মণ্ডলি জন্মলগ্ন থেকেই মিশনারী বা প্রেরণধর্মী। এই প্রেরণকাজ করার জন্যই মিশনারীগণ পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর এমনই একজন মিশনারীর আত্মার মঙ্গল কামনা করে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়। তিনি আর কেউ নন আমাদের সকলের প্রিয়জন ও ভালবাসার মানুষ ফাদার এমিলিও স্পিনেলী, পিমে। তিনি বাংলাদেশ মণ্ডলিতে বিশেষ করে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের উত্তর ভিকারিয়ার রহনপুর, চাঁনপুকুর ও ভূতাহারা ধর্মপল্লীতে প্রায় ৪৪ টি বছর পালকীয় সেবাদান করেছেন। যিশু ভালবাসা প্রতীম মানুষটি ১২ আগষ্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ নিজ জন্মভূমি ইতালীতে পরলোক গমন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে খ্রিস্টমণ্ডলির একটি জীবন্ত, প্রানবন্ত প্রদীপের অবসান ঘটেছে।

তিনি ছিলেন যিশু খ্রিস্টের একজন প্রতিচ্ছবি বা অপরখ্রিস্ট। তিনি ছিলেন, ঈশ্বরের মুক্তি পরিকল্পনার হাতিয়ার ও পরিপূর্ণতা দানকারী। স্বর্গারোহণের পূর্বে যিশু তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও বিশ্বসৃষ্টির কাছে ঘোষণা করো মঙ্গলসমাচার।” সেই নির্দেশকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারী দিয়ে সুদূর ইতালী থেকে তিনি এসেছিলেন ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে এই বাংলাদেশে একজন মিশনারী হিসেবে। কথার ধরনে, চাল-চলনে, জীবন-যাপনে সত্যিই তিনি যে যিশুর প্রেরিতদূত। আর তিনি তা বার বার প্রমাণ করেছেন তার জীবন দিয়ে। ছোট শিশুদের সাথে তার ছিল গভীর সখ্যতা। আদরে-যত্নে-ভালবাসায় তিনি শিশুদের তাঁর হৃদয়ে মণিকোঠায় স্থান দিয়েছিলেন। একটি শিশুও যেন অবহেলা, রোগে-শোকে, খাবারের অভাবে কষ্ট না পায় সেই চেষ্ঠাই তিনি করেছেন নিরন্তর । তার স্নেহের কোলই ছিল শিশুদের আশ্রয়স্থল।

গত ২ সেপ্টেম্বর পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। শ্রাদ্ধের খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন বরিশাল ধর্মপ্রদেশের বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও। তাঁর সহার্পিত খ্রিস্টযাগে ১৮ জন ফাদার, ১ জন ডিকন, ১৫ জন সিস্টার এবং খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান প্রায় এক হাজারের অধিক মানুষ সমবেত হয়। খ্রিস্টযাগের শুরুতে নব অভিষিক্ত বিশপ ইম্মানুয়েল ও পিমে ফাদারদের সুপিরিয়র মিকেলেকে পা ধুয়ানো ও ফুলের মালা দিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়।

খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও বলেন, শ্রদ্ধেয় খ্রিস্টভক্তগণ, জীবনকালে আমরা যাদের ভালবেসেছি, মৃত্যুতে আমরা তাদের ভুলে যেতে পারি না। ফাদার স্পিনেলীকে আমরা ভালবাসতাম। তিনি একজন পিমে মিশনারী ফাদার। মিশনারী হচ্ছে তারাই, যারা নিজের দেশ থেকে বা অন্যান্য দেশ থেকে নিজের দেশে খ্রিস্টানিটিকে নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজের যা কিছু আছে, সে সমস্ত কিছু ছেড়ে অন্য দেশে, অন্য দেশের মানুষের কাছে, অন্য দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতির কাছে মঙ্গলসমাচার প্রচার করতে প্রেরিত হন। আমরা দেখি, ফাদার স্পিনেলীও তাদেরই একজন। তিনি আমাদের দেশে এসে আমাদেরই একজন হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের চেয়েও সাধারণ এবং খুব সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর সবকিছু দিয়ে মণ্ডলিকে ও আমাদেরকে ভালবেসে ছিলেন। তিনি মানুষকে ভালবেসেছেন। তিনি শুধু মানুষকে নয় বরং তিনি প্রকৃতিকে ভালবেসেছেন। সর্বোপরি তিনি সৃষ্টির প্রতি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা, সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা এবং মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা তাকে অনেক অনেক মহিয়ান করে তুলেছেন। তিনি মিশনের জন্য অনেক জমি কিনেছেন, হত-দরিদ্র, অসহায় মানুষকে অনেক সাহায্য করেছেন কিন্তু তিনি সারাটি জীবন কাটিয়ে গেছেন জীর্ণ-শীর্ণ মাটির ঘরে।

ফাদার এমিলিও’র বন্ধু ফাদার মার্তিনেল্লী পিমে, তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন যে, ফাদার এমিলিও আমার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। আমরা দু’জনে একসাথে বাংলাদেশে এসেছি এবং একই সাথে বরিশালে বাংলা ভাষা শিখেছি। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং তার কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তাঁর জীবনে দুইটি ভালবাসার ক্ষেত্র ছিল। একটি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের জন্য এবং অন্যটি ছিল মানুষের জন্য। মানুষের জন্য তার ভালবাসা ছিল খুব গভীর। তিনি ছিলেন বিশেষভাবে যারা অসুস্থ্য ও বিপদগ্রস্থ তাদের জন্য এক ভালবাসাপূর্ণ আশ্রয়স্থল। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান রাখেন বিশেষভাবে গরীব, দু:খী ও অনাথ ছেলে-মেয়েদেরকে বোডিং রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমি বলি, ফাদার স্পিনেলী সরাসরি বাংলাদেশ থেকে স্বর্গে গিয়েছেন। কেননা, তিনি ইতালীতে থেকেও মনে করতেন তিনি বাংলাদেশেই আছেন। তিনি সবসময় বাংলায় কথা বলতেন এবং ব্যাগ প্রস্তুত করতেন মফ:স্বলে যাওয়ার জন্য। তিনি সবসময় চিন্তা করতেন বাংলাদেশের কথা। এমনকি তিনি তাঁর অসুস্থ্যতার কথাও ভুলে গেছেন ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশকে ভুলেন নি।

বাংলাদেশে পিমে ফাদারদের সুপিরিয়র ফাদার মিকেলে বামভিল্লা সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর সহভাগিতায় বলেন, এই মুহূর্তে আমি বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও, ফাদার বেলেসারিও চিরো ও সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রয়াত ফাদার স্পিনেলী পিমে’র আত্মার চিরশান্তি কামনায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য। ফাদার স্পিনেলী মানুষদেরকে ভালবাসতেন আর তার এই ভালবাসার প্রতিদানে আজকে এতো মানুষের সমাগম ঘটেছে। ঈশ্বর তার এই ভক্ত সেবককে চিরশান্তি ও অনন্ত বিশ্রাম দান করুন।

শহীদুজ্জামান বাবু এমপি মহোদয় বলেন, আমার খুব প্রিয় মানুষ ফাদার এমিলিও স্পিনেলী। আজকে তাঁর স্মরণ সভায় উপস্থিত সকলের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন স্বর্গবাসী হন। তিনি যিশুর পথ ধরে যে মানবতার সেবা দান করেছেন তা অতুলনীয়।

চাঁনপুকুর ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার বেলিসারিও চিরো এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন- ফাদার স্পিনেলী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেছেন তার গুণের আলোকচ্ছটা যা আমরা চাইলেই ব্যাক্তি জীবনে তা অনুসরণ করতে পারি।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

Please follow and like us: