ফাদার সাগর কোড়াইয়া
করোনাকালে জার্মানীতে গির্জায় মুসলিম ভাইদের নামাজ পড়তে দেখা গিয়েছে। ঘটনাটি অসম্প্রাদায়িকতার জীবন্ত উদাহরণ। অন্য ধর্মের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধই প্রকাশ পায়। এই ঘটনার বিপক্ষে অনেক বিষবাক্য সে সময় নিক্ষেপিত হয়েছিল। তবে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’ বাক্যটির ঊর্ধ্বে আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতির নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল আচরণ। বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তাই বলে। বাংলার মানুষের মন বংশপরম্পরায় বাংলার মাটির মতোই সহনশীল ও নরম। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম আসার পূর্বে হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। তবে ইসলামের পতাকাতলে এসে আশ্রয় নেয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীরা। দিনে দিনে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারিত হতে থাকে। বাংলাদেশে বহুধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করছেন।
তবে যুগ পাল্টে গিয়েছে। এখন ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যের ওপর খড়গহস্ত শাণিত করতে দ্বিধাবোধ জাগে না। ধর্ম কখনোই অন্য ধর্মের মানুষের পূজা-অর্চনা, কার্যকলাপকে বাঁধা দেওয়ার শিক্ষা দেয় না। বরং অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ভালবাসা ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনে সাহায্য করার কথাই বলে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। মুসলিম সমাজেও অমুসলিমরা নিজেদের পরিমণ্ডলে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করবে।
গত ৪ এপ্রিল জয়পুরহাট জেলার খঞ্জনপুরের অধীনস্থ হাটশিখা নামক গ্রামের গির্জাঘরে মুসলিম যুবকের গির্জার ধর্মীয় প্রতিমূর্তি, জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর ও পবিত্র বাইবেল ছিঁড়ে ফেলা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমার প্রশ্ন জাগে- ঐ যুবকের মনে এমন কি বিষ নির্গত হয়েছিল যে, অন্য ধর্মের প্রতি নূন্যতম সন্মানবোধ জাগ্রত হয় না! নিশ্চয়ই এই ক্রিয়াকলাপের জন্য সে বহু আগে থেকেই পরিকল্পনা করে আসছিল। একদিনে অন্য ধর্মের প্রতি রাগ, ক্ষোভ, হিংসা জন্ম নেয়নি। বরং দীর্ঘমেয়াদেই এই সম্প্রীতি ধ্বংসকারী নেতিবাচক দিকগুলো মনের ভিতরে সে পুষে আসছে। কাছের বন্ধুমহলের কাউকে না কাউকে সে প্ররোচিত করেছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় আচার-আচরণ স্বাধীনভাবে পালন করতে স্বাধীন কিনা! যদিও প্রশাসন মহল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে বদ্ধপরিকর। জয়পুরহাটে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর পরই জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য মহল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার! তবে পরবর্তীতে যেন এই রকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা না ঘটে তা লক্ষ্য রাখাই হবে সবচেয়ে বড় সফলতা। স্থানীয় খ্রিস্টান সমাজ যুবককে আটক করে কোন ধরণের নাশকতা চালায়নি। অধিন্যস্ত গির্জার ফাদারগণ জনগণকে শান্ত থাকতে বলেছেন। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অপরাধী যুবককে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। এ যেন সাধু পোপ দ্বিতীয় জন পলকে হত্যা করার জন্য আলী আক্সারগুলি করার পর পোপ কর্তৃক ক্ষমা করার মতই উদাহরণ। তিনি গির্জার ফাদারদের ধন্যবাদ জানান জনগণকে শান্ত রাখার মতো উদাহরণ সৃষ্টি করায়। তবে প্রশাসনযন্ত্র তার আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্মই হচ্ছে ক্ষমা করা; যিশুর শিক্ষানুযায়ী, “তোমার একগালে কেউ চড় মারলে বরং আরেকটি গালও পেতে দাও”। এরচেয়ে আর সুন্দর অহিংস শিক্ষা কি হতে পারে!
বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের সংখ্যা খুবই সীমিত। তবে অবদান কিন্তু সীমিত নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের অবদান নিয়ে কেউ গবেষণা করেনি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সে সময় মিশনগুলোতে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসায় দেশি ও বিদেশী ফাদারদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশমাতৃকাকে রক্ষায় খ্রিস্টানরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। স্বাধীনতা লাভ মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য হয়নি। আপামর বাঙালির জন্য স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তবে স্বদেশে কেন অন্যধর্মের বাঙালি স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করতে পারবে না। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই; সরকার প্রধান, প্রশাসন অন্যধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সরকার প্রধানের ভাষ্যানুযায়ী, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। যার যার ধর্মের ধর্মীয় অনুশাসন ও উপাসনালয় শ্রদ্ধার এবং ভালবাসার। অনুশাসন ও উপাসনালয়কে রক্ষায় মানুষ জীবন বাজিও রাখতে পারে। তাই, ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙ্গলে আসলে হৃদয়ই ভেঙ্গে যায়। আমরা আর ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙ্গা দেখতে চাই না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাই দেখতে চাই।