ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি।

ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতা এবং ভাটিকান প্রধান পোপ ফ্রান্সিস বাহরাইন দেশের প্রধান বাদশা হামাদ বিন ইসা আল খলিফা-এর আমন্ত্রণে তাঁর তিনদিনের সফর শেষ করেছেন। এটা ছিলো পোপের ৩৯তম বিদেশ সফর। এই বাহরাইন সফরের উপর ভিত্তি করে একটি পর্যালোচনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

পোপ ফ্রান্সিস গত ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ফ্রেব্রুয়ারির ৩ থেকে ৫ পযর্ন্ত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল আবুধাবী সফর করেছিলেন। সেই সফরের মূল বিষয় ছিলো “আন্তঃধর্মীয় সহবস্থান ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন।” একটি মুসলিম দেশে পোপকে যেভাবে সম্মান দেওয়া হয়েছিলো- তা ছিলো বিরল। পোপের আবুধাবী সফর ছিলো তাঁর বিদেশ সফরের মধ্যে অন্যতম সুশৃঙ্খল ও দৃষ্টিনন্দন সফর। আবুধাবী সফরের নেপথ্যে ছিলো একটি বহু প্রাচীন ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস হলো ক্রুসেড। মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ ছিলো এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এই রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধ ইতি টানার জন্য আসিসির সাধু ফ্রান্সিস ১২১৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মিসর দেশ সফর করেছিলেন। সেই সফরে তিনি ধর্মযুদ্ধ বন্ধের জন্য মিসরের তৎকালীন সুলতান আল-মালিক আল কামিল-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের মিশর সফরের আটশত বছরের বর্ষপূর্তী উপলক্ষে পোপের আবুধাবী সফর ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

গত ২০২১ খ্রিস্টাব্দের মার্চের ৫ থেকে ৮ তারিখ পযর্ন্ত পোপ যে ইরাক সফর করেছেন, সেখানেও তাঁর মূল বাণী ছিলো আন্তঃধর্মীয় সহবস্থান, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন। গত সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পযর্ন্ত মুসলিম প্রধান সেন্ট্রাল এশীয় দেশ কাজাখস্তান সফরে পোপের মূল বাণী ছিলো “ধর্মীয় সংঘর্ষ শান্তি স্থাপনের জন্য স্থান তৈরি করতে পারে না।” এর আগে পোপ দ্বিতীয় জন পল ২০০১ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ থেকে ২৫ তারিখ পযর্ন্ত কাজাখস্তান সফর করেছিলেন। তার মাত্র ক’দিন আগে অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা হয়েছিলো। ফলে পোপ ২য় জন পলের কাজাখস্তান সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো। কাজাখস্তানে ৭০ শতাংশ মুসলিম এবং ১৭ শতাংশ খ্রিস্টান, যার অধীকাংশই অর্থোডক্স।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে পোপের এই সফরগুলো একটি মূল বিষয়ে যে বার্তা বহন করেছে, তা হলো- ধর্মীয় সহবস্থান, সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধন। আবুধাবী সফরের সময় খ্রিস্টান-মুসলিম ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত করার লক্ষ্যে সুন্নী নেতা শেখ আহমেদ আল-তায়েব-এর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক স্বারকপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। আল তায়েব হলেন মিশর দেশের আল আজহার প্রতিষ্ঠানের গ্র্যান্ড ইমাম।

পোপের ইরাক সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ বৈঠকটি ছিলো- আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানী, শিয়া ধর্মীয় নেতার সঙ্গে। ৯০ বছর বয়স্ক শিয়া ধর্মীয় নেতা পবিত্র নাযাফ শহরে অবসর জীবন যাপন করছিলেন। ৮৪ বছর বয়স্ক পোপ ফ্রান্সিস এই শিয়া ধর্মীয় নেতার সঙ্গে একান্ত পরিবেশে ৫০ মিনিট সময় ধরে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে উভয় নেতাই ইরাকে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সৌহার্দ ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের উপর তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। শিয়া নেতা সিস্তানী বলেন, “ধর্মীয় নেতাদের একটি দায়িত্ব হলো ইরাকী খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- যেনো তারা পূর্ণ অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন।” উভয় ধর্মীয় নেতাই একমত প্রকাশ করে বলেন যে, এটা ইরাকী খ্রিস্টান এবং একই সঙ্গে মুসলমানদের জন্য উত্তম যদি দেশের ধর্মীয় নেতাগণ একসাথে সহবস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন। আল-সিস্তানী তাঁর দিক থেকে ইরাকী খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা ও পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানীর সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের এই আন্তঃধর্মীয় বৈঠক ছিলো আধুনিককালের ধর্মীয় ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা।

কাজাখস্তানে প্রতি তিন বছর পর পর বিশ্বের বৃহৎ ধর্মের নেতারা বৈঠকে বসেন। এই কংগ্রেস সভায় বিশ্বের মোট ৬০টি দেশ থেকে ১০০ প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। গত সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সপ্তম কংগ্রেস সভায় সভাপতিত্ব করেন কাজাখ প্রেসিডেন্ট কায়সেম জোমার্ট তাকায়েভ। সর্বধর্মীয় কংগ্রেসে উপস্থিত নেতাগণ সবাই ধর্মীয় সহবস্থান, সম্প্রীতি ও বিশ্ব শান্তির কথা বলেছেন। এই কংগ্রেস সভায় রুশ প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বরাবরই রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন দখল সমর্থন করে আসছেন। পোপ ফ্রান্সিস নূর সুলতান কংগ্রেস সভায় একই ভাষায় ধর্মীয় সহবস্থান ও ভ্রাতৃত বন্ধনের কথা পুর্নব্যক্ত করেছেন। আল আজহার প্রতিষ্ঠানের গ্র্যান্ড ইমাম আল তায়েব কাজাখস্থানের নূর সুলতান সর্বধর্মীয় কংগ্রেস সভায়ও উপস্থিত ছিলেন।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের বাহরাইন দেশেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সেক্রেড হার্ট ধর্মপল্লী নামে ক্যাথলিক নির্মিত হয়েছে। তার বহু বছর পরে খ্রিস্টানদের জন্য বাহরাইন সরকার যে জমি দান করেছেন সেখানে নির্মিত হয়েছে আওয়ার লেডি অব আরাবিয়া ক্যাথেড্রাল। ২,৩০০ খ্রিস্টভক্ত ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই ক্যাথেড্রালটি উদ্বোধন করা হয় ৯ ডিসেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। বাদশা হামাদ বিন ইসা আল খলিফা ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ভাটিকান সফরের সময় ক্যাথেড্রালের একটি মডেল নক্সা পোপের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পোপ তাঁর বাহরাইন সফরকালে সেক্রেড হার্ট ধর্মপল্লী এবং আওয়ার লেডি অব আরাবিয়া ক্যাথেড্রাল চার্চ পরিদর্শন করেছেন। বাহরাইনে মোট খ্রিস্টানের সংখ্যা ৮০ হাজার- যারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কর্মী। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাহরাইনেই রয়েছে সেখানকার স্থানীয় নাগরিক খ্রিস্টান- যার সংখ্য এক হাজারের মতো। পোপ বাহরাইনের জাতীয় ক্রিড়া স্টেডিয়ামে এক খ্রিস্টযাগ অর্পণ করেন। এই খ্রিস্টাযাগে বাহরাইন ও আশপাশের দেশ থেকে ৩০ হাজার ভক্ত উপস্থিত ছিলেন। পোপ তাঁর বাহরাইন সফরকালে বিভিন্ন প্রার্থনা ও উপাসনা অনুষ্ঠানে, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে বৈঠকে বার বার শান্তি ও সম্প্রীতির কথা ব্যক্ত করেছেন। বাহরাইনের বাদশা মিলন, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

শুধু যে সফরকৃত দেশগুলোর জন্য পোপের শান্তির বার্তা সীমাবদ্ধ ছিলো- তা কিন্তু নয়। যে দেশগুলো সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, যারা যুদ্ধ ও সংঘাতের ভাষায় কথা বলছে- তাদের প্রতিও পোপ শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ, ইয়েমেন দেশে গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক সংঘাত, কোরীয় উপদ্বীপে সামরিক উত্তেজনা, ইত্যাদি। পোপের ভাষায়, “যুদ্ধ-সংঘাত হলো ঘৃণ্য-অহংকার- হৃদয়ের ভালোবাসা নয়।” এখন থেকে আটশত বছর আগে আসিসির সাধু ফ্রান্সিস ক্রুসেড বন্ধ করে শান্তির জন্য যে বার্তা নিয়ে মিসর সফর করেছিলেন- পোপ ফ্রান্সিস তাঁর মধ্যপ্রাচ্য, সেন্ট্রাল এশিয়া ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল সফরে বয়ে চলেছেনএকই শান্তির বার্তা। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর “সবাই ভ্রাতৃসম” (Fratelli Tutti) নামক সর্বজনীন পত্রে বলেছেন, “বিশ্বের ধর্মগুলোর প্রয়োজনীয় ভূমিকা হলো আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা। কারণ ধর্ম হলো মানব মর্যাদার উৎস। সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা বিরাজমান থাকলে- একাত্ববাদ ও বস্তুবাদ, যা শুধু বিভাজন তৈরি করে- তার বিরুদ্ধে মানবসত্তাকে জাগ্রত করতে পারে।” পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

 

Please follow and like us: