ফাদার সাগর কোড়াইয়া
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমাদের বাড়িতে প্রথম টেপরেকর্ডার আনা হয়। মনে পড়ে- মধ্যরাতে বাবা ঢাকা থেকে টেপরেকর্ডারটি এনেছিলেন। বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলো না সে সময়। তৎকালীন হক্ ব্যাটারী দিয়ে টেপরেকর্ডার চালানো হয়। আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। বাবা ব্যাটারী সংযোগ দিয়ে টেপরেকর্ডারটি চালু করেন। সে সময়ই প্রথম ক্যাসেট প্লেয়ার দেখা। রাতের আঁধার ভেদ করে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে গান বেজে ওঠে। বিছানায় শুয়ে থেকে গানটি শুনতে থাকি; “আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন…”। সে সময় জানতাম না শিল্পীর নাম। অনেক পরে জানতে পারি গানটি উপমহাদেশের সুরের সাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া। বড় হবার সাথে সাথে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের ক্লাসিক্যাল আধুনিক, রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত শুনেই সময় কেঁটেছে। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া অধিকাংশ গানের সাথে সে সময় থেকেই পরিচয়। কোন একটি নির্দিষ্ট গানের কথা বললে অবিচারই করা হবে। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া সব গানের মধ্যেই একটা আলাদা আবেদন রয়েছে। কণ্ঠের যাদুতে তিনি বিমোহিত করতে পারতেন সব শ্রেণীর মানুষকে।
সত্যি বলতে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনেছি তবে তার কোন ছবি তখনো পর্যন্ত দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে উনার একটি কাল্পনিক চিত্র ঠিকই মনের মধ্যে গেঁথে ছিলো। কণ্ঠের মাধুর্য্যে মনে হতো বিশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী কোন মেয়ের গাওয়া গান হবে হয়তোবা। আর লতা মঙ্গেশকরকে অল্প বয়সী বলেই মনে হতো আমার। পরবর্তীতে ছবি দেখার পর সে ভুল ভাঙ্গে। তখনই তার বয়স প্রায় সত্তর বয়সের কাছাকাছি হবে। তিনি যেমন তার গানের মধ্যে প্রেমকে নতুন মার্গ দিয়েছেন; তেমনি ধর্মীয় গানের মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন আধ্যাত্মিক এক পরম জগত। বিশেষ করে হিন্দি ভাষায় খ্রিস্টীয় সংগীতে তার অবদান অনস্বীকার্য। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি খ্রিস্টের মঙ্গলসমাচার গানের মাধ্যমে প্রচার করেছেন। “যিশু নাম সবচেয়ে মহান” গানটি এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উপমহাদেশের সুরের সাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাইয়ে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
লতা মঙ্গেশকরকে সন্মানসূচক লতাজি বলেই সন্মোধন করা হতো। কণ্ঠ এবং সুরের সাধনাই তাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং কর্মে নিষ্ঠাবান। করোনা ও নিয়মোনিয়াম আক্রান্ত হয়ে লতাজি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি থাকাকালীন তার ভাতিজি জানান, ‘লতাজি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন এবং তার পরিস্থিতি একদম স্থিতিশীল। ভগবান সত্যি দয়ালু। লতাজি একজন লড়াকু মানুষ, উনি জিততে জানেন এবং এতো বছর ধরে সেভাবেই ওনাকে আমরা চিনে এসেছি। সবার প্রার্থনা সঙ্গে থাকলে, কিছুই খারাপ হবে না এটা আমাদের বিশ্বাস’ (বিশেষ দ্রষ্টব্য: হিন্দুস্থান টাইমস্ বাংলা)। লতাজি সুস্থ্যও হয়ে উঠেছিলেন। তবে অসুস্থ্যতায় শারীরিক অবনতি হওয়ায় দেহত্যাগ করেছেন। লতাজির কণ্ঠের জাদু স্বয়ং ঈশ্বর প্রদত্ত। তিনি এক হাজারেরও বেশী ভারতীয় সিনেমায় গান গেয়েছেন। এছাড়াও ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষা ও বিদেশী ভাষায় গান গাওয়ারও রেকর্ড করেছেন তিনি। অসংখ্য সন্মাননা ও পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু লতাজির পুরুষ্কার ও সন্মাননা কখনো তাকে অহংকারী করে তুলেনি। বরং নম্রতা ও অন্যকে সন্মান কিভাবে দিতে হয় সে উদাহরণ উনার জীবনে বহুবার দেখা গিয়েছে।
লতাজি বাঙ্গালী ছিলেন না তবে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়েছিলেন। বাংলার সঙ্গে তার ছিলো আত্মিক সম্পর্ক। তাই বাংলা শিখবেন বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন। তবে দায়সারাভাবে নয় বরং রীতিমতো লিখতে ও পড়তে যাতে পারেন সেই চেষ্টা করেছিলেন। আসলে বাংলা ভাষার প্রতি লতাজির আলাদা একটা টান ছিলো। যেটা বাঙ্গালী গীতিকার ও সুরকারদের সাথে কাজের ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হিসাবে কাজ করতো। লতাজির অসীম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন বিখ্যাত বাঙ্গালী সুরকার সলীল চৌধুরী। লতাজি সব সময়ই বলতেন, সলিল চৌধুরী বিরলতম প্রতিভা। সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর মতো সুরকারদের সঙ্গে তার কণ্ঠের জাদু দিয়ে রচিত গানগুলি বাঙ্গালীর অনন্য সম্পদ। লতাজির কণ্ঠে সুমধুর গান “প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে” গানের মাধ্যমে বাংলা গানে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর প্রতিটি বাংলা গানই লতাজিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। উনার কণ্ঠে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ ‘না যেও না রজনী এখনো বাকি’ ‘ওগো আর কিছু তো নয়’ ‘আকাশ প্রদীপ জ¦লে’ ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’ ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’ ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’ ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন’সহ আরো বহু জনপ্রিয় গানের মাঝে লতাজি বেঁচে থাকবেন।
‘মঙ্গল দ্বীপ জে¦লে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু’ গানটি অনেক শিল্পী অনেকভাবেই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে লতাজির কণ্ঠে গানটি অনন্য রূপ লাভ করেছে। যদিও গানটি ভারতীয় ‘প্রতিদান’ সিনেমার; তবুও গানটিতে স্বর্গীয় ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে শুধুমাত্র লতাজির কণ্ঠের মধ্য দিয়ে। গানটি বাংলাদেশের খ্রিস্টীয় উপাসনায়ও ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অনেক অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন বা উদ্বোধনী নৃত্যে গানটি ব্যবহৃত হয় বহুলাংশে। সুরের সাম্রাজ্ঞী লতাজির কণ্ঠে অন্যের মঙ্গলে প্রভুর প্রতি কাতর মিনতি এই পৃথিবীতে আর কখনো শোনা যাবে না। তিনি সঙ্গীতের যে মঙ্গল দ্বীপ পৃথিবীতে জ¦ালিয়ে দিয়েছেন তার শিখা আজীবন থাকবে। অন্যদিকে লতাজি স্বর্গীয় পিতার গৃহে মঙ্গল দ্বীপ হয়ে আজীবন জ্বলতে থাকবেন আর পৃথিবীর মানুষের নিমিত্তে প্রভুর নিকট আকুল কণ্ঠে ব্যাকুল চিত্তে গাইবেন, “মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু”।