গত ১৯-২০ এপ্রিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দ লূর্দের রাণী মারীয়া ধর্মপল্লীর কালিকাপুর গ্রামের কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় ফা: সুশান্ত খ্রীষ্টফার ডি কস্তা’র যাজকীয় জীবনের রজত জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করেন তার নিজ পিতৃভবনে। এতে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিওসহ ২৫ জন যাজক, বেশ কিছু সংখ্যক সিস্টার ও প্রায় ১২০০শ মত খ্রিস্টভক্ত ও আত্মীয়স্বজন এতে অংশগ্রহণ করেন। জুবিলী উদযাপনের আগের দিন আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিস্বরূপ পবিত্র ঘন্টা করা হয় লূর্দে রাণী মারীয়া ধর্মপল্লীর পুরাতন গির্জায়। প্রার্থনার শেষে কীর্তন সহযোগে তাঁকে তার নিজ পিত্রালয়ে নিয়ে গিয়ে মঙ্গলানুষ্ঠান এবং পরে তাকে ঘিরে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ২০ এপ্রিল রজত জয়ন্তী উৎসবে পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন জুবিলী উদযাপনকারী ফা: সুশান্ত ডি কস্তা। তার সহার্পিত খ্রিস্টযাগে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রজত জুবিলী উদযাপনকারী ০৫ জন বন্ধুবর ফাদার ও ধর্মপ্রদেশে বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে আগত ফাদারগণ।

ফা: সুশান্ত তার রজত জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের সহভাগিতায় বলেন- ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই কেননা, তিনি আজকে এই যাজকীয় জীবনের ২৫টি বছর অতিক্রম করার ঐশ অনুগ্রহ ও কৃপা দান করেছেন এবং সেই সাথে রজত জয়ন্তী উৎসব পালনের সুযোগও দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই আমার যাজক হবার তীব্র ইচ্ছা ছিল এবং সেই ইচ্ছাটা আমি অন্তরে লালনও করেছি। পিতা-মাতার ভালবাসায় ও উৎসাহে এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রার্থনা যাজকীয় জীবনে বেড়ে উঠতে আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। ঈশ্বর আমাকে ডেকেছেন ও মনোনীত করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে, ঈশ্বরের কাজ ঈশ্বর করেছেন; আমিও একজন যাজক হিসেবে তাঁর কাজ করছি এবং করে যাব। ঈশ্বর চেয়েছেন বলেই আজ আমি যাজক। তবে যাজকীয় জীবনের পেছনে রয়েছে একটা সুদীর্ঘ পথযাত্রা। আমি যখন প্রাইমারীতে ক্লাস ফাইভে ছিলাম সি: পুষ্প আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; তুমি কি ফাদার হবে? আমি তখন বললাম; হ্যাঁ, আমি তাই হতে চাই। আর সেই থেকেই যাজকীয় জীবনের প্রবেশ করার সুপ্ত ইচ্ছা অন্তরে লালন করে যাজকীয় জীবনের আকর্ষণে পথ চলতে শুরু করি। আস্তে আস্তে যখন উপরের ক্লাসে পড়াশুনা করতে শুরু করেছি, অন্যান্য সেমিনারীয়ানদের দেখেছি, ফাদারদের দেখেছি, আর তখন থেকেই সুপ্তবাসনাটা আরও বেশি গভীর হচ্ছিল। ঐ সময় বনপাড়া ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ছিলেন ফাদার বেরেত্তা, পিমে। আমার মা যেহেতু মিশনে কাজ করতেন তাই ফাদার সিস্টারদের সঙ্গে খুব ভাল যোগাযোগ ছিল। আমরা প্রতিদিনই গির্জায় যেতাম। ফা: বেরেত্তাকে যখন বললাম; আমি ফাদার হতে চাই, ফাদার তখন হেসে বললেন; এখনো তুমি অনেক ছোট আছ। পাল-পুরোহিত ফাদার বেরেত্তা বদল হওয়ার পরে আমাদের ধর্মপল্লীতে আসেন ফাদার আঞ্জেলো কান্তন, পিমে। ফাদার কান্তনকে যখন ফাদার হবার ইচ্ছাটা জানিয়েছি, তখন তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন; তুমি অবশ্যই সেমিনারীতে যাবে এবং ফাদার হবে। তবে তার আগে ভাল করে পড়াশুনা কর ও মেট্রিক দাও, তারপরে যাবে। এভাবেই আমার সেমিনারী জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছে। মেট্রিকের পরে গিয়েছি দিনাজপুর, তারপর ঢাকা রমনা সেমিনারীতে পড়াশুনা করে বনানী উচ্চ সেমিনারীতে। এ ধাপগুলো আস্তে আস্তে পার করেছি এবং ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ৯ ফেব্রুয়ারি ডিকন পদে অভিষিক্ত হই। তারপর বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীতে আমার ডাইকোনেট মিনিস্ট্রি করি। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি যাজকীয় অভিষেক লাভ করি। এরপর ঐশ অনুগ্রহে আমার যাজকীয় জীবনের এই সুদীর্ঘ ২৫টি বছর বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। নতুন যাজক হওয়ার পরেই আমার যাজকীয় জীবনের প্রথম সেবা কাজের জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের গৌরনদী ধর্মপল্লীতে (১৯৯৮-১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ, বর্তমান বরিশাল ধর্মপ্রদেশ।) পর্যায়ক্রমে পাদ্রিশিবপুর (১৯৯৮-১৯৯৯)। অত:পর নিজ ধর্মপ্রদেশ রাজশাহীতে ফিরে বোর্ণী ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে কাজ করি (১৯৯৯-২০০৩) এবং বোর্ণীতে থাকাকালীন সময়ে ধর্মপ্রদেশীয় যুব কমিশনের কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। (২০০৩-২০০৪) পর্যন্ত রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় সেবাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি এবং বনপাড়া ষষ্ঠ পল সেমিনারী’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে (২০০৪-২০০৮) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। (২০০৮-২০১১) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ফ্রান্সের প্যারিশ শহরে যাই। পরবর্তীতে ফৈলজনা ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত হিসেবে (২০১১-২০১৬) খ্রিস্টাব্দ এবং সুরশুনীপাড়া ধর্মপল্লীতে পাল-পুরোহিত হিসেবে (২০১৬-২০১৮) খ্রিস্টাব্দ, চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশের দিয়াং ধর্মপল্লীতে পাল-পুরোহিত হিসেবে (২০১৯-২০২০) খ্রিস্টাব্দ এবং লক্ষীপুর উপ-ধর্মপল্লীতে (২০১৯-২০২১) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পালকীয় সেবা দায়িত্ব পালন করেছি এবং বর্তমানে বোর্ণী মারীয়াবাদ ধর্মপল্লীতে পাল-পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছি। তাই, আজ গভীর আনন্দের সাথে আমার বিগত ২৫ বৎসরের যাজকীয় জীবনের শত সহস্র আশীষ দানের জন্য বিনম্র চিত্তে ঈশ্বরকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে সাথে যাদের জীবনাদর্শে ও অনুপ্রেরণায় যাজক হয়ে পুণ্য বেদীতে পবিত্র যজ্ঞ উৎসর্গ করার সুযোগ পেয়েছি আমার সেই স্বর্গীয় পিতা-মাতা, সকল ভাই-বোন, গুরুজন, বিশপ, ফাদার-সিস্টার, আত্মীয়-স্বজন, ভক্তজনগণ ও বন্ধু-বান্ধবদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। ঈশ্বর সকলকে আশীর্বাদ দান করুন।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও ফা: সুশান্ত’র রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন- ফা: সুশান্তসহ অন্যান্য সকল জুবিলী পালনকারী ফাদারদের জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমি মনে করি, যাজকীয় জীবন হচ্ছে সবচেয়ে সুখের জীবন, আনন্দের জীবন এবং উত্তম জীবন। সেই সাথে আজকে আমি ফা: সুশান্তকে জিজ্ঞেস করি যে, মৃত্যুর পরে যদি তুমি আবার নতুন জীবন পাও, তাহলে কোন জীবনটা বেঁচে নিবে? যাজকীয় জীবন? বিশপ মহোদয়ের প্রশ্নোত্তরে ফা: সুশান্ত বলেন, যদি মৃত্যুর পর আবারো সুযোগ পাই, তাহলে আমি যাজকীয় জীবনই বেঁচে নিব।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল শ্রদ্ধেয় ফাদার ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন- আজকের এই আনন্দঘন মুহুর্তে বলতে চাই, ফা: সুশান্ত যেদিন যাজকপদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, সেদিন যিনি পাল-পুরোহিত হিসেবে ছিলেন তিনি আজকে এই মুহুর্তে এখানে নেই। তবে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে যিনি ছিলেন, তিনি আজ এখানে উপস্থিত আছেন, আর তিনি হলেন ফা: ইম্মানুয়েল। ২৫ বছর আগে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল বনপাড়া ধর্মপল্লীতে। আজ ২৫ বছর পরে তার জুবিলী পালন করছি। তার এই সুদীর্ঘ জীবনের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। আমার সুযোগ হয়েছিল বোর্ণী ধর্মপল্লীতে ফা: সুশান্ত’র সঙ্গে একসাথে কাজ করতে। আমি ছিলাম পাল-পুরোহিত এবং ফা: সুশান্ত ছিলেন সহকারি পাল-পুরোহিত। যেহেতু বোর্ণী ধর্মপল্লীতে দুটো কেন্দ্রে আমাদের রবিবারের মিশা দিতে হত। তাই, আমরা দু’জনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম একদিন আমি কেন্দ্রে মিশা দিলে ফা: সুশান্ত মিশা দিবে মানগাছাতে। এভাবেই আমরা দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম এবং আমাদের পালকীয় সেবাকাজ করতাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই যখন বৃষ্টি হত, তখন ফা: সুশান্ত আগে থেকেই আমাকে বলতো আপনি আজ কেন্দ্রে থাকবেন আমি মানগাছায় যাব। অর্থাৎ কোনভাবেই সে আমাকে কষ্ট করতে দিতে চাইত না।

রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে বনপাড়া ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত এবং সুশান্ত কস্তা’র বন্ধুবর ফা: দিলীপ এস কস্তা তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- ফাদারগণ আপনাদেরই মানুষ। আপনাদের সাথেই থাকেন। আপনাদের জন্যেই কাজ করেন। আর সবচেয়ে ভাল লাগে যখন আমাকে বলে এই ফাদার হল আমাদেরই ফাদার। কয়েকদিন আগে মথুরাপুর গিয়েছিলাম, সেখানে আমাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলেন ফা: দিলীপ আমাদের মথুরাপুরের ফাদার কিন্তু বনপাড়াতে থাকে। আমরা যখন সবার সাথে মিশতে পারি, সবার কাছে যেতে পারি, তখনই আমরা একের-অপরের হয়ে উঠতে পারি। তাই, শুধু সুন্দর আনন্দ অনুষ্ঠানেই নয় কিন্তু অসুস্থতায়, কষ্টে, দুঃখে এবং হতাশা-নিরাশার মধ্যে যারা পাশে থাকে তখনই লাভ করা যায় প্রকৃত আনন্দ আর সেটাই হল আমাদের জীবনের আসল পাওয়া। ফা: সুশান্তকে ঘিরে পুরো কালিকাপুর গ্রাম আজ যে রজত জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করছে তা দেখে আমি মুগ্ধ। আর বলতে চাই, কালিকাপুর গ্রামবাসী ফা: সুশান্তের প্রতি যে শ্রদ্ধা-ভালবাসা ও সহানুভূতি দেখিয়েছে তা গোটা ধর্মপল্লীকেই দেখিয়েছে।

বন্ধুবর ফা: খোকন বলেন, আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ফা: সুশান্ত খ্রীষ্টফার কস্তা’র জুবিলী পালন করতে সবার সাথে যুক্ত হতে পেরে আমি অনেক আনন্দিত। ফা: সুশান্তসহ আমরা যারা জুবিলী বছরে আছি, আগে পরে পালন করছি, সবাইকেই অনেক অনেক অভিনন্দন। আমি শুধু বলতে চাই, যাজকীয় জীবন অনেক সুন্দর, অনেক সুখের এবং অনেক আনন্দের। এই সুখ, এই আনন্দকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তাই বলতে চাই, যাজকীয় জীবন সেই বুঝে, সেই জানে, যে এই জীবন যথাযথ ভাবে যাপন করেন। আজকের এই অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে আহ্বান জানাই, আমাদের সকল যুবক ভাইদেরকে বলতে চাই; একটু ভেবে দেখ, এই সুখের ও আনন্দের জীবনে আসা যায় কিনা?

কালিকাপুর গ্রামের ফা: সুশান্ত’র ছোট্টবেলার খেলার সাথী ছোট ভাই ফা: প্রদীপ পিরিছ বলেন- শান্তদা একজন মহৎ মনের মানুষ। শান্তদা বেশ গুছানো মানুষ। শান্তদার পড়ার টেবিল ছিল পরিপাটি। বইখাতাপত্র সব কিছু জায়গায় সুন্দর করে সাজানো গোছানো। জীবনে কখনো কোন অসত্যের সঙ্গে আপোশ করে নি যার কারণেই শান্তদা এখনো খ্রিস্টীয় পথে টিকে আছেন এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক মি: সুক্লেশ জর্জ কস্তা বলেন- জুবিলী উদযাপনকারী শ্রদ্ধেয় ফা: সুশান্ত খ্রীষ্টফার ডি কস্তা, তার সাথে যেসব যাজকগণ জুবিলী উদযাপন করছেন প্রত্যেককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ঈশ্বরের কাছে তাদের জন্য প্রার্থনা রাখি যে, তারা যিশুর দ্রাক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আহ্বান পেয়েছেন এবং বিশস্ততার সাথে বিগত ২৫টি বছর ধরে যাজকীয় জীবন যাপন করছেন। তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, ফাদাররাও রক্ত মাংসের মানুষ; তারাও ভুল করতে পারে, তাদেরও চাহিদা থাকে এবং তাদের জীবনেও কষ্ট আছে। তাই, তাদের জন্য সকলকে আহ্বান জানাই প্রার্থনা করতে যেন তারা সুন্দরভাবে তাদের যাজকীয় জীবন-যাপন করতে পারে।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

Please follow and like us: