জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

ওকে পুতুল নামেই চিনি। তবে পুরো নাম ক্যাথরিন গমেজ পুতুল। সম্প্রতি ১৪তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ পদে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশে মেধা তালিকায় তার অবস্থান ৩২। ক্যাথরিন গমেজের জন্ম নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানাধীন জোনাইল ইউনিয়নের বোর্ণী গ্রামে। পিতা স্বর্গীয় এন্ডু মনো গমেজ যিনি সেন্ট লুইস উচ্চ বিদ্যালয় তথা নাটোর জেলার একজন জনপ্রিয় ও ছাত্র-ছাত্রীবান্ধব শিক্ষক ছিলেন। স্যারকে সবাই মনো স্যার নামেই চিনতো। মনো স্যার আমাদের ইংরেজী ক্লাস নিতেন। ইংরেজি শেখানোর অভিনবত্ব ছিলো আকর্ষণীয়। আমরা তখন হাইস্কুলে। মাঝে মাঝেই মনো স্যার তার ছোট মেয়ে পুতুলের হাত ধরে স্কুলে আসতেন। পুতুল মনো স্যারের চেয়ারের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে স্যার পুতুলকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লাস নিতেন। এরপর দীর্ঘ সময় চলে গিয়েছে। আমি সেমিনারীতে পড়াশুনাকালীন সময়ে মনো স্যার মৃত্যুবরণ করেন। ছুটিতে বাড়িতে এলে দেখতাম পুতুল ও তার অন্যান্য বান্ধবীরা ধর্মপল্লীতে ওয়াইসিএস ও কাপিতানিও সংঘের সাথে জড়িত। পুতুল সে সময় সম্ভবত সংঘের নেতৃত্বেও ছিলো। বড়দিন ও পুনরুত্থান উৎসবের গানের প্রস্তুতিতে পুতুল ছিলো অগ্রগণ্য। এটা ধ্রুব সত্য যে, পুতুলের মধ্য এই বৈশিষ্ঠ্যগুলো জেগেছে পরিবার থেকেই। কারণ পুতুলের বাবা মনো স্যার যাজক হবার মানসে সেমিনারীতে গঠন লাভ করেছেন। পুতুলের একজন জ্যাঠা ও কাকা যাজক। পুতুলের পিসি মারীয়া বাম্বিনা সম্প্রদায়ের সিস্টার। এছাড়াও গান-বাজনার আবহে পুতুলের বেড়ে উঠা। পুতুলের বাবা মনো স্যার ধর্মপল্লীতে খ্রিস্টযাগে গান পরিচালনা করতেন। ফাদার ইন্মানুয়েল প্রফুল্ল তবলার ওস্তাদ আর ফাদার প্যাট্রিক গমেজতো বাংলাদেশ খ্রিস্টমণ্ডলির উপাসনা সঙ্গীত জগতের মাস্টারপিস; যার অসংখ্য জনপ্রিয় গান খ্রিস্টিয় উপাসনায় গাওয়া হয়।

২০১২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথরিন গমেজ পুতুল সেন্ট লুইস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এইসএসসি পাশ করে পুতুল তখন ঢাকার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি বিষয়ে অধ্যয়নরত। একদিন পুতুলের বড়বোন লিপি গমেজের বাসায় যাই। গল্পের এক ফাঁকে পুতুলের কথা আসতেই বড়বোন লিপি গমেজ বললো, বাবার ইচ্ছা ছিলো তার এক মেয়ে উকিল হবে। তবে তার কোন মেয়ে সে পথ মাড়ায়নি। অবশেষে পুতুলই এগিয়ে যাচ্ছে বাবার স্বপ্ন পূরণে। নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিভিন্ন সময়ে পুতুল তার মেধার প্রকাশ ঘটিছে বলে জানি। একবার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফাদার লরেন্স দাসের সাথে আলাপ হচ্ছিলো। ফাদার নিজে থেকেই পুতুলের বিষয়ে বলছিলেন, পুতুল বাংলা এবং ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষায় অনুষ্ঠান পরিচালনায় অনন্য। অবশেষে পুতুল ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে এলএলএম পাশ করে বিগত সময়গুলোতে বিজেএস (বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস) পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

পুনরুত্থান উৎসবের কয়েকদিন পর ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারলাম পুতুল সহকারী জজ পদে উত্তীর্ণ হয়েছে। পুতুলের এই অর্জন বাংলাদেশ খ্রিস্টমণ্ডলির জন্য প্রশংসনীয়। আরেকটু সংকুচিত করে বললে, পুতুলের এই কৃতিত্বের স্বাক্ষর বোর্ণী ধর্মপল্লীবাসীদের জন্য গর্বের। পুতুল যেন বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের জন্য অনুপ্রেরণার। একটি ভিডিওতে পুতুলের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। পুতুল আজকের এই পর্যায়ে আসার পিছনে মনো স্যার অর্থাৎ বাবার স্মৃতিগুলোকে প্রধান নিয়ামক হিসাবে মনে করেন। কারণ মনো স্যারকে জনগণ গ্রাম্যশালিস বা বিচারিক কাজে ডাকতেন। কঠিন সমস্যাও তিনি মূহুর্তের মধ্যে সমাধান করে দিতেন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন তৎপর। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই মনো স্যারের প্রতি জনগণের অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। আর পুতুল তার আজকের এই পর্যায়ে আসায় বাবার সেই স্মৃতি ও আশীর্বাদকেই বড় মানছেন।
আমরা জানি বাংলাদেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায় খুবই ক্ষুদ্র। আমরা ধুয়ো তুলে বলি সরকারী পদগুলোতে খ্রিস্টানরা সাম্প্রদায়িকতার শিকার।

অনেকক্ষেত্রে হয়তোবা সত্য। তবে আরো সত্য আমরা অভিভাবক, পিতামাতাগণ সন্তানদের সরকারী কাজে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে ফেলি। সন্তানদের কোন রকম পরীক্ষায় পাশ করিয়ে বাবুর্চি লাইনে পাঠাতে পারলে অথবা মেয়েকে ভালো মাইনের বাবুর্চি ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে দায়িত্ব ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। তবে আসল সত্য হচ্ছে- প্রত্যেকজন সন্তানেরই রয়েছে অপার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে অনেকেই সরকারী বিভিন্ন দপ্তরগুলোতে প্রবেশ করছে। বিশেষভাবে- ডাক্তারী, নার্সিং, সরকারী মন্ত্রণালয়গুলোতে খ্রিস্টান যুবদের পদচারণা লক্ষ্যণীয়। ক্যাথরিন গমেজ পুতুলও দেখিয়ে দিয়েছেন মেধা, অধ্যবসায় ও ইচ্ছাশক্তির কাছে সকল বাঁধাই তুচ্ছ। ধীরে পদক্ষেপে ক্যাথরিন গমেজ পুতুল নিজেকে গড়ে তুলেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। বাংলাদেশের যে কোন স্থানে সরকারী কাজে নিয়োগ পাবেন তা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়। তবে এর চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে ক্যাথরিন গমেজ পুতুলের মধ্য দিয়ে জনগণ যিশুখ্রিস্টের পরিচয় পাবে।

Please follow and like us: