পুণ্যপিতা সাধু দ্বিতীয় জন পল ছিলেন একজন যুবপ্রেমিক। যুবদের ভালোবেসে তিনি বিশ্ব যুব দিবস সূচনা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই বছরও বাংলাদেশের দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ার ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে ২৪-২৭ মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দ ৩৭তম জাতীয় যুব দিবস অনুষ্ঠিত হয়। বিগত বছর মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে যুব দিবস উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এই বছর করোনা পরিস্থিতি সীমিত হওয়ায় “মারিয়া ওঠে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা করলেন” (লুক ১: ৩৯); বাইবেলের এই উক্তিকে মূলভাব করে বাংলাদেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশ থেকে আগত প্রায় ৪০০ যুবক-যুবতী চারদিনব্যাপী জাতীয় যুব দিবসে অংশগ্রহণ করেন।
২৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সান্তালী মাদলের ধ্বনিতে মেতে ওঠে ক্যাথিড্রাল চত্ত্বর। দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের যুবক-যুবতীরা অপেক্ষায় থাকে বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশ থেকে আগত যুবক-যুবতীদের স্থানীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির মাধ্যমে বরণ করে নিতে। দুপুরের আগেই ক্যাথিড্রাল চত্ত্বর যুবক-যুবতীদের স্বদর্প পদাচরণে মুখরিত হয়ে উঠে। বিকাল থেকেই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শুরু হয় চারদিনব্যাপী কার্যক্রম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ যুব কমিশনের সভাপতি চট্রগ্রামের আর্চবিশপ সুব্রত লরেন্স হাওলাদার, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও, দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু, বাংলাদেশ যুব কমিশনের নির্বাহী সচিব ও জাতীয় যুব সমন্বয়কারী ফাদার বিকাশ জেমস রিবেরুসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফাদার, সিস্টার এবং ব্রাদার। শোভাযাত্রার মাধ্যমে যুব দিবসের ক্রুশ হস্তান্তর ও স্থাপন ছিলো আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। যিশুর ক্রুশের পদতলেই যে যুবরা তাদের সকল প্রকার যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট বিসর্জন দিতে পারে তাই ছিলো এই ক্রুশ স্থাপনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। উদ্বোধনী খ্রিস্টযাগে দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু বাইবেলের অপব্যয়ী যুবকের জীবন উল্লেখ করে বলেন, “আমরা যুবরাও অনেক সময় অপব্যায়ী পুত্রের মতো বিপথে ধাপিত হই। তবে ঐশপিতা ও জাগতিক পিতা আমাদের গ্রহণ করে নেবার জন্য সদা প্রস্তুত”।
রাতের আহারের পর শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আর্চবিশপ সুব্রত লরেন্স হাওলাদার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, “করোনা মহামারীর বাঁধা-বিঘ্নকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে আমরা ঈশ্বরের পরিকল্পনার ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে এই বছর জাতীয় যুব দিবস উদযাপন করতে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আগামী বিশ্ব যুব দিবসের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিস্বরূপ এই বছরের জাতীয় যুব দিবসের মূলসুর রাখা হয়েছে”। দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রমে মূল আকর্ষণ ছিলো বর্ণাঢ্য যুব রেলী এবং ধর্মপ্রদেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি-সংস্কৃতির সমন্বয়ে ঐতিহ্য কোণ প্রদর্শন। নির্বাহী সচিব ও জাতীয় যুব সমন্বয়কারী ফাদার বিকাশ জেমস রিবেরু, সিএসসি জাতীয় যুব দিবসের তিনটি লক্ষ্য উল্লেখ করে বলেন, “এই বছরের জাতীয় যুব দিবসের তিনটি লক্ষ্য রয়েছে- প্রথমত বাংলাদেশের খ্রিস্টান যুবক-যুবতীরা যেন আন্তঃসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আলোকিত ও খ্রিস্টের ভাই-বোন হিসাবে একে অন্যকে সন্মান দিতে পারে। দ্বিতীয়ত যুবক-যুবতীরা যেন খ্রিস্টের কাছে (Encounter with Christ) আসতে পারে এবং খ্রিস্টকে সাক্ষ্য দিতে পারে মঙ্গলবাণী প্রচার করার মাধ্যমে। তৃতীয়ত খ্রিস্টের সান্নিধ্যে অভিজ্ঞতার আলোকে খ্রিস্টের মানব সেবার শিক্ষা মণ্ডলি ও পরিবারে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর এই তিনটি লক্ষ্যই এবারের জাতীয় যুব দিবসের মূলভাবের সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মা মারীয়ার সাহসী সিদ্ধান্তকেই প্রকাশ করে”।
চারদিনের এই জাতীয় যুব দিবসে মূলভাবের ওপর ছিলো বিশপ জের্ভাস রোজারিও’র উপস্থাপনা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ নিরসনে পুণ্যপিতার সাথে একত্রে প্রার্থনানুষ্ঠান, ধর্মপ্রদেশভিত্তিক নানাবিধ উপস্থাপনা, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ক্লাশ, যুবদের জেগে ওঠার গল্প, ‘সিনডিও মণ্ডলি : মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ’, ‘লাউদাতো সি’ ও ‘ফ্রাত্তেলি তুত্তি’ মূলভাবের ওপর উপস্থাপনা। এছাড়াও ২৬ মার্চ রাতে ক্যাম্প ফায়ার এবং ২৭ মার্চ অর্ধবেলা এক্সপোজার, বিকালে মহাখ্রিস্টযাগ, যুব প্রতিজ্ঞা, ধন্যবাদ জ্ঞাপন, যুব ক্রুশ হস্তান্তর ও রাতে যুবক-যুবতীদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
৩৭তম জাতীয় যুব দিবসে সিলেট ধর্মপ্রদেশ থেকে আগত মুণ্ডারী আদিবাসী যুবক এণ্ড্রু তপ্ন বলেন, “এই জাতীয় যুব দিবসে অংশগ্রহণ করে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমার ধর্মপ্রদেশে আমারই মতো অনেক যুবক-যুবতী আছেন যারা ইচ্ছা থাকা সত্বেও অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আমি এখান থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছি তা দ্বারা তাদের আলোকিত করবো বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি”। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের আদিবাসী মান্দি যুবতী রুচি রিছিল বলেন, “এই যুব দিবসে অংশগ্রহণ করায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কারণ সারা বাংলাদেশের খ্রিস্টান যুবদের সাথে পরিচয় ও মিথস্ক্রিয়ার একটি বড় প্লাটফর্ম এই যুব দিবস। তবে এই সব কিছুর কেন্দ্রে হচ্ছেন আমাদের প্রভু যিশুখ্রিস্ট। এই জাতীয় যুব দিবসের কারণে একে অপরের সান্নিধ্যে কৃষ্টি-সংস্কৃতি সমন্ধে জানা ও শ্রদ্ধাবোধটা জেগে উঠেছে। আমি মনে করি- এই যুব দিবসের কারণে আমার মতো আরো অনেক যুববন্ধুদের মানসিকতা আরো বিস্তৃত হবে”।
বাংলাদেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশ থেকে আগত যুবক-যুবতীরা খ্রিস্টের সান্নিধ্যে নিজেদের জীবন গড়ে তুলবে প্রতিশ্রুতি দেন। যুবক-যুবতীদের কথার মধ্যে এই মনোভাবই ব্যক্ত হয়, অনেক সময় যুবক-যুবতীরা বিক্ষিপ্ত, পথভ্রান্ত ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে থাকেন। তবে এই জাতীয় যুব দিবসের শিক্ষার দ্বারা আলোকিত হয়ে নিজ নিজ কার্যক্ষেত্রে খ্রিস্টের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করবেন বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার: ফাদার সাগর কোড়াইয়া