নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অখ্রিস্টান ব্যক্তি যিনি বিয়ের ১৩-১৪ বছর পার করার পরেও কোন সন্তানের মুখ দেখতে পাননি। সন্তান গর্ভে আসার কয়েক মাস পরই গর্ভপাত ঘটতো। পর পর ৪-৫ বার এ রকম হওয়ার পর আর সন্তান গর্ভে আসছিল না। অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েও কোন লাভ না হওয়াতে ইন্ডিয়া যান চিকিৎসা নিতে। সেখানে ডাক্তারগণও কোন আশার বাণী শোনাতে পারেন নি। নিরাশ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। কোন এক সময়ে তার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে সাধু আন্তনীর আশ্চর্য কাজের কথা শুনতে পান। মনস্থির করেন তিনি তীর্থে আসবেন। সত্যি সত্যি তিনি তীর্থে এলেন এবং সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে সাধু আন্তনীর দয়া ভিক্ষা চাইলেন। কি আশ্চর্যের বিষয়! পরের মাসেই তিনি সন্তান গর্ভে আসার খবর দেন এবং সাধু আন্তনীকে আরও ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। এখন তিনি প্রতি বছরই তীর্থে আসেন এবং বিশ্বাস ভরা অন্তরে নিজের মনের আশা ব্যক্ত করেন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সাধু আন্তনী একজন মহান সাধু। তাঁর গুণের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে প্রার্থনা করে কেউ শুন্য হাতে ফিরে যাননি। ধৈর্য্য ও ভক্তি সহকারে প্রার্থনা করলে তিনি কাউকে নিরাশ করেন না। অনেক বিধর্মী মানুষও তার বিশ্বাসের গুণে সাধু আন্তনীর কাছ থেকে অনেক আশীষ, অনুগ্রহ লাভ করেছেন। এমনটিই প্রকাশ করেছেন কাতুলী গ্রামের অধিবাসী মিসেস সাগরী গমেজ।

গত ১৩ মে, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ রোজ শুক্রবার রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অন্তর্গত মথুরাপুর সাধ্বী রীতা’র ধর্মপল্লীর কাতুলী উপ-ধর্মপল্লীতে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য্য পরিবেশে সাধু আন্তনীর পর্বোৎসবটি পালিত হয়েছে। এই তীর্থোৎসবের পূর্ব প্রস্তুতিস্বরূপ নয় দিনের নভেনা, পাপস্বীকার সংস্কারগ্রহণ ও খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে খ্রিস্টভক্তগণ তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ নভেনা অনুষ্ঠানে আশে-পাশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দল এসে তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

সকাল ১০:০০ মিনিটে শোভাযাত্রা সহযোগে পবিত্র খ্রিস্টযাগ শুরু হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। এছাড়াও ১৭ জন যাজক, ১৫ জন সিস্টার ও প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন।

বিশপ মহোদয় তার উপদেশ বাণীতে বলেন, খ্রিস্টমণ্ডলিতে সাধু-সাধ্বীদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সন্মান প্রদর্শন একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। তাদের মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কৃপা লাভ-ই হলো এর মূল উদ্দেশ্য। সাধু-সাধ্বীগণ সর্বদা আমাদের সাহায্য করেন এবং আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের জন্য কৃপা এনে দেন। এজন্য তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের অগাধ বিশ্বাস, সন্মান ও ভক্তি। বহুল প্রচলিত একজন সাধুর কথা যদি বলতে হয়, তাহলে মহান সাধু আন্তনীর কথা চলে আসে। মানুষ হিসেবে সাধু আন্তনী ছিলেন একজন ধার্মিক, সহজ-সরল, বিশ্বস্ত ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করে অনেক বিশ্বাসী-ই ফল পেয়েছেন।

আমাদের ধর্মপ্রদেশে বেশ কয়েকটি তীর্থ স্থান রয়েছে। যেমন- নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থ, রহনপুর সাধু যোসেফের তীর্থ, মহিপাড়া আন্তনীর তীর্থ এবং কাতুলীতে সাধু আন্তনীর তীর্থ। কাতুলীতে ফেব্রুয়ারি মাসে তীর্থ উৎসব হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থগিতকৃত তীর্থ উৎসবের নতুন তারিখ ১৩ই মে হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বেশ কয়েক বছর ধরেই কাতুলীতে নিয়মিতভাবেই তীর্থ উৎসব উদযাপন হচ্ছে। আর এ তীর্থস্থানে শুধু রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের নয় বরং অন্যান্য ধর্মপ্রদেশ থেকেও মানুষ আসেন তাদের মানতসহ আকুতি-মিনতি জানাতে। তীর্থ উৎসবে বিগত বছরগুলোতে খ্রিস্টবিশ্বাসীদের কোন কমতি লক্ষণীয় নয় বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ থেকেই প্রতীয়মান যে, সাধু আন্তনীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি কতই না গভীর।

খ্রিস্টযাগের শেষ আশীর্বাদের আগে পর্বীয় বিস্কুট, প্রার্থনা কার্ড ও খ্রিস্টভক্তদের নিয়ে আসা ধর্মীয় সামগ্রীর উপর বিশপ মহোদয় পবিত্র জল সিঞ্চনের মধ্যদিয়ে সেগুলোকে আশীর্বাদ করেন। এছাড়াও প্রতিবছরের ন্যায় তীর্থ উৎসব উদযাপনের পাশা-পাশি  এবছরও ‘অনুগ্রহ’ ম্যাগাজিনের যে ষষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে তার শুভ উদ্বোধন করেন বিশপ জের্ভাস রোজারিও। খ্রিস্টযাগের শেষ আশীর্বাদের পরে শান্তি ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে বিশপ মহোদয়, পাল-পুরোহিত ফা: শিশির এবং বোর্ণী ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফা: সুশান্ত ডি’কস্তা কবুতর উড়ান।

পাল-পুরোহিত ফাদার শিশির গ্রেগরী শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন- কাথলিক মণ্ডলিতে খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মিকতায় সাধু-সাধ্বীদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় দিক। প্রত্যেকজন খ্রিস্টভক্তের একজন প্রতিপালক ও প্রতিপালিকা রয়েছে। সাধারণত দীক্ষাস্নান সংস্কার প্রদানের সময় সেটা তাকে দেওয়া হয়ে থাকে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস হলো যে এই সাধু বা সাধ্বী সেই ব্যক্তিকে রক্ষা করেন এবং তাকে প্রতিপালন করেন। আর যে ব্যক্তি সেই নাম গ্রহণ করবেন, তিনি সেই সাধু-সাধ্বীর জীবন অনুসরণ ও অনুকরণ করবেন। দীক্ষিত প্রত্যেকজন ব্যক্তির সার্বজনীন আহ্বান হলো সাধু বা সাধ্বী হওয়া। সাধু সাধ্বীদের মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করা মণ্ডলির একটি প্রচলিত ঐতিহ্য। প্রতিদিনের প্রার্থনায় আমরা কোন না কোন সাধু বা সাধ্বীর মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদের হয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে কৃপা নিয়ে দেন, আমাদের হয়ে তারা প্রার্থনা করেন। সেই সাথে আজকের এই অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও সার্থকভাবে উদযাপন করার জন্য যারা যারা মেধা ও শ্রম দিয়েছেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

 সেন্ট ‍লুইস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক  শ্রদ্ধেয় ফা: জন মিন্টু  রায় তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- আজকে আমি খুবই আনন্দিত। আমি অনেকবারই নভেনার খ্রিস্টযাগ দিয়েছি এখানে। তবে এবারই প্রথমবার পর্বীয় খ্রিস্টযাগে আসলাম। আবহাওয়া বেশ খারাপ ছিল। তবে আমরা সবাই প্রার্থনা করেছি  তাই এখনো পর্যন্ত আবহাওয়া ভাল আছে। বিশ্বাস করি সাধু আন্তনীর মধ্যদিয়ে এটা আমাদের প্রতি একটি বিশেষ আশীর্বাদ। আমার প্রিয় সাধুদের মধ্যে সাধু আন্তনীও একজন। তার গুণগুলো আমাকে খুবই মুগ্ধ করে, আকর্ষিত করে, অনুপ্রাণিত করে ।  আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি সাধু আন্তনীর মধ্যদিয়ে  আমার এবং সকল পুরোহিতদের জীবন ও খ্রিস্টভক্তদের জীবন আজকের এই উৎসবে যোগদানের মধ্যদিয়ে তার ঐশ অনুগ্রহে ও আশীর্বাদে পরিপূর্ণ হবে।

ন্মুক্তিযোদ্ধা ইগ্নাসিউস গমেজ (ইনু মাস্টার) মথুরাপুর পালকীয় পরিষদের সহ-সভাপতি তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- আজ ২ বছর পরে আমরা তীর্থ ভূমিতে উপস্থিত হতে পেরেছি। বিগত ২টি বছর করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা সঠিকভাবে এই আমাদের তীর্থ ভূমিতে আসতে পারে নি। তবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেই এই জন্য যে, এই বছর তিনি আমাদের সেই সুযোগ দান করেছেন। সেই সাথে এইটাও ব্যক্ত করতে চাই যে, আমরা যতটুকু আশা করেছি তার চেয়েও বেশি লোকের সমাগম হয়েছে। আমরা যেভাবে এটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি সুন্দর হয়েছে।

কাতুলী গ্রামের অধিবাসী লিটু কোড়াইয়া সাধু আন্তনীর তীর্থ সম্বন্ধে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- প্রতি বছর সাধু আন্তনীর পর্বোৎসব উদযাপন করার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। এবারও সেই অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু যখন শুনতে পেলাম; ঘূর্ণিঝড় অসনীর কারণে বৃষ্টি হবে। এমনকি বৃষ্টি হয়েছে। তখন খুব চিন্তায় ছিলাম যে, কি হবে কেমন করে এবার আমরা তীর্থ উৎসব করব? কিন্তু সাধু আন্তনীর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। তাই, পর্বের দিন আবহাওয়া খুবই ভাল ছিল। আমি নয় দিন নভেনায় প্রার্থনা করে বলেছিলাম; হে সাধু আন্তনী, পর্বের দিন দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া যেন ভাল থাকে। সত্যিই সাধু আন্তনী আমাদের সকলের প্রার্থনা শুনেছেন। তাই, আজ সাধু আন্তনীর মধ্যস্থতায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই এবং প্রার্থনা করি যেন সবসময় এইভাবে আনন্দের সাথে ভক্তিভরে এই সাধু আন্তনীর পর্ব উদযাপন করতে পারি।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

 

Please follow and like us: