বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগ দিবস
ভাষান্তরে- ফা: সুনীল রোজারিও
ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট : ক্যাথলিক চার্চ প্রতি বছর পঞ্চাশত্তমী রবিবারের আগের রবিবার বিশ্ব যোগাযোগ দিবস পালন করে থাকে। আবার এদিনই খ্রিস্টমণ্ডলিতে পালিত হয় প্রভু যিশুর স্বর্গারোহণ মহাপর্ব। আজকের স্বর্গারোহণ মহাপর্বে মঙ্গলসমাচার পাঠের মূল বাক্য হলো, “তোমরাই এই সবকিছুর সাক্ষী রইলে (লুক ২৪:৪৮)।” যিশু স্বর্গে উন্নীত হওয়ার ঠিক পূর্বমুহুর্তে শিষ্যদের এই কথা বলেছিলেন।
দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার পরে পরেই পোপ ৬ষ্ঠ পল ক্যাথলিক চার্চে বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগ দিবস পালনের ঘোষণা দেন এবং ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে রবিবার প্রথম বিশ্ব মণ্ডলিতে বিশ্ব সামজিক যোগাযোগ দিবস পালিত হয়। এই ঐতিহাসিক দিবসে পোপ ৬ষ্ঠ পলের বাণী ছিলো, “চার্চ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।” পোপ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, চার্চকে প্রকৃতপক্ষে আধুনিক জগতের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। পোপ ৬ষ্ঠ পল- দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা চলাকালীন সময়ে- পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিনিধিদের ভাষা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আধুনিক মানব সভ্যতা ও তার ইতিহাসের অংশ থেকে চার্চ আলাদা নয় এবং সেই সঙ্গে এটাও বুঝেছিলেন যে, আধুনিক গণমাধ্যমের শক্তিশালী প্রভাব সমাজ-সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। পরবর্তীকালে পোপগণ, প্রতি বছরই দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ বাণী দিয়ে আসছেন এবং সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের ভালো-মন্দ প্রভাবগুলো চিহ্নিত করে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। পোপ ২য় জন পল যেমন বলেছিলেন, বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো আধুনিককালের একটি ব্যবস্থাপত্র, যা গোটা মানবজাতিকে একত্রিত ক’রে একটা বিশ্ব পল্লীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। তিনি আধুনিক যুগের যুবসমাজকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “আজকের যুবসমাজ এমন একটি সময়ে বেড়ে উঠছে যখন বিশ্বটা গণমাধ্যম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।” গত ২০২১ খ্রিস্টাব্দে পোপের বাণীর মূল বিষয় ছিলো, “এসো দেখে যাও” আর এবছর বেছে নিয়েছেন, ”হৃদয়ের কানদিয়ে শ্রবণ করো।”
পোপের বাণী
৫৬তম বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগ দিবস- ২০২২
প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
গত বছর আমরা অনুধ্যান করেছিলাম “এসো দেখে যাও” যেনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা আবিষ্কার করতে পারি। একই ধারা অব্যাহত রেখে আমি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই “শ্রবণ” ধ্বনির দিকে, যা যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যকরণসরূপ ও উপযুক্ত সংলাপের একটি শর্ত।
বস্তুতপক্ষে: আমাদের মুখোমুখি যারা রয়েছেন তাদের “শ্রবণ” করার সামর্থ আমরা হারাচ্ছি- হারাচ্ছি, দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন সম্পর্কে এবং হারাচ্ছি, নাগরিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতায়। অন্যদিকে একই সময়ে যোগাযোগ ও তথ্য পরিবেশনার বিভিন্ন মাধ্যম নতুনতায় উন্নত হচ্ছে ও নিশ্চিত করছে যে, “শ্রবণ” করা মানব জীবনে এখনো একটি প্রয়োজনীয় জায়গা।
একজন সম্মানীত চিকিৎসকের দায়িত্ব ক্ষত নিরাময় করা এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, মানুষের জীবনে বড় প্রয়োজন কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “শ্রবণ করার সীমাহীন ইচ্ছা।” ইচ্ছা অনেক সময় গোপনই থাকে কিন্তু তাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, যারা শিক্ষক, গঠনদানকারি বা অন্যভাবে যোগাযোগ ভূমিকা রাখেন- যেমন, পিতামাতা-শিক্ষক, পালক-পালকীয় কর্মী, পেশাদারি যোগাযোগ কর্মী এবং যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক সেবা দান করেন।
হৃদয়ের কানদিয়ে শ্রবণ করো : মঙ্গলবার্তার বিভিন্ন অধ্যায় থেকে জেনেছি যে, “শ্রবণ” মানে শুধু ধ্বনি উপলব্ধি নয়- কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বর ও মানব জীবনের মধ্যে একটি সংলাপীয় সম্পর্ক। বাইবেলের আইনগ্রন্থে ঈশ্বরের প্রথম নির্দেশ ছিলো, “হে ইস্রায়েল শোনো (২য় বিবরণ ৬:৪),” যা বিরামহীনভাবে বাইবেলের বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে। এই ব্যাপারে সাধু পৌল নিশ্চিত ক’রে বলেন, “বিশ্বাস আসে শ্রবণেই (রোমীয় ১০:১৭)।” বাস্তবিকভাবে ঈশ্বরই উদ্যোগ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁকে উত্তর দিই “শ্রবণ” ক’রে। এই “শ্রবণ” আসে ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে- যেমন সদ্যজাত শিশু তার পিতা মাতার কন্ঠ শুনে অনুমান করে। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে যা ঈশ্বরের কাছে অধিক মনোনীত তা হলো “শ্রবণ”, কারণ তা কম আক্রমণমূলক এবং দৃশ্যতা থেকেও বেশি আবেদনমূলক, যার ফলে মানুষ বেশি বেশি স্বাধীন থাকতে পারে।
“শ্রবণ” ঈশ্বরের মহানুভবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা হলো কর্মোদ্যোগ যার মধ্যদিয়ে ঈশ্বর নিজেকে একজন বক্তা, তাঁর সাদৃশ্যে নারী-পুরুষ সৃষ্টি এবং তাদের “শ্রবণ” ক’রে নিজের সঙ্গে সংলাপের অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ঈশ্বর মানবতাকে ভালোবাসেন এবং সেই কারণে তিনি তাঁর বাণীতে তাদের সম্বোধন করেন এবং তাদের শোনার জন্যে “তাঁর কর্ণ অবনত” করেন।
অন্যদিকে মানুষের প্রবণতা হলো সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়া, পিছন দিকে ফিরা এবং “কান বন্ধ করা” ফলে তারা শুনবে না। এই না শোনা শেষ পযর্ন্ত অন্যের প্রতি আক্রমনাক্তক রূপ নেয়, যেমন স্তেফানের প্রতি আক্রোশে “মহাসভার সদস্যেরা জোর গলায় চিৎকার করে কানে আঙ্গুল দিলেন (শিষ্য ৭:৫৭)।”
একদিকে ঈশ্বর সর্বদা স্বাধীনভাবে যোগাযোগ ক’রে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং অন্যদিকে, নারী-পুরুষকে অনুরোধ করেন- শোনার জন্য আগ্রহী হ’তে। সদাপ্রভু পরিপূর্ণভাবে মানুষকে আহ্বান করেন তাঁর ভালোবাসার সন্ধি হওয়ার জন্য, যেনো তারা যা, তা পূর্ণভাবে হয়ে উঠতে পারেন: যেমন তারা হয় ঈশ্বরের সদৃশ্য, শোনার সামর্থ, অভিনন্দন জানানো, অন্যকে স্থান দেওয়া ও মৌলিকভাবে ভালোবাসার আশ্রয়ে এক শ্রবণেন্দ্রিয়।
সেই কারণে যিশু তাঁর শিষ্যদের শ্রবণমাণ মূল্যায়ন করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “তাই তোমরা যে এখন কীভাবে এইসব কথা শুনছো, সেই বিষয়ে সাবধান থেকো (লুক ৮:১৮)।” বীজ বুনিয়ের উপমা কাহিনী শেষে তিনি শিষ্যদের বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র শোনাই যথেষ্ট নয়- কিন্তু শুনতে হবে নির্ভুলভাবে। আর যারা “সৎ উদার প্রাণে” বাণী শু’নে তা আঁকড়ে ধরে রাখে তারা নিজেদের কর্তব্য-নিষ্ঠায় ফলশালী হয়ে ওঠে (লুক ৮:১৫)। এটা হতে পারে আমরা কাকে শুনছি, কী শুনছি এবং কীভাবে শুনছি- যার মধ্যদিয়ে আমরা যোগাযোগ দক্ষতায় বেড়ে ওঠি এবং যা শুধুমাত্র মতবাদ বা কৌশল নয় কিন্তু “হৃদয় উন্মুক্ত ক’রে উপযুক্তভাবে কাছে নেওয়া (বর্তমান জগতে খ্রিস্টমণ্ডলি)।”
আমাদের প্রত্যেকের শ্রবণেন্দ্রিয় রয়েছে কিন্তু উপযুক্তভাবে শোনার সক্ষমতা থাকলেও অনেক সময় অন্যকে শুনতে ব্যর্থ হই। বাস্তবে, আমাদের অন্তরের বধিরতা শারীরিক বধিরতার চেয়ে অধিকতর অসুস্থ। প্রকৃতপক্ষে “শ্রবণ” হলো গোটা ব্যক্তিব্যাপী উপলব্ধি- কিন্তু শুধুমাত্র শোনা নয়। উত্তম শ্রবণের উত্তম আসন হলো হৃদয়। যদিও রাজা সলোমন মাত্র যুবক ছিলেন, তবুও তিনি নিজেকে উত্তম বিবেচক হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন, কারণ তিনি সদাপ্রভুর কাছে একটি “শ্রবণদয়ী হৃদয়” যাঞ্চা করেছিলেন (১ রাজা ৩:৯)। সাধু আগস্টিন অনুপ্রাণিত করতেন হৃদয় দিয়ে শোনার জন্যে- বাণী শ্রবণ বাহ্যিক কান দিয়ে নয় কিন্তু হৃদয়ের আধ্যাক্তিকতা দিয়ে। তিনি বলেছেন, “তোমার কানের মধ্যে হৃদয় রেখো না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে তোমার কান রেখো।” আসিসির সাধু ফ্রান্সিসও তাঁর সহকারিদের বলতেন, “তোমার হৃদয়ের শ্রবণেন্দ্রিয় উন্মুক্ত করো।”
সুতরাং যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রকৃত শ্রবণের প্রথম আবিষ্কার হলো- অন্যের আত্মকে এবং অন্যের সত্যিকার প্রয়োজনকে শোনা- যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরাত্মা বিরাজ করছে। উপযুক্তভাবে শ্রবণের মধ্যদিয়ে আমরা নিজেদের সৃষ্টির মধ্যে উত্তম হিসেবে প্রমাণ করতে পারি এবং অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। আমরা অনু হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য নয় কিন্তু একসঙ্গে বেঁচে থাকার জন্যে।
উত্তম যোগাযোগের শর্ত হলো শ্রবণ : এক ধরনের শ্রবণ আছে যা প্রকৃত শ্রবণ নয়- কিন্তু বিপরীত এবং আড়িপাতা মাত্র। বাস্তবতা হলো, আড়িপাতা এবং গুপ্তচরবৃত্তি করা হলো নিজের ধান্ধায় অন্যকে অপব্যবহার করা- যা আজকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিনে সম্ভবত অধিকহারে এবং সুক্ষভাবে প্রলোভন তৈরি করছে। বরং সুচিন্তিত ও সুস্থ যোগাযোগ হলো মানবিকভাবে সামনা-সামনি, মুখোমুখি শোনা এবং যাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হয় তাদের সুহৃদভাবে, বিশ্বস্থভাবে এবং সৎ ও খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করা।
আমরা প্রতিদিন যে না শোনার অভিজ্ঞতা করি, দুঃখজনকভাবে নাগরিক জীবনেও যা স্পষ্ট- তা হলো অন্যকে শোনার পরিবর্তে “একে অন্যে অতীত নিয়ে কথা বলি।” বাস্তবিকভাবে এটা হলো এক ধরনের উপসর্গ, সত্য ও ভালোকে না খোঁজে মতনৈক্য খোঁজা এবং না শুনে বরং দর্শকদের দিকে মনোযোগ দেওয়া মাত্র। উত্তম যোগাযোগ কোনো সময় শব্দ-ধ্বনি দিয়ে মানুষকে অভিভূত করতে চায় না, কিন্তু অন্যের কারণসমূহের দিকে নজর দেয় এবং বাস্তবতার মধ্যে যে জটিলতা বিদ্যমান তা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। এটা দুঃখজনক এমনকি চার্চের মধ্যেও যখন এই ধরনের চিন্তারীতি তৈরি হয়- যার ফলে শ্রবণ প্রবণতা অদৃশ্য হয়ে যায় এবং জেগে ওঠার শুরুতেই বন্ধ্যা হয়ে যায়।
বাস্তবে, অনেক ক্ষেত্রে সংলাপে আমরা আদৌ যোগাযোগ স্থাপন করি না। আমরা মাত্র অপেক্ষা করি অন্যে কখন তার বক্তব্য শেষ করবে যেনো আমরা আমাদের মতাদর্শ পেশ করতে পারি। এই প্রসঙ্গে দার্শনিক আব্রাহাম কাপলান বলেছেন, “সংলাপ হলো কথোপকথন: একলাপ নাটকে দ্বৈত কন্ঠ।” সত্যিকার যোগাযোগ হলো- “আমি” এবং “তুমি” একে অন্যের কাছ থেকে দূরে রাখা।
সুতরাং শোনা হলো সংলাপ ও উত্তম যোগাযোগের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। যোগাযোগ কখনো স্থান করে নিতে পারে না- যদি সেখানে শোনার অবসর না থাকে এবং ভালোভাবে শোনার সামর্থ না থাকলে সেখানে ভালো সাংবাদিকতা থাকতে পারে না। উপযুক্ত, ভারসাম্য এবং তথ্যসমৃদ্ধের জন্য বর্ধিত সময় নিয়ে শোনা প্রয়োজন। কোনো ঘটনা ও অভিজ্ঞতার বার্তা বর্ণনার জন্য, কীভাবে শুনতে হয় তা অন্তত্য জরুরি যেনো অন্যের মনের পরিবর্তন ও প্রাথমিক ধারণার পরিবর্ধন করা যায়।
একলাপ দূরে সরিয়ে একমাত্র বহুকন্ঠ দ্বারাই সত্যিকার যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। “প্রথম সরাইখানায় না থেমে” বিভিন্ন উৎস থেকে “শ্রবণ” যেমন শিক্ষাকে জোরদার করে, তেমনি প্রচারিত তথ্যসমূহের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন কন্ঠ থেকে শোনা, একে অন্যকে শোনা, এমনকি মণ্ডলিতে ভাই-বোনের মধ্যে শোনা হলো একটি শিল্পের অনুশীলন যা আমাদের সামর্থকে প্রকাশ ক’রে ঐক্যতানসঙ্গীত রচনা করে।
কিন্তু কেন শ্রবণ আমাদের মোকাবেলা করতে হবে ? ভাটিকান সিটির প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ আর্চবিশপ আগস্টিন কাসারোলি বলতেন, “সহিষ্ণুতার শহীদবরণ” লাভের মতো শ্রবণ করা। কিন্তু কথোপকথন একটি শক্তমাথার দলের সঙ্গে খুবই কঠিনযোগ্য কাজ- যার মধ্যদিয়ে নূন্যতম ভালো ও স্বাধীন চেতনা অর্জন করা যায় না। তবুও মনে রাখতে হবে- শ্রবণ করার জন্য সহিষ্ণুতার গুণ থাকা প্রয়োজন। বিস্ময়ানন্দের মধ্যদিয়ে জ্ঞানাজর্ন সম্ভব- যেমন একটি শিশু অসীম বিস্ময় নিয়ে প্রসারিত চোখে তার চারিদিকের বিশ্বকে দেখে। ঠিক মনের এই কাঠামো নিয়ে, শিশুর চোখের এই বিস্ময় নিয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি অন্যের কাছ থেকে শিক্ষালাভ ক’রে সচেতন ও সমৃদ্ধশালী হয়ে জীবনকে ফলদায়ী করে তুলতে পরেন।
বর্তমান এই মহামারিকালে সমাজের কন্ঠ শোনা ইতিহাসের মধ্যে অন্যতম সময়। অনেক আনুষ্ঠানিক তথ্য ঘোষণার অযোগ্যতা তথ্যমহামারির কারণ হয়েছে- যার কারণে বিশ্বের তথ্যপ্রবাহ তার গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে সংকটাপূর্ণ হয়েছে। সুতরাং আমাদের শ্রবণেন্দিয়কে অবনত করতে হবে- সঠিকভাবে শ্রবণের জন্য, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো, যা সমাজের মধ্যে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করেছে।
বলপ্রয়োগ অভিবাসন একটি বাস্তবতা এবং জটিল বিষয়। এই বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য কারো কাছে তৈরি সঠিক কোন উত্তর নেই। আমি পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই যে, অভিবাসীদের নিয়ে এই বৈষম্য দূর করতে হলে কঠিন হৃদয় নরম করতে হবে এবং তাদের জীবনের গল্প শুনতে হবে। প্রত্যেককেই দিতে হবে নতুন নাম এবং একটি নতুন গল্প। অনেক জনপ্রিয় সাংবাদিক এই কাজটি করছেন এবং সম্ভব হলে অনেকেই তা করতে চাচ্ছেন। আসুন তাদের অনুপ্রাণিত করি এবং এই গল্পগুলো শুনি। তাহলেই প্রত্যেকে অভিবাসন নীতি সমর্থন করবে- এবং নিজ দেশের জন্য যা প্রয়োজন তা বিবেচনা করবে। তবে সবকিছুর পূর্বে আমাদের নজর দিতে হবে সংখ্যার দিকে নয়, শক্তির ভয়াবহতার দিকে নয়- কিন্তু তাদের মুখোমুখি হওয়া ও গল্প শোনা এবং নর-নারী হিসেবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করা।
মণ্ডলিতে একে অন্যকে শোনা : মণ্ডলিতেও অতি প্রয়োজন রয়েছে শোনা এবং একে অন্যকে শোনার। আমরা অন্যের জন্য মূল্যবান ও জীবনভিত্তিক দান অর্পণ করতে পারি। খ্রিস্টভক্তগণ ভুলে গেছেন যে, এই শ্রবণীয় পালকীয় কাজ তাদের উপর ন্যস্ত করেছেন এমন একজন, যিনি প্রকৃত শ্রবণকারি যেনো তারা অন্যের সঙ্গে সহভাগিতা করতে পারেন। আমাদের শুনতে হবে ঈশ্বরের শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে এবং তাঁর কন্ঠদিয়ে কথা বলতে হবে। প্রটেস্টান্ট ঐশতত্ত্ববিদ দিয়েট্রিস বনহোফার আমাদের স্মরণ করে দিয়ে বলছেন যে, “অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আমাদের প্রথম করণীয় হলো তাদের “শ্রবণ” করা। যে ব্যক্তি তার ভাই-বোনকে শুনতে শিখেনি, অচিরেই সে ঈশ্বরকে না শোনার সামর্থ অর্জন করবে।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পালকীয় কর্মকান্ড হলো “শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রৈরিতিক কাজ।” বলার আগে শুনতে হবে- যেমনটি বলেছেন সাধু যাকব তাঁর ধর্মপত্রে, “শুনতে সবাই আগ্রহী থাকুক, কিন্তু কেউ যেন সহজে মুখ না খোলে (১:১৯)।” স্বাধীন ইচ্ছায় অন্যকে শোনার জন্য কিছু সময় বরাদ্দ করা হলো ভালোবাসার প্রথম কাজ।
মণ্ডলিতে এখন সিনোডাল চার্চ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আসুন প্রার্থনা করি যেনো এই মহাসুযোগ হয়ে ওঠে- একে অন্যকে শোনা। সম্পর্কটা পদ্ধতিগত বা আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়- কিন্তু নির্মিত হয়ে ওঠে ভাই-বোনদের মধ্যে পারস্পরিক শোনার মধ্যদিয়ে। একটি সঙ্গীতদলে ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠ একসঙ্গে মিলে তৈরি হয় বহু কন্ঠনির্ভর একটি গীত। একই সময়ে, সঙ্গীতদলের প্রতিটি কন্ঠ অন্য কন্ঠগুলোর সঙ্গে মিল থেকে একটা পুরো সমন্বিত সঙ্গীত হয়ে ওঠে। সুরের এই ঐক্যতান তৈরি করে একজন পরিচালক আর সমন্বিত সঙ্গীত হয়ে ওঠে প্রত্যেকের ও সবার আলাদা আলাদা কন্ঠসুরে।
এই উপলব্ধিটা আমলে নিয়ে আমরা নিজেদের জড়িত করবো অংশগ্রহণে যেন আমরা পুন:আবিষ্কার করতে পারি সমন্বিত খ্রিস্ট-মণ্ডলি, যেখানে সবাই নিজ নিজ ও ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠে গাইতে পারেন এবং একে অন্যের কন্ঠধ্বনিকে একটি দান হিসেবে স্বাগত জানিয়ে পবিত্র-আত্মার তৈরি সুরে হয়ে ওঠতে পারে একটা সমবেত-সমন্বিত সঙ্গীত।