ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক
ভূমিকা : প্রতিবারের মতো ২০২১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী ডাইয়োসিসের বিভিন্ন ধর্মপল্লী, সংগঠন এবং গ্রাম থেকে বড়দিন উপলক্ষে সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। কিছু সাময়িকী ইতিমধ্যেই বরেন্দ্রদূত দপ্তরে এসে পৌঁছেছে। এবারই সম্ভবত প্রথম খ্রিস্টজ্যোতি মিডিয়া সেন্টার এসব সাময়িকী নিয়ে পর্যালোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। আজকে এই পর্যালোচনার ৮ম ও শেষ পর্ব তুলে ধরা হলো।
রাজশাহী সিটিতে অবস্থিত সাধু পিতর সেমিনারি থেকে এ নিয়ে পর পর দুই বছর প্রকাশিত হলো ‘প্রস্তর’। মথি রচিত মঙ্গলসমাচারে (১৬:১৮) যিশু বলছেন, “আর আমি তোমাকে বলছি, তুমি তো পিতর (অর্থাৎ পাথর) আর এই পাথরের ওপর আমি আমার মণ্ডলি গড়ে তুলব”। একটি সেমিনারির মুখোপত্র হিসেবে পত্রিকার নামকরণ সার্থক হয়েছে। পত্রিকাটি বড়দিন উপলক্ষে প্রকাশিত হলেও প্রচ্ছদে বড়দিনের কোনো ছাপ নেই। আসলে প্রথম বর্ষ আর দ্বিতীয় বর্ষের প্রচ্ছদের মধ্যেও খুব তফাৎ নেই। একই ভবন দুই সংখ্যায় দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয় সংখ্যার লগো’র বিষয়ে বলা হয়েছে, “গির্জা ঘরের ভিতরে থাকা পাথরের অর্থ হলো আমরা সবাই বিশ্বাসে এক এবং পাথরের নিচে থাকা শিকড় আমাদের শক্তিশালী খ্রিস্টবিশ্বাসের গভীরতাকে নির্দেশ করে”। কিন্তু আসলে লগোতে চারা গাছের শিকড় পাথরের ওপরে দেখানো হয়েছে। অর্থ তেমন পরিস্কার নয়। পত্রিকাটি উৎসর্গ করা হয়েছে রাজশাহী ডাইয়োসিসের স্বর্গীয় যাজকদের উদ্দেশ্যে। তাদের চিরশান্তি কামনা করি।
প্রথমেই রয়েছে এই প্রতিবেদকের লেখা, “যুগ লক্ষণ আহ্বানে বড়দিন উৎসব।” বড়দিন লোক দেখানো কোনো উৎসব নয়, কিন্তু লোকদের নিয়ে উৎসব। প্রকৃতিকে ধ্বংস বা বাদ দিয়ে নয়- কিন্তু প্রকৃতিকে নিয়ে প্রকৃতির মধ্যে বড়দিন উৎসব। এটা যুগের দাবি। যুগ লক্ষণ বিশ্লেষণ করেই বড়দিন পালিত হোক। ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন লিখেছেন, “বড়দিনের আনন্দ-উৎসব: বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি” শিরোনাম দিয়ে। বড়দিন উদযাপনে বাহ্যিক প্রস্তুতি অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সেই বাহ্যিক প্রস্তুতির উদ্দেশ্য হ’তে হবে আধ্যাত্মিক পথে যাত্রা। ফাদার শিশির নাতালে গ্রেগরী লিখেছেন, “সেমিনারিয়ানদের গঠনে মূল্যবোধের বিকাশ” শিরোনামে। প্রস্তর, যেহেতু একটি সেমিনারির মুখোপত্র, তাই লেখাটি প্রাসঙ্গিক হয়েছে। সেমিনারিয়ানদের গঠনের দিকগুলো লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় একই প্রসঙ্গ নিয়ে ফাদার দিলীপ এস. কস্তা লিখেছেন, “যাজকীয় জীবন গঠন : একটি যাত্রা।” বাইবেলে যাজকাহ্বান থেকে শুরু করে সন্ন্যাস ও মঠবাসীদের জীবনসহ অনেক অজানা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। লেখায় শেখার বিষয়বস্তু অনেক। ফাদার উইলিয়াম মুরমু লিখেছেন, “কৃতজ্ঞতা: ঐশতাত্ত্বিক অনুধ্যান ও মাণ্ডলিক শিক্ষা” বিষয় নিয়ে। আমরা কতোনা ভাবেই ঈশ্বরের কাছ থেকে অনুগ্রহ লাভ করে থাকি- কিন্তু আমরা কী তার জন্য কৃতজ্ঞ? রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে গত পালকীয় কর্মশালার মূল বিষয় ছিলো , “কৃতজ্ঞ হও।” সবকিছুর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ দিতে হয়, ঈশ্বরকে, প্রকৃতিকে এবং মানুষকে। “নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্র গঠন” এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন, সুক্লেশ জর্জ কস্তা। চরিত্র মানুষের প্রকৃত পরিচয়। চরিত্র ভালো হোক আর মন্দ হোক, এই পরিচয় মানুষ বহন করে জীবন ধরে। তাই চরিত্র গঠন জীবনের প্রাথমিক কাজ। মানুষের চরিত্র গঠনে সহায়ক দিকগুলো লেখক বেশ গুছিয়ে উল্লেখ করেছেন। “ব্যক্তিত্বের বিকাশ” নিয়ে ছোট পরিসরে লিখেছেন, সিস্টার রোজমেরী সাহা ও.এস.এল.। লেখা ছোটো হলেও সুন্দর হয়েছে। ফাদার সাগর কোড়াইয়া লিখেছেন, “মানুষের জয় হোক” প্রসঙ্গ নিয়ে। লেখক অনেক কিছু বলার ইংগীত দিয়েছেন কিন্তু প্রধান বিষয় কোনটি, সেটার ওপর জোর দিলে পাঠকদের সুবিধা হতো। আদিকাল কিন্তু আদিকালেই ভালো ছিলো- এখন কেউ কেউ বললেও কেউ ফিরে যেতে চাইবেন না। সভ্যতা এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকার বিষয় নয়।
যেহেতু পত্রিকাটি গঠনগৃহের- তাই স্বাভাবিকভাবেই গৃহের প্রার্থীদের কিছু লেখা থাকবে। “একতা আনে সফলতা” লিখেছে আইনালিউস হাঁসদা। “অলসতা থেকে আধুনিক সভ্যতা” শিরোনামে লিখেছে, স্টিফের ভুবন কোড়াইয়া। অমিত যোহন কস্তা লিখেছে, “পরিবারে ভালোবাসার আনন্দ” ও “Circle of Influence & Circle of Concern” নিয়ে। যাকোব বেনেডিক্ট তুষার বিশ্বাস লিখেছে, আত্ম-সমালোচনাই আত্মশুদ্ধির উপায়” প্রসঙ্গ নিয়ে। “যুবাদের পথ প্রদর্শক সাধু আলুইসিউস গঞ্জাগা” শিরোনামে লিখেছে, পাইলট পলিকার্প হেমব্রম। “পানি অমূল্য সঞ্চয়” ও “ঈশ্বরের ফোন নম্বর” বিষয় নিয়ে দু’টি লেখা লিখেছে, ডেভিড সরেন। লেখা দুটির মধ্যে আলাদা রকমের সৃজনশীলতা লক্ষ্য করা গেছে। “Love: The Fullness of Christian Life” প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছে, মাখন মাথিয়াস এক্কা। সবশেষে রয়েছে কিছু কবিতা। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখ করার মতো হলো, ”যীশু বাউলের কবিতা”। দক্ষিণ ভিকারিয়ার প্রায় সবগুলো পত্রিকাতেই এই যীশু বাউলের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে।
উপসংহার : একটি গঠনগৃহের পত্রিকা হিসেবে, অনেকেই গঠন নিয়ে লিখেছেন- যা পত্রিকার জন্য প্রাসঙ্গিক। সেমিনারিয়ানদের লেখাগুলোও যথেষ্ঠ গুণসম্পন্ন হয়েছে। তাদের মধ্যেকার এই সৃজনশীলতা অবশ্যই লালন করতে হবে। পত্রিকায় প্রমিত বাংলা পুরোপুরিভাবে মেনে চলা হয়। গোলমেলে ও ভুল বানান নেই বললেই চলে।
এই ৮ম পর্ব পর্যালোচনার মধ্যদিয়েই শেষ হলো, “বড়দিন- ২০২১ খ্রিস্টাব্দের সাময়িকী পর্যালোচনা।” এগুলোতে পর্যালোচক তার একেবারে নিজের মথামত ব্যক্ত করেছেন। মতামতে ভুল ব্যাখ্যা মনে হতেও পারে- তবে তা পর্যালোচকের নিজের অভিমত। আগামীতে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ‘মধ্য’ এবং ‘উত্তর ভিকারিয়া’ থেকে বড়দিন সাময়িকী দেখার আশা রইলো। লেখক ও পাঠকদের শুভেচ্ছা।