গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, রোজ শুক্রবার, প্রয়াত ফা: কর্ণেলিউস মুরমু’র শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান তাঁর নিজ গ্রাম দিবস্থলীতে পারিবারিক উদ্যোগে উদযাপন করা হয় । সান্তালী সমাজের রীতি অনুসারে প্রতিটি সান্তাল খ্রিস্টভক্তের মৃত্যুর পর পারিবারিকভাবে এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানটিকে সান্তালী ভাষায় ভান্ডান নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ উক্ত অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে একজন সান্তাল আদিবাসীকে স্বর্গবাসী হবার জন্যে সামাজিক ও পারিবারিক সকল জাগতিক বাধা থেকে মুক্তি লাভের জন্যে সম্মিলিত ভাবে প্রার্থনা করা হয়।

এই ভান্ডান অনুষ্ঠানের খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরহিত্য করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তার সহার্পিত খ্রিস্টযাগে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে কর্মরত বিভিন্ন ধর্মপল্লী ও প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯ জন ফাদার, ১০ জন সিস্টার এবং ১৫০০ মত খ্রিস্টভক্ত উপস্থিত ছিলেন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের খ্রিস্টযাগে বিশপ মহোদয় তার উপদেশে বলেন- মৃত্যু হলো নব জন্ম লাভের একটি মাধ্যম বা পথ। আজকের মঙ্গল সমাচারে আমরা লক্ষ্য করি যে, যিশু মৃত লাজারকে ভালবেসে নতুন জীবন অর্থাৎ পুনরুত্থিত জীবন দান করলেন। আমরা যারা এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি; আমাদের প্রত্যেককেই একদিন মরতে হবে। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য যে, সেই মৃত্যু আমরা কেউ চাই না। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারপরেও কি আমরা বেঁচে থাকতে পারব! হ্যাঁ, মৃত্যু আমাদের অবশ্যই হবে। এ মৃত্যু থেকে একমাত্র খ্রিস্টই আমাদেরকে নতুন জীবন দান করবেন। তাই খ্রিস্টীয় জীবনে মৃত্যুকে নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই। কেননা, মৃত্যু হচ্ছে অনন্ত জীবন লাভের একটি প্রবেশদ্বার। যিশু আমাদের সেই স্বর্গীয় জীবন দান করার জন্যই এ পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই, আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত সেই লাজারের বোনদের মতো , প্রভু আপনি যদি এখানে থাকতেন তাহলে আমাদের ভাই মারা যেত না। অর্থাৎ যিশুর উপস্থিতিতে আমরা কেবল বেঁচে থাকতে পারি। তাই সাধু পলের ভাষায় বলা যায়, আমরা যদি প্রভুতে বিশ্বাস রাখি; তাহলে আমরা বাঁচি বা মরি যেই অবস্থাতেই থাকিনা কেন আমরা প্রভুরই। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ফা: কর্ণেলিউস মুরমুও তাঁর সেই বিশ্বাসের দ্বারা আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছে।

খ্রিস্টযাগের শেষ আশির্বাদের পরপরই বিশপ মহোদয়সহ উপস্থিত সকল ফাদারগণ একসঙ্গে ফা: কর্ণেলিউসের কবরের কাছে যান এবং তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেন এবং পরে তার কবরের উপর প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন। অত:পর তাঁর পরিবার, বন্ধুমহল এবং কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ফা: কর্ণেলিউসের স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর বড় ভাই শ্রদ্ধেয় মজেস মুরমু বলেন- কর্ণেলিউস একজন সদানন্দপ্রিয়, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিল। ফা: বাবলু কোড়াইয়া তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন- ফা: কর্ণেলিউস ছিলেন একজন সহজ-সরল ও আনন্দ প্রিয় মানুষ। তিনি সর্বদা তাঁর নম্রতা ও হাস্যোজ্জ্বল মন নিয়ে আমাকে মিতা বলে ডাকতেন। আর আমাদের এই মিতালির শুরু হয়েছিল ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের পোস্ট মেট্রিক কোর্স থেকে। সে থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত আমরা একে অপরকে মিতা বলেই সম্বোধন করেছি। সে একজন উদ্যমী মানুষ ছিল। খেলাধুলা, গান-বাজনা ছিল তাঁর নিত্যদিনের করণীয় কাজেরই একেকটি অংশ। তাই তাঁকে দেখেছি তার সমাজ, জাতি-গোষ্ঠী ও তাঁর কৃষ্টি সংস্কৃতিকে নিয়ে ভাবতে এবং তাঁর উন্নতি সাধনে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে। সর্বোপরি তাঁকে বলতে পারি, সে ছিল একজন প্রার্থনাশীল ও সাদা মনের মানুষ। ফা: অনিল মারান্ডী তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন- ফা: কর্ণেলিউস আমাকে যাজকীয় জীবনের আহ্বান লাভে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বলতে পারি, তাঁরই অনুপ্রেরণায় আজ আমি যাজক অনিল হিসেবে খ্রিস্টমণ্ডলিতে আমার যাজকীয় সেবাদান করতে পারছি। শ্রদ্ধেয় ফা: উইলিয়াম মুরমু তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন- আমি এবং আমার ছোট ভাই ফা: কর্ণেলিউস আমরা পিঠা-পিঠি ভাই। ফা: কর্ণেলিউস যেকোন বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-পরামর্শ করে সব কাজ করতেন। তাঁর ভাল লাগা না লাগাগুলোকেও আমার সঙ্গে সহজ-সরল ভাষায় সহভাগিতা করতেন। সে ছিল অত্যন্ত আনন্দপ্রিয় মানুষ। গান-বাজনা ভালবাসত। পারিবারিক যেকোন অনুষ্ঠানে সে খুবই উদ্যমী ছিল। তাঁকে নিয়ে আমরা সবাই বা সে আমাদের সবাইকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করতে পছন্দ করত। ফা: কর্ণেলিউসের জীবনে আমি কখনো কোন বিষয়ে রাগ করতে দেখেনি বা কোন বিষয় নিয়ে তেমন কোন আপত্তিও করতে শুনিনি। তাঁর যা প্রয়োজন হতো সে নির্ধিদ্ধায় আমাকে বলতো এবং আমিও তা পূরণ করতে চেষ্টা করতাম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে আমার অপেক্ষায় ছিল; আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, তখন আমাকে দেখে তাঁর শেষ যে কথাটুকু বলেছিল; সেটি ছিল-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এরপরে সে কাঁদতে থাকে। নীরবতায় সেই কান্নাতে সাই দেওয়া ছাড়া আমার যেন আর কিছুই করার ছিল না। এই ভাবেই আমার ছোট ভাইয়ের চির বিদায়ের সেই স্মৃতিটুকু নিয়ে আমাকে পথ চলতে হচ্ছে। তবুও আমাদের মণ্ডলিকে ধন্যবাদ জানাই বিশেষভাবে আমাদের বিশপ মহোদয়কে যিনি ফা: কর্ণেলিউসের অসুস্থ্যতাকালীন সময়ের সমস্ত চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেছেন। শ্রদ্ধেয় ভিকার জেনারেলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, কেননা, এই অসুস্থ্যতাকালীন সময়ে ফা: কর্ণেলিউসের জন্য কোন কোন ডাক্তারের দরকার বা কিভাবে চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে তা ব্যবস্থা করার জন্যে। সেই সাথে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের সকল ফাদার-সিস্টারদেরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই; ফা: কর্ণেলিউসের অসুস্থ্যতাকালীন সময়ে তাঁকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার জন্য। সবশেষে বলতে চাই, ফা: কর্ণেলিউস যদি অযাচিতভাবে কাউকে কোন দু:খ-কষ্ট দিয়ে থাকেন তাঁর জন্য তাঁকে ক্ষমা দান করবেন, যেন সে স্বর্গবাসী হতে পারেন।

স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের শেষে  পাল-পুরোহিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং মধাহ্ন ভোজের মধ্যদিয়ে ফা: কর্ণেলিউস মুরমু’র শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের সমাপ্ত হয়।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

Please follow and like us: