গত ২৭ মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, বাংলাদেশের কাথলিক বিশপদের প্রতিষ্ঠান (সিবিসিবি), সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে মহা আড়ম্বরের সাথে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটস্থ সিবিসিবি সেন্টারে উদযাপন করেছে তার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব।
এই অনুষ্ঠানটির দুইটি অংশে ভাগ করে করা হয়। প্রথম অংশে সিবিসিবি সেন্টারে আলোচনা সভা এবং দ্বিতীয় অংশে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ধন্যবাদ নিবেদন করে খ্রিস্টযাগ উদযাপন করা হয় তেজগাঁও ধর্মপল্লীতে।
সকালে সিবিসিবি সেন্টারে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানসূচিতে ছিল জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, ভাটিকানের পতাকা ও সিবিসিবির পতাকা উত্তোলন, কপোত উড়ানো, প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। সিবিসিবির ইতিহাস ও পটভূমি এবং বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলিতে এর প্রভাব বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন সিবিসিবির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও রাজশাহীর ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, সিবিসিবির এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত এই জন্য যে, বাংলাদেশ মণ্ডলি তার সুদীর্ঘ পথ চলার ৫০টি বছরের পথ অতিক্রম করে এক ঐতিহাসিক মূহুর্তে উপনীত হতে পেরেছি। এটা বাংলাদেশ মণ্ডলির জন্য ঈশ্বরের বিশেষ আর্শীবাদ।
সুবর্ণ জয়ন্তীর এ মহতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, ভাটিকান রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচেরি, বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশের বিশপগণ, ফাদার, সিস্টার এবং ব্রাদারগণ। এছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন, মাননীয় সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং ও অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ দুই হাজারের অধিক খ্রিস্টভক্ত।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’ ((Catholic Bishops’ Conference of Bangladesh) আত্মপ্রকাশ করে যা সংক্ষেপে সিবিসিবি নামে পরিচিত। ১৯৭১ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ: ৫০ বছরের এ পথ অতিক্রম করে সিবিসিবি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মহানন্দে পালন করছে এর সুবর্ণ জয়ন্তী। আনন্দ-অনুভূতি ও আবেগের সংমিশ্রণে সৃষ্ট কৃতজ্ঞতার মাহেন্দ্রক্ষণ এই জয়ন্তী-বর্ষ।
অনুষ্ঠানে মূলবক্তব্য উপস্থাপন করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও ও কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও, সিএসসি। অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং, অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা, এমপি, কারিতাস এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. বেনেডিক্ট আলো ডি রোজারিও, ব্রাদার সুবল রোজারিও সিএসসি, ফাদার মার্কুস মূর্মূ, হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা গমেজ, সিএসসি, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও মিসেস মনিকা বাড়ৈ।
বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’র সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিশ্বাস বিস্তার সংস্থার প্রধান কার্ডিনাল তাগলে তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, আপনারা বিগত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ মণ্ডলির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সেবাকাজ, পালকীয় কাজ এবং প্রেরণকাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে আপনাদের উপস্থিতি ক্ষুদ্র থাকা সত্ত্বেও আপনারা সেই কাজ ও স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে মহান সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। জুবিলী উৎসব হলো আমাদের অতীতের কাজগুলোর দিকে ফিরে তাকানো । যা কিছু সুন্দর হয়েছে তার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো। সেই সাথে জুবিলী আমাদেরকে বর্তমান বাস্তবতায় পালকীয় কাজের চ্যালেঞ্চগুলো অনুধ্যান করার এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের একটি বিশেষ সময়। জুবিলীর একটি দীঘস্থায়ী ও সুদৃঢ় বিবেচ্য বিষয় হতে পারে ভালবাসাপূর্ণ দয়ার কাজের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টিয় জীবনের সাক্ষ্য দান করা, যা হলো সম্প্রীতি ও শান্তির চাবিকাঠি।
এশিয়ান বিশপ কনফারেন্সর (এফএবিসি’র) সভাপতি কার্ডিনাল চার্লাস বো, সিবিসিবির সুবর্ণ জুবিলী উপলক্ষ্যে তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মেলনীর সুবর্ণ জুবিলী পালন করছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের এ মহতী অনুষ্ঠানে সকলকে প্রার্থনাপূর্ণ শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের মিয়েনমারের মণ্ডলিও আশীর্বাদিত হচ্ছে এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যুক্ত হতে পেরে। এফএবিসি ও মিয়েনমারের বিশপ সম্মিলনীর পক্ষ থেকে এ সুবর্ণ জয়ন্তীতে আপনাদের প্রতি রইল অনেক অনেক প্রার্থনাপূর্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সুবর্ণ জয়ন্তীর আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সিবিসিবি’র প্রেসিডেন্ট ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ বিজয় এন.ডি ক্রুজ, ওএমআই বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত এই জন্য যে, আজ আমরা বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মেলনীর সুবর্ণ জুবিলী পালন করতে পারছি। এই মুহূর্তে আমি যখন চিন্তা করি, তখন মনে আসে এই সম্মিলনী বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলিকে একত্রে পথ চলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশপগণ প্রতিবছর চারবার মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশপ ও ধর্মপ্রদেশগুলোর মধ্যে একটা একাত্মতা ও ভ্রার্তত্বের দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। এই একাত্মতা, সহভাগিতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রত্যেকটি ধর্মপ্রদেশকে শক্তিশালী করেছে।
সিবিসিবি’র সেক্রেটারি জেনারেল বিশপ পল পনেন কবি বলেন, আজ বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনী’র এই মহান জুবিলী পালনের বিশেষ দিনে, পরম পিতা মহান সৃষ্টিকর্তাকে প্রথমত: ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি, পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদেরকে পরিচালনার জন্য ভালবাসা ও আর্শীবাদ দানের জন্য। আমরা ধন্যবাদ দেই বাংলাদেশের জীবিত ও পরলোকগত সকল বিশপদেরকে, যাঁদেও নেতৃত্বে ও প্রেরণাদায়ক সুপরিচালনায় বাংলাদেশ মণ্ডলি এগিয়ে যাচ্ছে, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে উৎকর্ষ সাধন হয়েছে।
সিবিসিবি এর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে উপস্থিত মি: চন্দন তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী এর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব ১৯৭১-২০২১ খ্রি: আজকের সকল ধর্মপ্রদেশ থেকে ভক্তজনগনের উপস্থিতি, সকল ব্রাদার, সিস্টার, ফাদার বিশপগণের উপস্থিতির একটি সার্থক অনুষ্ঠান। আমি সিবিসিবির ইতিহাস ও এর ক্রমাগত সাফল্যমন্ডিত কর্মসূচীসমূহ জানতে পেরেছি। আজকের আলোচনার প্রেক্ষিতে আগামী দিনে যিশু শিক্ষামতো আমারাও যেন আলো ও লবণ হয়ে মানুষের মাঝে কাজ করে যেতে পারি। সকলকে জানাই সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভেচ্ছা ও স্বাগতম।
সুবর্ণ জুবিলীতে অংশগ্রহণকারী মিসেস রীতা তার অনুভ’তি ব্যক্ত করেন ঠিক এই ভাবে, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর জুবিলীর এই শুভক্ষণে সকলের প্রতি তার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, কাথলিক বিশপ সম্মিলনী ভাংলাদেশে কাথলিক সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রেখে চলেছে। এই পথ চলায় কান্ডারী হিসেবে আছেন ১ জন কার্ডিনাল ও ৯ জন বিশপ। নারী দফতরের কনভেনর হিসেবে এই জুবিলী ক্ষণে আমার প্রত্যাশা সিবিসিবি হতে যেন নারী নেতৃত্বেও বিকাশের জন্য আরও বেশী অবদান রাখা প্রয়োজন। আমি বলব শুধুমাত্র পরিকল্পনা নয় বরং বাস্তবে যেন তাদের প্রতিশুতির প্রতিফলন ঘটে।
এই মহতী উপলক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের প্রতিনিধি আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, প্রিয় বিশপগণ, যাজকগণ,ব্রতধারি-ব্রতধারিনীগণ এবং প্রিয় খ্রিস্টভক্তগণ আমি সিবিসিবি’র সুবর্ণ জয়ন্তীতে আপনাদের সকলকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশ মণ্ডলি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। মণ্ডলিকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রাখার জন্য বিশপগণ তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রদেশে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই আমার প্রার্থনা, বাংলাদেশ মণ্ডলি যেন আরো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
একইদিন বিকেলে তেজগাঁও গির্জায় ছিল সিবিসিবির কমিশনসমূহের কার্যক্রমভিত্তিক ষ্টল উদ্বোধন, সিবিসিবি’র সেক্রেটারি জেনারেল ও ময়মনসিংহের ধর্মপাল বিশপ পনেন কুবি, সিএসসির শুভেচ্ছা বক্তব্য, ডকুমেন্টারী প্রদর্শনী, খ্রিস্টযাগ (প্রার্থনা) ও স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন ইত্যাদি।
বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী এ দেশের খ্রিস্টমণ্ডলি, খ্রিস্ট বিশ্বাসী ও আপামর জনসাধারণের জন্য ঈশ্বরের এক অনন্য উপহার। বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ মণ্ডলি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে এর অবদান এবং অর্জন অসামান্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র আত্মার শক্তিতে পরিচালিত হয়ে যুগ-লক্ষণ ও যুগের প্রয়োজন অনুসারে “ঐশরাজ্য” অর্থাৎ ভালবাসা, ন্যায্যতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ঐশ ইচ্ছা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী সচেষ্ট। ঈশ্বরের অনুগ্রহে বিভিন্ন ব্যক্তি, কমিশন, কমিটি, ডেস্ক, সংস্থা ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে এই মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাবে বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী এটিই আমাদের প্রার্থনা ও প্রত্যাশা।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু কোড়াইয়া