবে বলা যাচ্ছে না। যদিওবা একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে; তাও ঐ তারিখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা সন্দেহ!
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থাও একই। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা ভিন্ন। মাস শেষে তারা ঠিকই বেতন পাচ্ছেন। তবে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থা করুণ। গণমাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে, শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। আবার অনেকেই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সরকারি প্রণোদনা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ঠিকই বরাদ্দ ছিলো কিন্তু যারা শিক্ষার আলো বিতরণ করেন তারাই আজ বঞ্চিত। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার রাজার মগজ ধোলাই ‘লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই/জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই/বিদ্যালাভে লোকশান, নাই অর্থ নাই মান/হিরক রাজা বুদ্ধিমান, করো সবে তার জয়গান’।
‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় শিক্ষামন্ত্রী আর রাজপণ্ডিতের ভাষ্যটাই বুঝি আজ সত্য, ‘যাও আজ থেকে ছুটি, আর পাঠশালা নাই’। এক সময় আমরা স্কুলের বাৎসরিক ছুটির অপেক্ষায় থাকতাম। আর কোন দিন যদি কারণবশত স্কুল ছুটি থাকতো আনন্দের আর সীমা থাকতো না। কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সিনেমায় সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায়ের সেই উক্তিই আজ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য উপদেশ, ‘তোমরা তো শুনলে, আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ। তোমরা খেলাধুলা করো, কারো অনিষ্ট করো না, মনে জোর রেখো। আর এটা মনে রেখো যে, পাঠশালা একদিন খুলবে’। ভারতীয় সংগীত শিল্পী নচিকেতার গানের সুরে বলা যায়, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’।