ড. ফাদার শংকর ডমিনিক গমেজ
অধ্যক্ষ
সেন্ট যোসেফস্ স্কুল ও কলেজ, বনপাড়া
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মিলন কেন্দ্র, যেখানে শিক্ষক শিক্ষাসেবার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করেন এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাশরুমে বসে শিক্ষালাভ করে ও তাদের স্বপ্ন পূরণ করে। শিক্ষা দানের এবং শিক্ষা লাভের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম, এজন্য পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা কার্যক্রমের উত্তম স্থান, তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। সুসম্পর্ক থাকলে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হয়, অন্যথায় শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উভয়ের সচেতনভাবে পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে শিক্ষাসেবা চালিয়ে নিতে হয়। যদি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে না। আর সুসম্পর্ক না থাকলে শিক্ষা কার্যক্রমও সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায় না। শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার জন্য চাই পারস্পরিক সুসম্পর্ক।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি করে নিরাপদ পরিবেশ এবং শিক্ষকদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে আরো দক্ষ হয়ে উঠার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী করে (কলিন্স, ২০১১)। শিক্ষকগণই পারেন শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য যোগ্য ও দক্ষ করতে । যখন শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করে জ্ঞান লাভ করে এবং বুঝতে পারে যে তাদের বর্তমান অবস্থা তৈরীতে শিক্ষকের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে, তখনই তারা মাথা নত করে শিক্ষকের পদধুলি গ্রহণ করে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল সুসম্পর্ক শিক্ষার পরিবেশ নিরাপদ ও সহায়ক হয়। শিক্ষক সুন্দরভাবে শিক্ষা দান করতে পারেন এবং শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে শিক্ষা লাভ করে থাকে। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পরস্পরের মঙ্গল সাধনে নিয়োজিত থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ম-শৃংখলা উভয়ে সুন্দরভাবে পালন করে থাকে। যখন সবাই সুন্দরভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃংখলা পালন করে, তখন শিক্ষার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ হয় এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাল সম্পর্ক পরস্পরকে ভালবাসতে শিক্ষা দেয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। তারা শিক্ষকদের জন্য মঙ্গল কামনা করে এবং সম্মান রক্ষার জন্য কাজ করে। শিক্ষকদের সম্মানহানী হোক এমন কাজ থেকে নিজেদের দূরে রাখে। আর শিক্ষকগণও শিক্ষার্থীদের ভালবাসে এবং ভাল শিক্ষাদানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। সুসম্পর্ক থাকলে কখনো কেউ পরস্পরকে আঘাত করে না, বরং আঘাত যাতে না লাগে সেজন্য কাজ করে। এমনকি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করতে চেষ্টা চালায়। আর যদি সুসম্পর্ক না থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্লাশ করতে চায় না। ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়ন হয় না এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়। এজন্য তারা পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে যে শিক্ষকগণ ভালমত পড়ান না এবং শিক্ষার্থীরা পড়ে না।
বর্তমানে দেশে একটি বিষয় সবার মধ্যে আলোড়ন তুলেছে যে শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক খুন। তাছাড়া প্রায়ই শোনা যায় যে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে, লাঠি দিয়ে মারছে, খারাপ ভাষায় বকাঝকা করছে। এমনকি জুতোর মালা গলায় দিয়ে অপমান করছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষার্থীরা মানবিক মূল্যবোধ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তারা সুশিক্ষা গ্রহণ না করে কুশিক্ষায় বেড়ে উঠছে। যার পরিণামে পড়াশুনার পরিবর্তে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হচ্ছে এবং নানাবিধ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এভাবে শিক্ষার্থীরা আলোর রাজ্যে প্রবেশ না করে অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। পিতা-মাতাগণ অনেক সময় নিজ সন্তানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। কেননা, সন্তানকে শাসন করলে অনেক সময় তারা সুইসাইড বা আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পিতা-মাতা শাসন করতে পারছে না। অন্যদিকে, শিক্ষকগণ শিক্ষাক্ষেত্রে শাসন করতে পারে না, কেননা আইনি বাধা। শিক্ষকগণ নিজের সমস্যার কথা ভেবে শিক্ষার্থীদের শাসন করা থেকে বিরত থাকেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভাল করার চেয়ে মন্দ কাজেই বেশী জড়িত হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থা চলতে থাকলে দেশে ভবিষ্যতে ভাল শিক্ষার্থীদের চেয়ে খারাপ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং সমাজে অপরাধমূলক কাজ বেশী সংঘটিত হবে।
মানুষ্য সমাজে মানবিক মূল্যবোধ বেশী প্রয়োজন এবং মানবিক মূল্যবোধে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠুক, এটাই কাম্য। শিক্ষক ও অভিভাবকগণ নিজেরা প্রথমে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করি মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বেড়ে উঠতে এবং ভাল কাজে এগিয়ে আসতে। যদি পিতা-মাতা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই মিলে মানবিক কাজগুলি বেশী বেশী করি, তাহলে সমাজ ও দেশ থেকে অপরাধমূলক কাজ দূর হতো। আর শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক ও ভাল মানুষ হবে এবং তারা আলোর রাজ্যে বিচরণ করবে।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাইডেন্স কাউন্সিলিং বা পরামর্শ কেন্দ্র খোলা হলে ভাল হয় যেন শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে গাইড শিক্ষকের সাহায্য-পরামর্শ নিয়ে সমস্যা সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারবে। তাছাড়া শিশু সুরক্ষা নীতি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করা হলে শিশুরা বা শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হবে। আর শিক্ষকদের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব ও কতর্ব্য রয়েছে, তা সুন্দরভাবে পালন করবে। অন্যদিকে, শিক্ষকদেরও সচেতন হতে হবে তাদের গুনাবলীগুলি সম্পর্কে এবং প্রতিদিন অনুশীলন করতে হবে। শিক্ষকগণ যদি শিক্ষকতার সাথে সাথে তাদের গুণাবলীগুলি চর্চা করে আশা করি শিক্ষকগণও সহজে শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তুলবে না বা লাঠি ব্যবহার করবে না। শিক্ষকগণ সুন্দরভাবে প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে এবং তাদের ক্লাশ করার জন্য শিক্ষার্থীরা আরো মনোযোগী হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের ব্যবহার ভাল হয়, সেখানে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং শিক্ষা কার্যক্রম ভালভাবে চলবে ও শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে। এজন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা প্রয়াজন।