ইটালী দেশের পিমে মিশনারীদের একজন সদস্য ফাদার এমিলিও স্পিনেল্লী একজন ভিন্ন ধরণের মিশনারী ছিলেন। বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর আগমনের প্রথম থেকেই আমি তাঁকে চিনতাম। তবে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন সুইহারী ধর্মপল্লীতে “যিশু নাম গঠন গৃহ” নামক নতুন ইন্টারমিডিয়েট সেমিনারী শুরু করি, তখন তাঁকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে চিনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সেই সময় পিমে মিশনারীদের পরিচালিত নভারা টেক্নিক্যাল স্কুলের পরিচালক ছিলেন। তিনি এই কাজটি করতে রাজী হয়েছিলেন কারণ তিনি তাঁর বাধ্যতা ব্রতটি পালন করেছিলেন। তবে তিনি মনে প্রাণে ছিলেন একজন পালক। আর তাই তিনি তাঁর প্রথম ধর্মপল্লী রহনপুর ও পরবর্তীকালে চাঁদপুকুর, ভূতাহারা ও কুদ্বির মিশনে তাঁর সেই পালকীয় জীবনের ছাপ রেখেছেন স্পস্টভাবে।
যা-ই হোক আমি যেমন সেমিনারী গঠন কাজ থেকে পালকীয় কাজে আগ্রহী ছিলাম বেশী, ফাদার স্পিনেল্লীও টেকনিক্যাল স্কুলের দায়িত্ব ছেড়ে পালকীয় কাজের জন্য ধর্মপল্লীতে যেতে চাচ্ছিলেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের তৎকালীন বিশপ, পরম শ্রদ্ধেয় থিওটোনিয়াস গমেজ, সিএসসি, আমাদের দুইজনকে একসঙ্গে একদিন বিশপ ভবনে ডাকলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। বিশপ মহোদয় আমাদের বললেন যে দু’টি ধর্মপল্লীতে সহকারী ফাদার প্রয়োজন – তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা কে কোথায় যেতে চাই। ফাদার স্পিনেল্লী আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন পছন্দ আছে কিনা! আমি বললাম আমার কোন পছন্দ নেই তিনি যেন যে কোন একটি বেঁছে নেন। তিনি অপেক্ষাকৃত নূতন ও বাণী প্রচারের জন্য বেশী সম্ভাবনাময় চাঁদপুকুর ধর্মপল্লীটি বেঁছে নেন। চাঁদপুকুর মিশনে তখন অবকাঠামো বেশী ছিল না। তাই তিনি সেখানে গিয়ে একটি ছোট মাটির ঘরে থাকতে আরম্ভ করেন এবং সেই ঘর থেকেই ২৩ বছর পলকীয় কাজ করেন।
দিনাজপুর থেকে আলাদা হয়ে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী একটি আলাদা ধর্মপ্রদেশ হয়। ফাদার এমিলিও স্পিনেল্লী রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমিতেই থেকে যান। আমি যখন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ পদে অভিষিক্ত হই, তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যে, তাঁকে যেন ভূতারা গ্রামে একটি নূতন মিশন স্থাপন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এখনও তারঁ কিছু শক্তি সামর্থ্য রয়েছে যাতে একটি নূতন ধর্মপল্লী স্থাপন করতে পারবেন। আমি খুশী হয়ে তাঁকে সেই দায়িত্ব দিয়েছি কারণ রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ তুলনামূলকভাবে নূতন আর তাই এখানে বাণী প্রচারের সুবিধার জন্য আরও অনেক ধর্মপল্লী স্থাপন করা প্রয়োজন রয়েছে। তিনি খুশী হয়ে সেই ভূতাহারা গ্রামে একটি নূতন মিশন স্থাপনের জন্য ব্রতী হন। কিন্তু চাঁদপুকুরের জনগণের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, ফাদার স্পিনেল্লী আমি জোড় জবর্দস্তি করে সেখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছি। তাই তারা ফাদারকে চাঁদপুকুরেই রেখে দিতে আমাকে চাপ দিচ্ছিল। আমি ফাদও স্পিনেল্লীকে বলেছিলাম যে, তিনি চাইলে চাঁদপুকুরে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি সেখানে শেষ পর্যন্ত থাকেন নি। তিনি সেখানে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলেন।
তারপর পিমে সুপেরিওর তাঁকে দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের কুদ্বির ধর্মপল্লীতে দায়িত্ব দিলে, তিনি তাঁর বাধ্যতার কারণেই সেখানে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কোভিড-১৯ বা করোণা ভাইরাস আরম্ভ হলে সকলের মত তিনিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছেন। তথাপি তিনি এই ভয়াবহ এই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হন এবং নানা তাঁর মধ্যে নানা রোগের জটিলতা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ইটালীতে ফিরে যেতে হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু তিনি আর সুস্থ্য হতে পারেন নি। তিনি নিজ দেশে ১২ আগস্ট ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।
কেন তিনি ভিন্ন ধরণের মিশনারী ছিলেন সেই কথাও আমরা অনেকেই জানি। তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ ও খাওয়া দাওয়া ছিল অতি সাধারণ। শুধু তা-ই নয়, তাঁর থাকার ঘর ও খাবারের স্থানও আমাদের অনেকের চেয়ে ছিল নিম্ন্যমানের। তিনি সব সময়ই মাটির ঘরে থেকেছেন, যদিও চাইলেই তিনি দালান ঘরে থাকতে পারতেন। মান সম্পন্ন একটি খাবার ঘরে তিনি খাওয়া দাওয়া করতে পারতেন, তা তিনি করেন নি; তাঁর বলতে গেলে কোন খাবার ঘরই ছিল না। তিনি বারান্দায় বোর্ডিংএর ছেলেমেয়েদের মতই খাওয়া দাওয়া করতেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হলো – অসংখ্য ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করে তোলা। প্রতি বছর তিনি স্থানীয় স্কুলে বা বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে শত শত ছেলে মেয়েকে পাঠাতেন লেখাপড়া করার জন্য। এইসব ছেলেমেয়েদের পরিবার তেমন কোন টাকা পয়সা দিত না। তিনি নিজেই তাদের সকল খরচ বহন করেছেন। শুধু কাথলিক ছেলেমেয়েদেরই নয়, বরং অকাথলিক ছেলে মেয়েদের সংখ্যাই ছিল বেশী। অথচ তিনি কোন অখ্রিস্টান পরিবারকে বা তাদের ছেলে মেয়েদেরকে কখনও চাপ দেন নি কাথলিক ধর্মগ্রহণ করার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেক মানুষের বিবেকের স্বাধীনতা রয়েছে, তাদের ধর্মবিশ্বাস পালনের ক্ষেত্রে তাদের কোন চাপ দেওয়া উচিত নয়। কাথলিক মণ্ডলির মাতৃত্ব ও ভালবাসা তিনি এইভাবেই প্রকাশ করেছেন। উন্নত জীবন লাভের জন্য জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই তিনি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন ভিন্ন একজন মানুষ – অনন্য দয়ালু পুরুষ। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষকে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি রাজশাহীস্থ রোগীদের আশ্রয় কেন্দ্রে রোগী পাঠাতেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। তাদের মধ্যে অখ্রিস্টান অর্থাৎ মুসলমান, হিন্দু ও অকাথলিক আদিবাসীদের সংখ্যাই থাকতো বেশী। এইসব রোগীদের কাছ থেকে তিনি কোন টাকা পয়সা নিতেন না। তিনি নিজেই তাদের চিকিৎসা খরচ বহন করেছেন। তাছাড়া স্থানীয় ধর্মপল্লীর ডিস্পেন্সারিতেও অসংখ্য রাগীরা তাঁর সাহায্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছে।
ধর্মপল্লীর সাক্রামেন্তীয় ও প্রশাসনিক কাজে তিনি বেশী অর্থডক্স ছিলেন না। তবে তিনি সব কাজই নিয়মিত করেছেন, যেন ধর্মপল্লীর জীবন জীবন্ত থাকে আর ধর্মপ্রদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। ধর্মপল্লীর জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি ক্রেডিট ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন যেন তারা তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সঞ্চয় করতে শিখে। তবে তিনি মানুষকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করতেন – যার ফলে খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান অনেকেই তাঁকে ঠকাতেন। তিনি তাতেও তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন নি।
ফাদার স্পিনেল্লী ছিলেন একজন পরিবেশবাদী মানুষ। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি চাঁদপুকুর মিশনে যান, তখন সেই এলাকায় কিছু খেজুর গাছ, তাল গাছ আর কিছু বাব্লা গাছ দেখা যেত। এলাকাটি প্রায় একটি মরু অঞ্চলের মত ছিল। পূর্বেকার বনাঞ্চলগুলি গাছ শূন্য হয়ে গিয়েছিল। মানুষ মনে করতো এখানে গাছ লাগালে হবে না। ফাদার স্পিনেল্লী সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তিনি প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন আর এলাকার সকল মানুষকে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। ভোর থেকেই তিনি গাছের যত্ন বা পরিচর্যা করতেন। বোর্ডিংএর প্রায় ৩০০ ছেলেমেয়েকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট একটি গাছের যত্ন নিতে দিতেন। আমি দেখেছি সেই ছেলেমেয়েরা বৃষ্টির দিনেও সময় হলে তাদের নিজেদের গাছে জল ঢালতো। এলাকার চেয়ারম্যানকে তিনি টাকা দিয়েছেন যেন বিখ্যাত দিবরদিঘীর চারিদিকে গাছ লাগানো হয়। তার সেই প্রচেষ্টায় চাঁদপুকুর মিশনের আশেপাশে অচিরেই একটি বনাঞ্চলের মতো হয়ে গিয়েছিল। ভূতাহারা মিশনে গিয়েও তিনি একই কাজ করেছেন। গাছ শূণ্য একটি এলাকাকে তিনি কয়েক বছরেই প্রায় জঙ্গলে পরিণত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে তাঁরই অনুকরণে কারিতাসসহ বিভিন্ন এন.জি.ও. এই এলাকায় রাস্তার পাশে ও নিজস্ব জমিতে মানুষকে গাছ লাগাতে সহায়তা করেছে। পরবর্তীতে বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ গোটা বরেন্দ্র এলাকাকে সবুজায়ন করতে প্রকল্প গ্রহণ করে।
ফাদার স্পিনেল্লীর মহাপ্রয়ানে আমরা রাজশাহী ধর্মপ্রদেরে সকলেই দুঃখিত ও মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন অকৃত্রিম ও ভিন্ন ধরণের মিশনারী বন্ধুকে হারালাম। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মণ্ডলিতে যে শূণ্যতা সৃষ্টি হলো তা পূরণ হতে বহু সময় লাগবে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ