জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
সিস্টার কস্তানতিনা রায়; একজন জীবন্ত ইতিহাস। আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতেই জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাঁটিয়েছেন। তৎকালীন বৃহৎত্তর আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীর এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত চষে বেরিয়েছেন তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামের সাঁন্তাল পল্লীতে কাঁটিয়েছেন মাসের পর মাস। কষ্ট-যন্ত্রণাকে আলগোছে পাশে রেখে আনন্দের আতিশায্যে ভাসিয়েছেন নিজেকে। বোর্ডিংএ মেয়েদের শিক্ষা ও গঠনদানে নিয়োজিত রেখেছেন সব সময়। দায়িত্ব আর কর্তব্যকে সব কিছুর ওপর স্থান দিয়েছেন অকাতরে। আর সবই করেছেন যিশুকে প্রচারের নিমিত্তে। চোখের সামনে বৃহৎত্তর আন্ধারকোঠা থেকে আরো ধর্মপল্লীর জন্ম হতে দেখেছেন। সময়ের ধারাপাতে আজ তিনি বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জপ্রায়। এখনো আন্ধারকোঠার মায়া ছাড়তে পারেন না। শারীরিক সক্ষমতা নেই এখন আর কিন্তু মনের জোরেই এখনো দায়িত্ব-নিষ্ঠতার পরিচয় বহন করে চলেছেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি দিনাজপুরের গনেশতলায় সিস্টার কস্তানতিনা রায়ের জন্ম। বাবা রতন রায় ও মা শিউলী রায়। দু’বোনের মধ্যে সিস্টার কস্তানতিনা বড়। এম্মা রায় (ফাদার আন্তনী সেনের মা) ছোট। গনেশতলায় বাবা রতন রায় মিষ্টির কারিগর ছিলেন। ব্যবসা মোটামুটি মন্দ ছিলো না। ৪/৫ বছর বয়সে মা মারা যান। আর এ সময় বাবা রতন রায় দু’মেয়েকে নিয়ে বিপদের মধ্যে পড়েন। দু’মেয়েকে কে দেখাশুনা করবে; সে চিন্তায় বিভোর। এমনই মূহুর্তে সিস্টারের বাবা দিনাজপুর সদর হাসপাতালে দু’জন মারীয়া বাম্বিনা সিস্টারের সন্ধান পান। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সিস্টার গাব্রিয়েলা। দু’জনই দিনাজপুর সরকারী সদর হাসপাতালে কাজ করতেন। দু’বোনকে বাবা এতিম হিসেবে সিস্টারদের কাছে তুলে দেন। এরপর থেকে দু’বোন আর কোনদিন বাবাকে দেখেননি।
সিস্টার কস্তানতিনা আর ছোট বোনকে লিটল ফ্লাওয়ার বোর্ডিংএ রাখা হয়। সিস্টার কস্তানতিনা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এ বোর্ডিংএ থাকেন। এরপর গনেশতলা থেকে সরকারী স্কুলে পড়াশুনা করেন। এখানেই তিনি সিস্টার হবার ইচ্ছা পোষণ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২য় বিভাগে তৎকালীন মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এ সময় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর বিশপ ওর্বেট কর্তৃক গনেশতলায় নভিসিয়েট খোলা হয়। সেদিনের কথা সিস্টার কস্তানতিনা এখনো স্মরণ করতে পারেন। বিশপ ওর্বেট এর সেদিনের উদ্বোধনী উপদেশ সিস্টার এখনো স্মরণ করতে পারেন, ‘এই গনেশতলায় ছিলো গনেশ দেবতার মন্দির, আজ থেকে এ জায়গায় হবে খুঁকি মারীয়ার মন্দির’। আর এখানেই প্রথম নভিসিয়েট শুরু করেন সিস্টার কস্তানতিনা, সিস্টার তেরেজিনা (ঢাকা) ও সিস্টার ফিলোমিনা (মাদ্রাজ, ভারত- পরবর্তীতে তিনি ব্রতীয় জীবন ত্যাগ করেন)।
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সিস্টার কস্তানতিনা ভেস্টিশন (ব্রতীয় পোশাক) লাভ করার পর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে যাশোর সিস্টার কনভেন্টে ৬ মাস স্কুলে শিশুদের ধর্মশিক্ষা ক্লাস নিতেন। ১৫ অক্টোবর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৬/৭ মাসের জন্য বোর্ণী ধর্মপল্লীতে পালকীয় সেবা প্রদান করেন। এরপর ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে সিস্টার কস্তানতিনা বোর্ণী থেকে আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতে বদলী হন। ফাদার আঞ্জেলো কান্তন সিস্টারকে তার গাড়িতে করে দিয়ে যান। এ সময় আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতে সিস্টার আঞ্চিলা ও সিস্টার আন্দ্রিনা কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর সিস্টার কস্তানতিনা শেষব্রত গ্রহণ করেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ফাদার জাকোমেল্লী ও ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জনী তখন আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতে। সে সময় প্রায়ই পাকিস্তানী বাহিনী ফাদার-সিস্টারদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতো। বিদেশী সিস্টারগণ থাকায় ফাদারগণ সিস্টার বাড়িতে চা-কফি খাওয়াতে পাকিস্তানীদের নিয়ে আসতেন। উর্দু ভাষা জানায় পাকিস্তানী আর্মি কর্ণেলের সাথে সিস্টার কস্তানতিনার ভালো সম্পর্ক ছিলো। আর্মি কর্ণেল সিস্টারদের একদিন দাওয়াত করলে সিস্টার কস্তানতিনা আর্মি কর্ণেলকে নবাইবটতলায় হামলার কারণে ভৎসর্না করেন। পরবর্তীতে কর্ণেলের অনুরোধে আন্ধারকোঠার অধিন্যস্ত খ্রিস্টান গ্রামের নামের তালিকা দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানী আর্মি আর কোন খ্রিস্টান গ্রামে হামলা করেনি।
ডাকাত কর্তৃক ফাদার মাজ্জনীর মৃত্যু ছিলো সিস্টার কস্তানতিনার জন্য বেদনার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ফাদার চেচ্কাতো ও ফাদার মাজ্জনী তখন আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতে কর্মরত। সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কারিতাস বাংলাদেশ দেশের অবকাঠামো ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করছে। ফাদার চেচ্কাতো কারিতাসের দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় জনগণের ধারণা আন্ধারকোঠা ধর্মপল্লীতে অনেক টাকা-পয়সা রয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগষ্ট। রবিবার দিন। ফাদার চেচকাতো বনপাড়া গিয়েছেন। ফাদার মাজ্জনী নবাইবটতলায় খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন। ফিরে আসেন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে। জুতোর ঘষায় পায়ের এক জায়গায় ছিঁলে যায়। এসেই সিস্টার কস্তানতিনাকে ডাকেন। সিস্টার ঔষধ নিয়ে হাজির হন। ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে দেন। দেখেন ফাদারের মুখটা মলিন। ফাদার মাজ্জনী ঘর থেকে তার আত্মিয়-স্বজনদের ছবি এনে সিস্টারকে দেখান। পরিবারের সবার বিষয়ে সিস্টারের সাথে গল্প করেন।
সে সময় ফাদার বাড়িতে দু’জন রাতে পাহারা দিতো। রাতে ডাকাত আসে। ফাদার বাড়ির গেটের সামনে একজন পাহারাদারকে মেরে ফেলে। আরেকজন পাহারাদার প্রাচীর গলে এসে সিস্টার বাড়িতে খবর দেয়। সিস্টারগণ কোনভাবেই ফাদার বাড়িতে যেতে পারেন না। ডাকাতরা ফিরে গেলে গ্রামের লোকজন এসে ফাদারকে উবুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। ফাদারের বুকে গুলি করা হয়। ফাদারকে বিছানায় শোয়ানো হয়। সিস্টার কস্তানতিনা গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যে ফাদার মারা গিয়েছেন। লাশ পোস্টমের্টাম করে আনার পর পুরনো অফিসে টেবিলের ওপর রাখা হয়। সিস্টার কস্তানতিনা একজন বোর্ডিং মেয়েকে নিয়ে সারারাত মোমবাতির আলোয় ফাদার মাজ্জনীর লাশের পাশে ছিলেন। পরদিন কবরস্থ করা হয়।
১৯৭৪-৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিস্টার কস্তানতিনা কাটেখিস্ট ট্রেনিংএর জন্য দিনাজপুরে ছিলেন। এরপর আবার আন্ধারকোঠায় ফিরে এসে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মফস্বঃলের কাজ শুরু করেন। আদিবাসীদের মধ্যে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাঁটিয়ে দিলেন। আদিবাসীদের বিষয়ে সিস্টারের রয়েছে অঢেল জ্ঞান। সিস্টার কস্তানতিনাকে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে পার্থক্য করতে বললে বলেন, গ্রামের মানুষজন ফাদার-সিস্টারদের গ্রামে আসাকে বড়দিনের মতো মনে করতো। সে সময় জনগণের মধ্যে ধর্মীয়ভাব ছিলো। আগে লোভ-লালশা ছিলো না। এখন জনগণের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন একেবারেই দূর্বল। কাজের দোহাই দিয়ে গির্জা বিমুখতা লক্ষ্যণীয়। চতুরতার চিত্র এখন সবখানে। একই গ্রামের জনগণের মধ্যে দু’তিন ভাগ। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। এক সময় সাঁন্তাল সমাজের বন্ধন ছিলো দৃঢ় এবং অটুট। কিন্তু বর্তমানে সাঁন্তাল সমাজের মাঞ্চি পরিষদ কেমন যেন একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ছে। যা সাঁন্তাল সমাজের জন্য ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়। জীবনমানের কিছুটা উন্নতি হয়েছে তবে আরো এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।
১৯৯৩-২০০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিস্টার কস্তানতিনা স্থায়ীভাবে সুরশুনিপাড়াতে কাজ করেছেন। যদিও এর বহু আগে থেকেই সুরশুনিপাড়াতে আসা-যাওয়া ছিলো। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার আন্ধারকোঠায় ফিরে আসেন। আন্ধারকোঠাতে পাহাড়িয়া আদিবাসীদের দীর্ঘ সময় ধরে তিনি দেখছেন। সিস্টারের অভিজ্ঞতায় পাহাড়িয়াদের ধর্মীয় অনুভূতি ও যথাযথ আচার-আচরণের ব্যাপক অভাব। পাহাড়িয়াদের মধ্যে যারা ধর্মকর্ম করতে চায় তাদেরকে অন্যরা ভণ্ড বলে গালি দেয়। ফাদার, সিস্টারদের গালি, সমালোচনা ও শারীরিক আঘাত করতে আসার চিত্র সিস্টার অনেকবার চাক্ষুষ দেখেছেন। সিস্টার কস্তানতিনা বলেন, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে পাহাড়িয়াদের মধ্যে ব্যক্তিক, নৈতিক-আচরণিক, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা যেমন দেখেছি এখনো ঠিক তদ্বরূপই দেখি। এই অবস্থা থেকে বর্তমান প্রজন্মকে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য আর কোন উপায় নেই। নয়তো সময়ের চক্রাজালে এক সময় পাহাড়িয়ারাও ভেসে যাবে।
সিস্টার কস্তানতিনা বর্তমানে বসে নিজের জীবনের পিছনে তাকিয়ে আত্মোপলব্ধি করে বলেন, ব্রতীয় জীবনে এসে আমি খুশি ও আনন্দিত। আমার জীবনের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। যদিও চোখে দেখতে, শুনতে ও হাঁটতে সমস্যা; অনেক কিছু করতে ইচ্ছা জাগে কিন্তু শারীরিক সীমাবদ্ধতা বাঁধা; তবু এখনো পর্যন্ত বই পড়তে ভালো লাগে। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ সম্বন্ধে সিস্টার বলেন, এই ধর্মপ্রদেশেই জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাঁটিয়েছি। এখানে কাজ করতে সত্যি আমার অনেক ভালো লাগে। অনেক যুবক ফাদার এই ধর্মপ্রদেশের জন্য কাজ করছেন যা ধর্মপ্রদেশকে প্রাণবন্ততা এনে দেয়। বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস যখন প্রথম যাজক হয়ে বোর্ণীতে তখন আমিও বোর্ণীতে কাজ করি। সেই যুবক ফাদার জের্ভাস আজ বিশপ। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশকে সুন্দর করে পরিচালনা করছেন। আমার ভাবতে ভালো লাগে!
বাবার চেহারা আপনার মনে পড়ে? জিজ্ঞাসা করতেই সিস্টার জানালেন, সেই ছোট বয়সে বাবা সিস্টারদের হাতে আমাদের দু’বোনকে তুলে দেন। তারপর তো বাবাকে আর দেখিনি। বাবার চেহারা মনেও পড়ে না। কোনদিন বাবাকে খুঁজিনি। হ্যাঁ, ইচ্ছা হতো বাবাকে দেখার কিন্তু বাবা কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। এরপর ছোট বোন এম্মারও বিয়ে হলো। দু’বোন ছাড়া আমাদের আর কোন আত্মিয়-স্বজন ছিলো না। ছোট বোন মারা যাবার পর ওর ছেলেমেয়েরাই আমার আপন। ওদের কাছেই যাই মাঝে মাঝে ছুটি কাঁটাতে। আমার সম্প্রদায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ; এই সম্প্রদায়ের সিস্টারগণ আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। নয়তো কোথায় হারিয়ে যেতাম আমার বাবার মতো।