ফাদার স্বপন পিউরীফিকেশন
যদি কোনদিন কারো উপকার করতে নাও পারিস তবে কারো ক্ষতি কখনো করিস না, নাকী রে ফাদার। উপকারের প্রতিদানে ধন্যবাদ বলতে হয়রে নাকি রে। আমি একজন কথায় কথায় নাকী রে উচ্চারণ করা ফাদারের জীবনের কয়েকটি দিক তুলে ধরতে চেষ্ঠা করছি । যদিও আমি লেখক নই তবুও সাহস করছি ফাদার এ্যামিলিও-এর সম্পর্কে কিছু লিখতে। কারণ তার সাথে আমার প্রায় সাড়ে চারটি বছর থাকার ও জীবন অভিজ্ঞতা করার সুযোগ হয়েছে। তিনি আমাদের বাংলাদেশ মণ্ডলিতে বিশেষ করে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের উত্তর ভিকারিয়ার রহনপুর, চাঁনপুকুর ও ভূতাহারা ধর্মপল্লীতে প্রায় ৪৪ টি বছর পালকীয় সেবাদান করেছেন। এই যিশু ভালবাসা প্রতীম মানুষটি ১২ আগস্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ নিজ জন্মভূমি ইতালীতে পরলোক গমন করেছেন। তার মৃত্যুতে খ্রিস্টমণ্ডলির একটি জীবন্ত, প্রানবন্ত প্রদীপের অবসান ঘটেছে।
তিনি যিশুরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি: যিশু খ্রিস্ট হলেন ঈশ্বর পুত্র, ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব, ঈশ্বরের মুক্তি পরিকল্পনার হাতিয়ার ও পরিপূর্ণতা দানকারী। স্বর্গারোহনের পূর্বে যিশু তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছেন তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও বিশ্বসৃস্টির কাছে ঘোষণা করো মঙ্গলসমাচার। সেই নির্দেশকে বাস্তবায়নের জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পারী দিয়ে সুদুর ইতালী থেকে তিনি এসেছিলেন ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে এই বাংলাদেশে একজন মিশনারী হিসাবে। কথার ধরনে, চাল-চলনে, জীবন-যাপনে সত্যিই তিনি যে যিশুর প্রেরিতদূত তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ছোট শিশুদের সাথে তার ছিলো গভীর সখ্যতা, আদরে-যত্নে ভালবাসায় তিনি শিশুদের তার হৃদয়ে মনিকোঠায় সব সময় রেখেছেন। একটি শিশুও যেন অবহেলা, রোগে-শোকে, বিনা খাবারে কষ্ট না পায় সেই চেষ্ঠায় তিনি নিরন্তর করেছেন। তার স্নেহের কোলই ছিল শিশুদের আশ্রয়। শিশুরা যখন চিৎকার, উচ্চস্বরে কথা বলতো, হাসাহাসি করতো, দুষ্টামী করতো তখনো আমি প্রথমে প্রথমে খুবই বিরক্ত হতাম। তাদের ধমক দিতাম, বকা দিতাম এমনকি হালকা শাসনও করতাম কিন্তু আমি দেখেছি শিশুদের সকল প্রকার আচরণ-ব্যবহার তিনি হাসিমুখে সহ্য করতেন। আদর করতেন ও সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংশোধন দিতেন। এতে শিশুদের মনের আমূল পরিবর্তন হতো। তিনি বাইবেলে এই উক্তি মনে রাখতেন তোমার ভাইয়ের প্রতি তুমি যা করেছো, তুমি তা আমারই প্রতি করেছে।
সহজ-সরল একজন মানুষ: বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রায়ই থেকেছেন জীর্ণ-শীর্ণ মাটির কুঠীরে, খেয়েছেন বাংলার মানুষের (বিশেষ করে আদিবাসিদের) ভালবাসার দান হিসাবে প্রদানকৃত অতি সাধারণ তেমন সুসাদু নয়, ঝাঁল-তেল-লবনযুক্ত খাবার, পরিধান করেছেন স্বল্পদামের অতি সাধারণ পোশাক, ঘামের গন্ধযুক্ত মানুষের সাথে আলাপ-চারিতায় প্রায় দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন। দুপুরের সবাই যখন বিশ্রামের চিন্তায় বিভোর তখন তিনি অপেক্ষমান থাকতেন গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। বার বার মাটির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান থাকতেন কখন ভক্ত ডাকবে ফাদার আছেন এবং বলবে যিশু মারাং ফাদার (অর্থাৎ যিশু প্রণাম ফাদার)।
অন্যের দু:খের সাথে সহমর্মিতা: বাইবেলের অনেক ঘটনায় আমরা দেখি যিশু অন্যের দু:খে নিজেও দু:খিত ও ব্যথিত হয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে লাজারের মৃত্যুতে, নায়িন নগরের বিধবার একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে, অনেক লোক তাঁর কথা শুনতে শুনতে যখন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তে তখন মানুষের প্রতি যিশুর সহমর্মিতা নিদর্শন দেখতে পাওয়া যেত। ফাদারের মধ্যেও আমি এই বিষয়টি প্রতীয়মান হতে দেখেছি। একবার এক বিধবা যখন এসে সহভাগিতা করেছিল তিনি দুই দিন ধরে নিজে এবং তার একমাত্র পুত্র না খেয়ে আছেন, অসুস্থ অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছেন। অনেকের নিকট হাত পেতেছেন কিন্তু বেশির ভাগই মানুষ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। চোঁখের জলে ফাদারের টেবিল ভিজে যাচ্ছিলো। তখন আমি লক্ষ্য করে দেখলাম ফাদারের চোঁখ দু’টো লাল বর্ণ ধারণ করেছে এবং তিনি নিরবে নির্ভিতে চোখে জল ফেলছেন। আমি সত্যিই মোহিত বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম এবং কিছুক্ষণ সময় মনের দিক থেকে পৃথিবী থেকে তিরোহিত হয়েছিলাম। দূরের গ্রাম হতে জীর্ণ-শীর্ণ পোশাকে দুপুরের সময় যখন মিশনে বোডিং-এর ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকগণ আসতেন, না খেয়ে তিনি তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দিতেন না। সব সময় বলতেন খাওতো রো। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতাম ফাদার এভাবে করলেতো আমাদের খাবার কম পড়ে যায়। ফাদার উত্তর দিতেন ঈশ্বর আমাদের যেমনি সৃষ্টি করেছেন তেমনি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের অভাব কোনদিন তিনি করবেন না নাকী রে। কখনো বলবিনা আমাদের নেই বরং বলবি আমার যা আছে তা দিয়ে সহভাগিতা করবো। একজনের খাবার দু’জন ভাগ করে খাবো নাকী রে।
মানুষের দৈহিক সুস্থতা যিশুরই আহ্বান: অন্ধ-কালা-বোবা-খোঁড়া ব্যক্তিদের যিশু পিতা ঈশ্বরের শক্তিতে সুস্থ করে তুলেছেন। অসুস্থ মানুষের সুস্থ হওয়ার অধিকার যিশু দিয়েছেন। যিশুর রাজত্বে সবাই সুস্থ-সবল মানুষ। যিশুর সেবক হিসাবে ফাদার নিজেও যিশুর কাজটি চলমান রাখতে সর্বদা চেষ্ঠা করেছেন। প্রতি সপ্তাহের শনিবার দিনটি ছিল ফাদারের জন্য অসুস্থ মানুষের কথা শোনা ও তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থার দিন । সপ্তাহের অন্যান্য দিনেও প্রয়োজন হলে তিনি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার চেষ্ঠা করতেন। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই তার ভালবাসার সেবা হিসাবে চিকিৎসা সেবা পেতেন। কঠিন রোগে আক্রান্ত (উদা: ক্যান্সার রোগী) যাদের সুস্থ হবার কোন সম্ভবনা বেশি দেখা যেতোনা তাদেরও তিনি গভীর ভালবাসা দিয়ে আশা জাগিয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে রাজশাহী ডিঙ্গাডোবা রেখে চিকিৎসা করাতেন। আমি বলতাম ফাদার এই রোগীতো মনে হয় ভাল হবেনা। তিনি বলতেন এই কথা কখনো বলবিনা নারে নাকীরে। ঈশ্বরই জানে তার ভক্তসেবক কখন তার কাছে তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাবে। অনেকে রোগীকে বলতে শুনেছি আপনি আল্লাহর জীবন্ত বান্দা। আপনি মানুষ না আপনি দেবতা। আপনি আছেন বলেই আমি এখনো সুস্থ হয়ে বেঁচে আছি। ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুন। কোন অসুস্থ মানুষ দেখলে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত সেবা করতে না পারতেন ততক্ষণ তাকে দেখেছি বিচলিত, ছটফট থাকতে । ভূতাহারা ধর্মপল্লী হতে বিদায় নেয়ার একবছর পূর্ব হতে তার বৈদশিক টাকার যোগান অনেক কমে গিয়েছিল। আমি তাকে দেখেছি দীর্ঘদিন সময় ধরে চুপচাপ বসে থাকতে, মন মরা হয়ে থাকতে এমনকি কথাও কম বলতে। যখন জিজ্ঞেস করতাম ফাদার কি হয়েছে, কোন সমস্যা? তিনি অকপটে বলতেন আমি মানুষকে কোন ব্যাপারে না বলতে পারি নারে। মানুষ বুঝতে চায়না রে আমার কাছে টাকা নেই। ওদের চিকিৎসার জন্য আমি আর টাকা আনতে পারছিনা। তবে তিনি একটা কথা বলতেন আমাদের যিশুর আদর্শ অনুসরণ করে রোগীকে সুস্থ করার মনোভাব নিয়ে রোগীদের জন্য খ্রিস্টমণ্ডলির একটি তহবিল করা দরকার। যেন একটা মানুষও বিনা চিকিৎসায়, অবহেলায় মারা না যায়।
শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ সচেতন মানুষ: প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বে তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন দেখেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে তাদের জায়গা-জমি-বসতভিটা হারিয়ে নি:স্ব হয়ে পড়ছিল, নেশাগ্রস্ত হয়ে পরিবার জীবন থেকে উদাসীন হয়ে পড়ছিল, সমাজের অন্যান্যরা তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা, এমনকি পদে পদে ঠকাচ্ছিল। তিনি উপলদ্ধি করেছেন এদের এই অবস্থা হতে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে শিক্ষা। তাই তিনি শিক্ষার জন্য বোডিং-এ ব্যবস্থা করেছেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বোডিং-এ রেখে তিনি তাদের পড়াশুনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি শুধু ছেলে-মেয়েদেরই বোডিং-এ রেখে শিক্ষার সুযোগ দিতেন না সাথে সাথে অখ্রিস্টান আদিবাসি, হিন্দু ও মুসলিমদের সুযোগ দিয়েছেন লেখাপড়া করার। তার উদ্দেশ্য ছিলনা কখনো কাউকে খ্রিস্টান বানানোর বরং তাদের মধ্যে খ্রিস্টের আদর্শ দেয়া। যেন সবাই মানুষের মতো মানুষ হয়ে ব্যক্তি জীবন, পরিবার জীবন, সমাজ জীবন এমনকি রাস্ট্রীয় জীবনকে অর্থবহ, সুন্দর ও ফলশালী আদর্শে গড়ে তুলতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষিত আলোকিত মানুষই পারে নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে। তারই সাহায্য-সহযোগিতায় আজ হাজার হাজার আদিবাসি সুশিক্ষিত হয়ে উঠেছে। ভাল ভাল অবস্থানে থেকে চাকুরী করছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, মণ্ডলিতে ফাদার-সিস্টার, ব্রতধারী-ব্রতধারীনী হয়ে সেবা দিচ্ছে। ফাদার বলতেন আজ আদিবাসিদের জীবন-যাত্রা পরিবর্তন হয়েছে, অনেকে হারানো জমিজমা ফিরিয়ে আনছে, নিজ উদ্যোগে নতুন নতুন বসতবাটী তৈরী করতে পারছে এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের ও সুখের। কিন্তু তিনি বলতেন আমি স্বপ্ন দেখিরে সকল আদিবাসি নেশামুক্ত হবে, সুশিক্ষিত হবে একশোভাগ, বিয়ে পূর্ব অবৈধ বসবাস বন্ধ হবে, সামাজিক দলাদলি বন্ধ হবে, একদিন মণ্ডলির টাকা দিয়ে তারা শিক্ষিত হয়েছে এখন তারা মÐলীকে কিছু অনুদান দিবে যা দিয়ে মণ্ডলি আরও অনেককে বিভিন্ন সেবা দিয়ে খ্রিস্টের পতাকাতলে নিয়ে আসবে। ফাদার এখন দৈহিকভাবে পৃথিবীতে নেই ঠিকই কিন্তু তিনি স্বর্গ থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছি কি-না তা দেখার জন্য।
জমি থাকলে একদিন সব হবে রে: ফাদার রহনপুর, চাঁনপুকুর ও ভূতাহারা ধর্মপল্লীতে অনেক জমি ক্রয় করেছেন। যদিও বর্তমানে কিছু জমি সমস্যায় রয়েছে। তবুও তিনি যদি জমি ক্রয় না করতেন তাহলে উত্তর ভিকারিয়ার ধর্মপল্লীগুলো অবস্থা বর্তমানের মতো হতো কি-না তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি কখনো আদিবাসিদের জমি ক্রয় করতে চাইতেন না। বরং তাদের বুঝাতেন জমি বিক্রয় না করে তোমরা কাজ করো, পরিশ্রম করো, প্রয়োজন হলে ক্রেডিট ইউনিয়ন হতে হতে ঋণ গ্রহণ করো তা ধীরে ধীরে সুদ করে দিবে। অনেক সময় তিনি টাকা দিয়েও অনেককে সাহায্য করেছেন এবং তাদের জমি বিক্রয় করা হতে বিরত করেছেন। অনেকবার মানুষ তাকে ঠকিয়েছেন। জমিও বিক্রয় করেছে এমনকি তার নিকট হতে মিথ্যা বলে টাকা নিয়েছেন। বর্তমানে অধিকাংশই উপলদ্ধি করে তারা ফাদারকে ঠকাতে পারেনি বরং নিজেরাই ঠকেছেন। যখন বলতাম ফাদার আর জমি না কিনে গির্জায় করেন, ফাদার বাড়ী করেন, মিশন চত্বরের বাইরে স্কুল করেন, গ্রামে গির্জাঘর করেন এবং ছেলে-মেয়েদের খাবারের জন্য খাবার ঘর তৈরী করেন। ফাদার উত্তর দিতেন আজ আমি জমি কিনে দিয়ে যাচ্ছি। একদিন দেখবি এই জমিতে সবই গড়ে উঠবে। তারই কথার বাস্তব প্রমান আজ পাচ্ছি। ভূতাহারা ধর্মপল্লীতে গির্জাঘর হচ্ছে, ফাদার বাড়ী হচ্ছে, স্কুল হয়েছে, ছেলে-মেয়েদের খাবার ঘর হয়েছে ও গ্রামে গির্জাঘর নির্মাণ হচ্ছে। সত্যিই ফাদার যিশুরই মতো ভবিষ্যত বলতেন পারতেন। জয়তো ফাদার এ্যামিলিও আপনাকে।
প্রকৃতি পূজারী সৃষ্টিকে সৌন্দর্য দানকারী: এক সময় বরেন্দ্র ভূমি ছিলো শুধুই বালুকাময়-ধূলিময়, প্রাণহীন সজীবতাহীন প্রান্তর। কঠিন বরেন্দ্রের বক্ষে প্রাণের স্পন্দনকে জাগরিত করেছেন বৃক্ষরাজির মাধ্যমে তিনি। বরেন্দ্রকেও যে সবুজ তৃনভূমিতে রূপান্তরিত করা যায় তা তিনি হাজার হাজার লাখো লাখো বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তিনি নিজে গাছ লাগিয়েছেন, যত্ন করেছেন এবং অন্যদের শিখিয়েছেন কিভাবে প্রকৃতি আরও বাসযোগ্য সুন্দর ও মোহনীয় করা যায়। এইজন্য তিনি জেলা পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি মিশন চত্বর বাদেও বরেন্দ্রের বিভিন্ন জমিতে, রাস্তার ধারে, মসজিদের চত্বরে, মন্দিরের আশেপাশে এমনকি সরকারি স্থাপনায় অনেক বৃক্ষরোপন করেছেন। কেহ যদি কোন গাছের পাতা পর্যন্ত ছিড়তো তিনি অনেক বেশি কষ্ট পেতেন, রেগে চিৎকার করতেন। যখন তখন গাছের নিকট দাঁড়িয়ে ভির ভির করে কি যেন বলতেন। বোডিং-এর ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সবসময় গাছে পানি দেওয়াতেন এবং তাদেরও শিখাতেন কিভাবে গাছ লাগাতে হয় এবং যত্ন নিতে হয়। প্রভু যীশুর আহ্বান তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও বিশ্বসৃষ্টির কাছে ঘোষণা কর মঙ্গলসমাচার। বিশ্ব সৃষ্টির মধ্যে অবশ্যই গাছ-পালাও মানুষের পরে অন্যতম। মানুষের জীবনকে সুন্দর করতে পারে প্রকৃতি-পরিবেশ। তাই তিনি মানুষের জীবনকে সুন্দরকরনের জন্য যীশুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গাছ-পালা লাগিয়েছেন, প্রকৃতিকে সুন্দর করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিসের মতো যদি প্রকৃতি বাঁচে তাহলেই কেবল মানুষ বাঁচবে।
মানবিকতায় পূর্ণ মহান ব্যাক্তিত্ব: বয়স্কদের তিনি শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখাতেন, তাদের যাতে কোন কষ্ট না হয় সেইজন্য তিনি নিজে বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও ক্লান্তিহীন চিত্তে তাদের জন্য বিশেষ উদারতাস্বরূপ খাবার-ফল-মূল কিনার জন্য আর্থিক সাহায্য দিতেন, ঘর নির্মাণ করে দিতেন, পোশাকের ব্যবস্থা করতেন এমনকি ধর্মপল্লীতে থাকবার সুযোগ করে দিতেন। অনেক প্রতিবন্দীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন মিশনকেন্দ্রে ও বিভিন্ন প্রতিবন্দী কেন্দ্রে। তাদের জন্য অর্থদানের পাশাপাশি তাদের নিয়মিত খবরাখবর রেখেছেন। এতিম. বিধাবা ও স্বামী পরিত্যক্তদের তিনি তার হৃদয়ে মণিকোঠায় আশ্রয় দিয়েছেন। এতিম ছেলে-মেয়েদের নিজে পিতা হয়ে তাদের পিতা-মাতার অভাব মোচন করেছেন। ছোট ছেলে-মেয়েদের তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য বিভিন্ন খেলা ও শিক্ষার আয়োজন করতেন। বিশেষ করে বোডিং-এর ছেলে-মেয়েদের সাথে নিজের খাবার এবং তাকে বাইরের জনগণ দেখতে এসে যে খাবার দিতেন তা সহভাগিতা করতেন। ছেলে-মেয়েরা যখন তৃপ্তি নিয়ে খেতেন তিনি খুবই খুশি হতেন এবং তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন। যিশু যেমন বলেছেন শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও বাধা দিয়োনা। শিশুরমতো সহজ-সরল যারা স্বর্গরাজ্য তাদেরই। এই কথা তিনি সব সময় মনে রেখেছেন এবং সেই অনুযায়ী কাজও করেছেন। তিনি খ্রিস্টানদের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিমদের সমভাবে ভালবেসেছেন এবং সাহায্য-সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়েছেন।
পরিশেষে, এই মানুষটির মধ্যে এতো গুণের সমাহার ছিলো যে, যা কি-না আমি বলে বা লিখে শেষ করতে পারবো না। তার গুণের বর্ণনা আর নাই-ইবা দিলাম। তবুও তিনি সকল গুণের আকর ছিলেন, যা না বলে আর কোন উপায় থাকেনা। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেছেন তার গুণের আলোকচ্ছটা যা আমরা চাইলে অনুসরণ করতে পারি ব্যাক্তি জীবনে। তিনি দৈহিকভাবে আমাদের নিকট হতে ঠিকই তিরোধিত কিন্তু আদর্শে-ভালবাসায় আমাদের নিকট চির আরাধিত। তার দেহ হয়তোবা ক্ষয় করেছে গহীন মাটি তিনি আমাদের নিকট রয়ে যাবে অমর অক্ষয় খাঁটি। বেঁচে থাকেন নাকী রে ফাদার যুগ যুগ ধরে আমরা রাখবো আপনাকে চিরদিন অন্তরে। ক্ষমো মোদের সব অপরাধ জগতে আপনারমতো ভালবেসে যেন করতে পারি অন্যায়-অপরাধ, অসাম্যের দূরিপাদ। প্রার্থনা, স্বর্গ হোক আপনার চিরকালীন নীড় সেখানে গিয়ে আমরাও যেন করতে পারি আপনার সাথে ভীড়।