জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

একটা সময় ছিলো যখন পিতামাতা, অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলতো, এর শরীরের মাংস রেখে হাড়হাড্ডি পাঠিয়ে দিবেন। কি ভয়ানক কথা! জানি, কোন পিতামাতাই মন থেকে এ কথাগুলো বলেন না। আবার এটাও সত্য- এই কথার মধ্য দিয়ে স্কুলকর্তৃপক্ষকে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শারীরিক শাস্তির একটা প্রচ্ছন্ন অনুমতি দিয়ে দিতেন। প্রশ্ন রয়ে যায়- শারীরিক ও মানসিক শাস্তি কি ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোন ভালো ফল বয়ে আনতে পারে! অনেকে এর পক্ষে বিপক্ষে মত প্রকাশ করবেন জানি। তবে একবাক্যে বলবো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি কখনোই ভালো কিছু আনতে পারে না।

যারা বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চ পেশার সাথে যুক্ত জানি অনেকেই বলবেন, আমাদের সময় তো শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো। কতবার জোড়া বেতের মার খেয়েছি। কান ধরে উঠবস করেছি। স্কুলের ব্রেঞ্চে দাঁড়িয়েছি কতবার। শিক্ষকের নিকট থেকে গালি শুনেছি। কই আমাদের তো কোন সমস্যা হয়নি। শাস্তির কারণে মা-বাবা স্কুলে এসে তো আপত্তি জানায়নি। আমরা তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। সেই সময় এই শাস্তি না পেলে হয়তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম না। সাদা মনে একবার ভাবুন তো- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেই দিনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত হতে কতটুকু সাহায্য করেছে! বরং এটা সত্য- ভালো করে ভেবে দেখুন, সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে মন থেকে কখনো ক্ষমা করতে পারেননি।

অনেকে যুক্তি দিয়ে বলেন, শারীরিক ও মানসিক আঘাত না করলে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করে না; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল করা যাবে না। ডাহা মিথ্যা কথা! অনেক শিক্ষক আছেন যারা কখনো ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলেন না ও মানসিক আঘাতও করে কথা বলেন না কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজে থেকেই পড়াশুনা করে। আর সেটা সম্ভব না হলে একজন শিক্ষককে নিজের দায় নিজেকেই নিতে হবে। তবে নিজে থেকে দায় নেওয়ার মতো মানসিকতা কত জনেরই বা রয়েছে? আমাদের দেশে তো ভুল স্বীকার করে পদত্যাগ করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বলুন তো- কোনটা ভালো ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা না শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার পাশাপাশি শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় গড়ে তোলা প্রয়োজন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন বন্ধের উদ্দেশ্যে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সরকার একটি নীতিমালা জারি করে। শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এর ৩ (১), ১৯ (১), ৩৭ (১,২ ও ৩) সংখ্যক অনুচ্ছেদে শিশুদের শারীরিক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ এর ৭০ ধারা অনুসারে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ সব আইন ও নীতিমালা থাকার পরেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই ভালোভাবে মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষার্থীর প্রতি ‘ফিজিক্যাল ও ম্যানটাল ভায়োলেন্স’ মানে সরকারী নীতিমালার বাইরে যাওয়া। আর সরকারী নীতিমালা ভঙ্গের ফল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনেকে সরকারী নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হয়তো বলবে, দূর আইনের প্রয়োগ কোথায়? আইনের প্রয়োগ থাকুক বা না থাকুক নীতিমালার অবমাননাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বয়ষ্ক শিক্ষাকেন্দ্রে বয়ষ্কদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করা হয় কি! আমার জানা মতে কখনোই না। অনেকে না করার যুক্তি দেখিয়ে বলবে, উনারা তো বয়ষ্ক। কেন শাস্তি প্রদান করা হবে? তাহলে প্রশ্ন- শিক্ষাকেন্দ্রে কেন ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া হয়! এটাই কি প্রকাশ পায় না যে, ছাত্রছাত্রীদের দূর্বলতার সুযোগে অনেকে নরমের ওপর গরম ঢালেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান আইন করে বন্ধ করার সময় অনেকে এর বিরোধীতা করেছিলো। ‘এই বুঝি স্কুল গোল্লায় যাবে! আমাদের দেশ এখনো পর্যন্ত ইউরোপ, আমেরিকা হয়নি! সরকারের খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই!’ এই রকম নানা কথা শোনা গিয়েছিলো। যারা এই রকম মনোভাব পোষণ এখনো পর্যন্ত করেন তাদের অনুরোধ করছি, আপনি বুকে হাত দিয়ে সত্যি করে বলুন তো, আপনি যদি স্কুলের ছাত্র বা ছাত্রী হতেন তাহলে এই শারীরিক ও মানসিক শাস্তি যদি আপনাকে দেওয়া হতো আপনি কি তা মেনে নিতেন? হয়তোবা শিশু বলে কিছু করার থাকতো না। কিন্তু ভেতরে একটা রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান জন্ম নিতো। মনে রাখবেন- আপনার আর আমার সময় কিন্তু বহু আগেই অতীত হয়েছে। অতীতটাকে বর্তমানের সাথে সংযুক্ত করবেন না কখনোই।

‘বউ এর রাগ বিড়ালের ওপর ঢালা’ বলে একটি কথা গ্রামবাংলায় প্রচলিত আছে। যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাতে জর্জরিত করে তাদের অবস্থা ঠিক উক্ত প্রচলিত কথার সাথে মিলে যায়। যে শিক্ষক বা শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক আঘাত করে তারা মানসিক বিকারগ্রস্থ। তাদের অতীতটা যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে অনেক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে যে তারা বিভিন্ন সময় নিজেদের মুখ, পেশী ও বাহুবল দিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে শিক্ষকতার পেশায় প্রবেশ করেই সরাসরি ক্লাস নিতে পাঠানো হয়। তখন তারা নিজেদের ধারণা থেকে একটা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করেন যা শিক্ষার্থীদের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হয় না। আর নিজের পদ্ধতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি শারীরিক-মানসিক আঘাত করতেও পিছুপা হন না।

১ থেকে ১৮ বছর বয়সী সবাই শিশু। আর এই বয়সী মোটামুটি সবাই শিক্ষার্থী। শিশুদের সাথে ব্যবহার কেমন হবে সে বিষয়ে তলিয়ে দেখার বা ভাবার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। শিশু শিক্ষার্থী ছোট বলেই যে তার আত্মসন্মানবোধ নেই তা ভাবার কোন সুযোগ নেই। আবার অনেক সময় শিশুদের শাসনের নাম করে যে ব্যবহার করা হয় তা বিজ্ঞানসন্মত নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, নিয়মভঙ্গের জন্য স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ভয়, মা-বাবাকে ডেকে পাঠানো, নানাবিধ শারীরিক শাস্তি প্রদান, কথা দিয়ে আঘাত করা। এগুলো শিশু শিক্ষার্থীকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং মনোজগতের বিরাট ক্ষতি সাধন করে। শিশু মনের এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে পরবর্তীতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এক সময় ভাবা হতো, পরিবারের পরই শিশুর নিরাপদ স্থান হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণাটির আমূল পরিবর্তন ঘটছে। তবে কি অদূর ভবিষ্যতে শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে শিক্ষিত করে তোলার দিকেই সবাই এগিয়ে যাবে? আর তা হলে মন্দ কি! অন্ততপক্ষে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি থেকে শিশু শিক্ষার্থী তো বাঁচবে।

Please follow and like us: