জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া

অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষ বিপরীত। মানুষের এমন কিছু গুণাবলী রয়েছে যা শুধুই মানুষের এখতিয়ারে। দর্শনের আলোকে বলা যায়, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন যুক্তিবাদী প্রাণী। এই দু’টি গুণ যদি মানুষকে দেওয়া না হতো তাহলে অন্যান্য প্রাণীদের মতোই হতো মানুষের সমস্ত কাজকর্ম। মানুষ যদি যুক্তিবাদী না হতো তাহলে সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু অনেকে এই যুক্তিকেই ভয়ের প্রথম ধাপ হিসাবে দেখে থাকে; যা নিজের কুপমণ্ডকতা প্রকাশ হয়ে যাবে বলে; না নিজের একছত্র আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে সেই ভয়ে তা ব্যক্তিমাত্রই ভালো বলতে পারে। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ব্যক্তি বিশেষে বলা যায় যে, এই দু’ধারি কৃপাণের আঁচড় যদি একবার তার লাগে তাহলে সে ঘা বড়ই মারাত্মক। সহজে শুকাতে পারে কিনা সে চিন্তায় অনেকে দিনরাত এক করে ফেলে। বুদ্ধি থাকলে যুক্তি যে সহজেই আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার যুক্তিও যে বুদ্ধি বাড়াতে এবং বুদ্ধিকে শাণিত করতে সাহায্য করে। একটি শিশুর প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপন যুক্তিরই নামান্তর; আর সেই যুক্তিই তাকে জানতে আগ্রহী করে। কিন্তু যারা জানতে চায় না তারা যুক্তিকে বরং পাশ কাঁটিয়ে চলতে চায়। ভয় হয় যদি ধরা পড়ে যাই। আর কোনভাবে যদি ধরাও পড়ে যায় তাহলে মিথ্যা, রাগ, অহংকার ও নিজের চিন্তাকেই প্রাধান্য দেবার মধ্য দিয়ে নিজেকেই সকলের সামনে খাঁটো করে ফেলে। সে খাঁটো এমনই যে আর কখনো সে পাশাপাশি লোকের সান্নিধ্যে আসতে পারে না।

জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মতো নিজেকে বড় করে দেখানোর মনোভাবের কোন সীমা নেই। নিজেকে উচ্চাসনে বসিয়ে সে আসনে অনন্ত দখল নিতে যেন বদ্ধপরিকর। তখন অন্যের কাজে নাক গলানোর ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত হয়ে এগিয়ে যায় নিজের আমিত্ত্বটাকে বড় করে দেখাতে। আর এই আমিত্ত্বটা মাথার মধ্যে এমনভাবে ঘুরপাক খেতে থাকে যে, বারে বারে তখন মন্দিরে প্রার্থনারত সেই ফরিশীর মতো ভণ্ড হয়ে অন্যকে দেখিয়ে বলে- এই তো আমি অন্যদের মতো নই; আমি সবার চেয়ে ভালো। ওরা ভুল করে আর আমিই একমাত্র ঠিক। আহাম্মকের এই যে মিথ্যা আস্ফালন তা লোকে কিন্তু সহজে ধরে ফেলে। ধরে ফেলে যত সব ছলচাতুরী। ধরা আর না ধরার খেলা যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাথে সাথে চলছে। পুলিশ যেমন চোর ধরে, চোর যেমন গৃহস্থের মূল্যবান সম্পদের ঝোলা ধরে তেমনি দৃষ্টিকটু মনোভাব যার সে শুধু অন্যের দোষ ধরার ধান্ধায় থাকে। “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা” প্রবাদবাক্যটি তখন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। এখানেও দেখা আর না দেখা, ধরা আর না ধরার বিষয়টি আপনি এসে যায়। পথে বের হলেই চোখের কোণে কতকিছু ধরা পড়ে। ভালো কিংবা মন্দ সবই এসে একসাথে জড়ো হয়। তবে মৌমাছির মতো হবার বাসনা খুব কম লোকেরই মাঝে বিদ্যমান থাকে। কোনটা ধরবো আর কোনটা ছাড়বো এই বুদ্ধি যদি পরিপূর্ণ বয়সেও না জাগে তাহলে বৃথা তার এত পরিশ্রম। যেটা ধরার নয় সেটা ধরেই যদি বলি, এইবার ধরেছি; তাহলে মিথ্যানন্দ আর নিজের বাহাদুরী সবই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন লোকে স্পষ্ট বুঝে ফেলে সীমাবদ্ধতার মিথ্যা লম্ফঝম্প। সে তখন অন্যের হাসির খোরাক হতে আর বেশী দূরে অবস্থান করে নেই।

ক্ষমতা আর দায়িত্বকে অনেক সময় এক করে ফেলার প্রবণতা অনেকের মাঝেই দেখা যায়। দায়িত্বকে ক্ষমতা ভেবে স্বৈরাচারী শাসনের মতো আচরণ তো নিজের সাথে নিজেরই প্রবঞ্চনা বিনা কিছুই নয়। দেশ, কাল, সমাজ, জাতি, গোষ্ঠী, দল ও নিজের সাথে নিজেরই এই প্রথা বিরুদ্ধ আচরণ যেন সময়ের কালচক্র থেকে ছিট্কে বেরিয়ে যাওয়া। উন্নতির চক্রজাল যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তার লাভ করছে তা দৃষ্টিকোণে ধরা পড়ে না। বরং ধ্বংসকারী ঘূর্ণিঝড় হয়ে মূহুূর্তের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড করে ফেলে সমস্ত চিন্তা-চেতনার নব নব দুয়ার। চিন্তা-চেতনায় স্থবিরতা আর ভয়ের চাষ যেন দূর্ণিবার হয়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নে যেমন চারটি উত্তর দেওয়া থাকে; সেখান থেকে একটিকে সঠিক বলে ধরে নিয়ে তবে ঘর পূরণ বা টিক্ চিহ্ন দিতে হয়। যদি বাছাই-এর ক্ষেত্রে ভুল হয় তবে এই মাশুল নিজেকে যেমন গুণতে হয়; ঠিক তদ্রুপ ইতিবাচক আর নেতিবাচক যেন নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তরের মতো। ইতিবাচক হবো না নেতিবাচককেই আকড়ে ধরে পথে বের হবো তা নিজেকেই ঠিক করে নিতে হয়। তবে নেতিবাচক হওয়াটাই বুঝি সবচেয়ে সহজ কাজ। শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন; এর বাইরে আর কিছুই নয়। ইতিবাচক আর নেতিবাচককে পয়সার এপিঠ আর ওপিঠের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পয়সা যেমন উল্টে গিয়ে অপর পিঠকে প্রদর্শন করে তেমনি ইতিবাচক হয়েও পয়সার মতো হঠাৎ উল্টে গিয়ে নেতিবাচক হওয়া যায়। কিন্তু নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক হতে গেলে কাঠখড় পুড়াতে হয় অনেক। কারণ অভ্যাস তো আর সহজে বাদ দিয়ে দেওয়া যায় না।

আমাদের খ্রিস্টীয় জীবনের সব সাধনা যিশু ধ্যানে। যিশুর মধ্যে যা ছিলো তা আমাদের মধ্যে চর্চা করাই মহত্ত্বের লক্ষণ। কিন্তু মুখে বলি এক করি আরেক। এই যে বলা আর করার মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য আর ফারাক সেখানেই আমাদের অদৃশ্য জবাবদিহিতা নিহিত। আমরা ধর্মকে যতটুকু ভালবাসি ততটুকু যদি যিশুকে ভালবাসতাম তাহলে বদলে যেত নিজের সমস্ত ভণ্ডামীর ভান্ডার। মাটির উপর রং লাগালে যেমন মাটির আসল সৌন্দর্যে ভাটা পড়ে তেমনি আমরাও মাটির উপর রং লাগানোর মতো নিজেদের অবয়বে রং লাগিয়ে বসে বসে ধ্যানের আসন গড়ি। মিথ্যা আর মিথ্যার সমস্ত লেজ বাড়তে থাকে অবলীলাক্রমে। মাটির উপর রং লাগিয়ে সং সাজার মধ্যে মাহাত্ম নয়; বরং নিজেকে নিজের মতো প্রকাশেই গুপ্ত মাহাত্ম ও সৌন্দর্য।

Please follow and like us: