৮ই মার্চ রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে “টেকসই ভবিষ্যত গঠনে নারী-পুরুষের সমতা”-এ মূলভাবের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২২ উদযাপন করা হয়। এতে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের শহরের আশে-পাশের ৫টি ধর্মপল্লী থেকে মোট ১০৫ জন অংশগ্রহণ করেন। সকাল ৮ টায় আগমন ও রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সকাল ৯ টায় পবিত্র খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন ফা: বাবলু কোড়াইয়া ও তার সহার্পিত খ্রিস্টযাগে ছিলেন ফা: শিশির নাতালে গ্রেগরী। ফা: বাবলু কোড়াইয়া তার উপদেশ বাণীতে বলেন- আজ ৮ই মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। আর এই দিবস উপলক্ষ্যে সকল নারীদেরকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমরা যদি এই নারী দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই , তাহলে দেখব যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকরা শ্রম ঘন্টা ৮ ঘন্টা নির্ধারণ, শিশুশ্রম বন্ধ, নিম্ন -মজুরী ও মজুরি বৈষম্য ইত্যাদির প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল। এই আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য মালিকশ্রেণী অমানবিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তারা এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পারেনি। পরবর্তীকালে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক নারী নেত্রী ক্লারা জেৎকিন এই দিনটিকে সারা বিশ্বে ‘নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। ১৯১১ সালের ৮ই মার্চ থেকে এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষের সমতা, সম-অংশীদায়িত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ‘আন্তজাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।

পবিত্র খ্রিস্টযাগের পর অংশগ্রহণকারী নারীদের নিয়ে খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্রের চত্ত্বরে রেলী করা হয়। রেলীর সময় নারীদের অধিকার নিয়ে স্লোগান দেওয়া হয়। রেলী শেষে হালকা নাস্তার ১ম সেশন শুরু করা হয়। সেশনের শুরুতে ছিল আসন গ্রহণ, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, পবিত্র বাইবেল থেকে পাঠ ও দিনের প্রার্থনা করা হয় এবং উদ্বোধনী নাচ পরিবেশন করা। অত:পর খ্রিস্টভক্ত জনগণ বিষয়ক কমিশনের আহ্বায়ক ফা: শিশির নাতালে গ্রেগরী উদ্বোবণী বক্তব্যের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। দিনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় “টেকসই ভবিষ্যত গঠনে নারী-পুরুষের সমতা” নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেন শ্রদ্ধেয় ফা: প্যাট্রিক গমেজ। তিনি তার বক্তব্যে বিশেষভাবে বলেন- তিনি তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন; গুণবতী নারী মণিমুক্তার চেয়েও তার মূল্য অনেক বেশী। পুরাতন নিয়মে: আদর্শ নারী: হান্না, রূথ আদর্শ শ্বাশুড়ী; নয়মী আদর্শ ছেলের বৌ বা পুত্র বধু। আদি পুস্তকে ঈশ্বর মানুষকে নর ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তারা দু’জনে মিলে হবে একদেহ। একদেহ মানেই হলো ৫০ ও ৫০ = ১০০। আর এইভাবেই ঈশ্বর বিবাহ বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিবাহের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঈশ্বর এবং ঈশ্বর বলেছেন মানুষকে বিবাহ করতে হবে। সন্তানের জন্মদান দেওয়া হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছা। তারা দুজনে বা দুইয়ে মিলে এক-একা পূর্ণ নয়, নরও নয়-নারীও নয়। এবার নতুন নিয়মে: পবিত্র পরিবার, একটি টেকসই পরিবার। নারী-পুরুষের মর্যাদা। যোসেফ নারীর মর্যাদা দেয় এবং যোসেফ হলো নীরব কর্মী ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে নেয় কিন্তু নারী মারীয়া সে কথা বলে। যোসেফ কিন্তু নীরব যোসেফ খালি স্বপ্ন দেখে এবং সে অনুসারে কাজ করে। নারী মারীয়া: কথা বলে ও যুক্তি দেখায়, ঐশ-আশ্বাস মারীয়া মেনে নেয়। এবার আমরা মূলসুরে আসি। টেকসই ভবিষ্যত বা উন্নয়নের জন্যে নারী-পুরুষের সমতা অর্থাৎ স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্যে নর-নারীর সমতা। টেকসই ভবিষ্যত বা উন্নয়ন বলতে কী বুঝি? একটি পরিবার, সমাজ, সংগঠন ইত্যাদির বর্তমান উন্নয়ন যে গতিধারা, ভবিষ্যতেও একই ভাবে চলতে থাকবে। যুগলক্ষণ বিচিত্র পদ্ধতির সৃজনশীলতা, কাঠামোগত কার্যক্রমের ভিন্নতা ইত্যাদি একান্ত স্বাভাবিক তবে বর্তমান প্রগতি এর সমর্থন ও প্রশংসায় ধারা থেমে থাকবে না-ভবিষ্যত প্রগতিকে কোনক্রমেই অস্বীকার করে নয়। প্রগতি বর্তমান অভাবগুলোকে পূরণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সামর্থ যুগিয়ে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারবে । এর জন্যে প্রয়োজন নর-নারীর সমতা। সমতা যেখানে শান্তি, সম্প্রীতি প্রগতি সেখানে। একই রাস্তায় হাটছে দুজনেই আর প্রগতি চলমান।

মি: সেবাষ্টিয়ান পিউরীফিকেশন, সিনিয়র ম্যানেজার, রাজশাহী কো-অর্ডিনেশন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ নারীর প্রতি সহিংসতা এ বিষয়ে তাঁর সহভাগিতায় বলেন- আজও নারী নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, তাদের মর্যাদা হচ্ছে ক্ষুন্ন। নারীর এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে, নারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ও তার মহামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই কাজগুলো প্রথম শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, পরিবারে নারী যেন নিজেকে সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায়, ছেলে ও মেয়ে শিশুকে সম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনায় নারীর অংশগ্রহণ ও মতামতের মূল্য দিতে হবে যেন পরিবার থেকেই নারী সঠিক ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সক্ষমতা নিয়ে গড়ে উঠে ও সে আত্ম-বিশ্বাসী হয়।

এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও সভাপতি ফা: সুনীল দানিয়েল রোজারিও তার বক্তব্যে বলেন- আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো : সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীদের অধিকার ও অংশগ্রহণ কতটুকু পেয়েছেন বা লাভবান হয়েছেন। আজকে নারী পুরুষের মধ্যে সমতা হলো আগামী দিনের টেকসই ভবিষ্যত- এই বাণীর মধ্যদিয়ে জাতিসংঘ কী বলতে চায়, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কাব্যে নারী কবিতায় কী বলেছেন, “আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” এতোদিন পরে হলেও বিশ্ব নেতাদের মাথায় প্রবেশ করেছে যে, নারীকে বাদদিয়ে সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের ঘোষণা ছিলো- ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশ্ব ক্ষুদা মুক্ত হবে। দরিদ্রতাকে যাদুঘরে পাঠাবেন বলেও কেউ কেউ বলেছেন। সেই সময় সদ্য প্রয়াত দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেজমন্ড টুটু বলেছিলেন, আলাদা আলাদা রোগীর জন্য আলাদা আলাদা ওষুধ লাগে। ক্ষুধা নির্মূল একটা রোগ নির্মূল মাত্র এবং এই রোগ মানুষের তৈরি। আর ঔষধ একটিই আলাদা আলাদা নয়- ভেদাভেদ নয়- বিশ্বে এক মানব সমাজ এবং এক ও অভিন্ন বিশ্ব পল্লী। তবে মনে রাখতে হবে- নারী স্বাধীনতা মানে- যা ইচ্ছা তা করা নয়। কাজে, কথায়, পোশাক পরণে শালীনতা থাকতে হবে। কোলকাতার সিরিয়াল কিন্তু নারী স্বাধীনতা নয়। এই বছর জাতিসংঘ নারী দিবসের বাণী ঘোষণার সময় বলেছে, নারীকে আলাদা রেখে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দরিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়।
অত:পর মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণের পর ২:৩০ মিনিটে মুক্ত আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়। এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি বিশেষ দিক ছিল লটারী ড্র। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০ জনকে পুরষ্কৃত করা হয়।

পরিশেষে, খ্রিস্টভক্ত জনগণ বিষয়ক কমিশনের আহ্বায়ক ফা: শিশির নাতালে গ্রেগরী সর্বপ্রথম সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে এই সুন্দর দিনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, সেই সাথে ধর্মপ্রদেশের বিশপ মহোদয়কে তার কমিশনের সদস্য-সদস্যাদেরকে প্রধান আলোচক ফা: প্যাট্রিক গমেজকে ও প্রধান অতিথি ফা: সুনীল দানিয়েল রোজারিওকে এবং পালকীয় কেন্দ্রের পরিচালকসহ সকল সেবাকর্মীদেরকে ও উপস্থিত অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন- আসুন আমরা নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং টেকসই আগামীর জন্য আজ নারী-পুরুষের সমতা বিধান করার লক্ষ্যে যে যার অবস্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে যত্নবান হই। এটাই হোক, আমাদের এ বছরের নারী দিবসের অঙ্গীকার।

বরেন্দ্রদূত নিজস্ব রিপোর্টার

Please follow and like us: