আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর কানাডা সফরের জন্য যে পালকীয় বাণী বেছে নিয়েছেন তা হলো, “ক্ষমার তীর্থযাত্রা” যা দেশের আদি মানুষের মধ্যেকার ক্ষতের সুস্থ্যতা দান ও পুনর্মিলন এনে দিবে বলে আশা করা হচ্ছে। পোপ গত রবিবার (জুলাই ২৪) ইটালির বাইরে তাঁর ৩৭তম পালকীয় সফরে কানাডার উদ্দেশ্যে ভাটিকান সিটি ত্যাগ করেন। তাঁর এই কানাডা সফরের মাত্র দুইদিন আগে রোম নগরীতে অবস্থিত মারীয়ার মহামন্দির (Basilica of Saint Mary Major) পরিদর্শন করে তাঁর সমীপে এই ক্ষমার তীর্থযাত্রা সফর উৎসর্গ করেন। গত ১৭ জুলাই পোপ সান্ধ্যকালীন তাঁর দূতসংবাদ প্রার্থনার সময় বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও কানাডা দেশে অনেক খ্রিস্টান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণ কৃষ্টিগত বৈষম্যের কারণে এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে নানাভাবে আদি জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।” এই ক্ষতি নির্মূল করে মিলনের যাত্রা সুগম করার জন্যে সে দেশের খ্রিস্টমণ্ডলি, সরকার এবং আদিবাসী জনগণ পোপকে কানাডা সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রথমেই যাত্রা বিরতী করবেন এডমন্টন, কুবেক এবং উত্তরের ইকালুট শহরে। এই শহরগুলোতে পোপ আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কানাডার আলবের্তা প্রদেশের রাজধানী এডমন্টন শহরে রয়েছে ইউক্রেনিয়ান জনগণ এবং তাদের চার্চ। এই কমিউনিটির বিশপ ডেভিড মথিউক বলেন, পোপের এই সফরে পুরনো ক্ষতের সুস্থতাদান করে ভক্তের মধ্যে পুনর্মিলন ও নবায়ন এনে দিবে। বিশপ ডেভিড, ইউক্রেনীয়ান গ্রীক ক্যাথলিক চার্চে পালকীয় কাজ করতে পেরে নিজের আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, “আজকের এবং ভবিষ্যত জনগোষ্ঠী যেন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করে পরকালের তীর্থযাত্রার পথে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারেন- তিনি এই বিষয়ে আশাবাদী।” কানাডার ৩৭ মিলিয়ন জনগণের যার মধ্যে দেড় মিলিয়ন ইউক্রেনীয় বংশভূত। এই জনগোষ্ঠী এখন থেকে ১৩০ বছর আগে ভাগ্য সন্ধানের জন্য কানাডা পাড়ি দেয়। কানাডার আলবের্তা প্রদেশে রয়েছে ৮১টি ধর্মপল্লী এবং খ্রিস্টভক্তের সংখ্যা ২৫ হাজার এবং গোটা কানাডায় রয়েছে এক লক্ষ ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক। এছাড়া পোপ কানাডার ইউক্রেনীয় অধ্যুষিত এলাকায় সফরের সময় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ অবসানের জন্য সেসব দেশের নেতা, জনগণ এবং বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান।
এডমন্টন শহরে অদূরে অবস্থিত মাস্কয়াসিস এলাকায় আদিবাসীদের প্রাক্তন আবাসিক বিদ্যালয় ভূমিতে দাঁড়িয়ে পোপ ফ্রান্সিস, ক্যাথলিক চার্চ প্রতিষ্ঠানকর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহে আদিবাসী শিশুদের উপর নির্যাতনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিছু আদিবাসী যারা ঐসমস্ত বিদ্যালয়ে নির্যাতন সহ্য করেও লেখাপড়া করেছেন বা বিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন। জনসভায় উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় রাজনৈতিক নেতা গভর্নর জেনারেল মেরী সাইমন এবং তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডু।
একসময় দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন বিভিন্ন ক্যাথলিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়। এইসব বিদ্যালয় শুরু হয়েছিল ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং যেগুলোর সর্বশেষটি বন্ধ হয়েছিল ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্যালয় শুরু হলে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মেটিস ও ইনোইট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশু তাদের বাড়িঘড় থেকে তুলে নিয়ে আবাসিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু আদিবাসীরা তাদের নিজের ভাষা ও কৃষ্টির কারণে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। কানাডার একটি বিশেষ কমিশন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে আবাসিক বিদ্যালয়ে ৩,২০০ আদিবাসী শিশু নির্যাতন, পুষ্টিহীনতা, যক্ষা রোগ ও আরো বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর খবর তুলে ধরেছে।
রাষ্ট্রকর্তৃক আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী ভাষা ও কৃষ্টির উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই জন্য আদিবাসী ছাত্র হত্যাকে “সাংস্কৃতিক গণহত্যা” হিসেবে নানা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যাথলিক চার্চের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সম্প্রদায় বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত করতেন। সেই সময় ভাটিকান প্রধান ছিলেন পোপ নবম পিউস- (১৮৪৬-১৮৭৮) যিনি ক্যাথলিক চার্চের সেক্যুলার রাষ্ট্রেরও (১৮৭০) শেষ প্রধান ছিলেন। পোপ নবম পিউসের পরে এবং পোপ ফ্রান্সিসের আগে আরো ১০জন পোপ বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলেও- কানাডার আবাসিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী ছাত্র হত্যার জন্য কোন পোপ আনুষ্ঠানিকভাবে সরজমিন সফর ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন নি। পোপ ফ্রান্সিস প্রথম পোপ যিনি কানাডার আদিবাসী আবাসিক বিদ্যালয় এলাকা সফর করে নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। “ক্ষমার তীর্থযাত্রা” নিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের কানাডা সফর- ক্ষত নিরাময়ের ঐতিহাসিক যাত্রা হিসেবে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার সুনীল রোজারিও।