জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
“মন তোরে মাইর খাওয়াবো রে, গুরু গোঁসার কাছে কইয়া
মাইর খাওয়াবো দৌঁড় খাওয়াবো, মারবো দুইটা থেতলা
গুরু গোঁসার নাম করিতে এতো করো হেলা”।
এ রকম আরো বহু বৈঠকী গান যার সুমধুর কন্ঠে বড়দিন, পাস্কায় শোনা যেতো তিনি আন্তনী ক্রুশ। বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনের বয়স একই জায়গায় স্থির ছিলো। তারুণ্য তার সমগ্র শরীরে খেলে যেতো প্রতিটি মূহুর্তে। অভিজ্ঞতার ভান্ডার পরিপূর্ণ। আন্তনী ক্রুশ আজ যেন জীবন্ত ইতিহাস। বোর্ণী ধর্মপল্লীর বহু বিজ্ঞজনের তিনি শিক্ষক, গুরুজন। তার অনেক ছাত্র-ছাত্রীই আন্তনী ক্রুশের আগেই স্বর্গবাসী হয়েছেন। কিন্তু আন্তনী ক্রুশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। নিয়মিত শুনেছেন ভয়েস অফ আমেরিকা ও বিবিসি বাংলা। বাইবেল পাঠ করতেন প্রতিদিন। দেখা হলেই আন্তনী ক্রুশের বাইবেলের ওপর ভিত্তি করে অনেক সুক্ষ প্রশ্ন বেকাদায় ফেলে দিতো।
আন্তনী ক্রুশের জন্ম দিঘইর গ্রামে ১৯ এপ্রিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। বাবা শিমন জন ক্রুশ আর মা তেরেজা রোজারিও। বাড়ির খিতাবী নাম মোয়ালীগো বাড়ি। মোয়ালীগো বাড়ির নাম যার মধ্য দিয়ে হয়েছে তিনি হলেন সাধ্বী আন্না। নামকরণেরও রয়েছে মজার ইতিহাস। স্বামী তারা ক্রুশ মারা গেলে সাধ্বী আন্না মোয়া তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করতো। যেহেতু মোয়া তৈরী করতেন তাই তাকে সবাই মোয়া অলি বলেই ডাকতো। আর মোয়া অলি এক সময় মোয়ালি নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই বংশপরম্পরায় আন্তনী ক্রুশও আন্তন মোয়ালী নামেই পরিচিতি পান।
আন্তনী ক্রুশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় স্ব-শিক্ষিত ছিলেন। বর্তমানে যেখানে জোনাইলের ইউনিয়ন কাউন্সিল, তার সামনে আট চালা স্কুল ঘর ছিলো। আন্তনী ক্রুশ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেছেন। কিন্তু এক ছাত্রকে শিক্ষক কৃর্তক শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কারণে সেখানকার স্কুল ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর আন্তনী ক্রুশ হরিপুর দূর্গাদাস স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। সেই সময় তার সাথে দেবেন সরকার (ত্রি-মোহনী), যাকোব রোজারিও (পান্তিগো বাড়ি) পড়াশুনা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন নি। কিন্তু অন্যের জীবনকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য কাজ করেছেন। বর্তমান বোর্ণী মিশন হলরুমের পূর্ব পাশে পূর্ব-পশ্চিমে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল ছিলো। আন্তনী ক্রুশ সেই স্কুলে একা শিক্ষকতা করেন। তিনি মিশনে শিক্ষকতাকালীন সময়ে ঝড়ে স্কুল ভেঙ্গে গেলে নিজ বাড়ি দিঘইরে স্কুল খুলেন ও প্রায় আড়াই মাস সেখানে শিক্ষা প্রদান করেন। এরপর ফাদার ভিগানো আসার পর মিশন পুকুরের পশ্চিমে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল খোলা হলে আন্তনী ক্রুশ, জন মাষ্টার, এডবিন মাষ্টার ও যোসেফ মাষ্টার শিক্ষকতা শুরু করেন। আন্তনী ক্রুশের শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি শিক্ষার আলো দিয়েছেন যারা আজ প্রতিষ্ঠিত ও অনেকে স্বর্গস্থ হয়েছেন। বিশেষ করে, অপু দেশাই স্যার, পিটার আলমিদা, মার্গেট রোজারিও, আব্রাহাম গমেজ, হেলেনা রোজারিও, সাবিনা দিদিমনি, মনো স্যার, ইলা রোজারিও, যাকোব কস্তা, পল রোজারিও (পলু), চার্লি গমেজ, লালু রোজারিও, ফাদার ইম্মানুয়েল গমেজ (প্রফুল্ল), ফাদার লিও দেশাই, ফাদার প্যাট্রিক গমেজ, ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও, ফাদার পল রোজারিও (জয়গুরু), ফাদার মাইকেল ক্রুশ আন্তনী ক্রুশের কাছে শিক্ষার আলো লাভ করেছেন।
এরই মধ্যে তিনি ২১ বছর বয়সে বাগবাচ্চা গ্রামের মোংলা গমেজের মেয়ে এলিজাবেথ গমেজকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ফাদার ভিগানোর সময়েই তিনি ময়মনসিংহে সরকারী স্কুলে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে চলে যান। সেখানে ৪ বছর শিক্ষকতা করার পর বোর্ণীতে চলে আসেন এবং ফাদার ক্যান্টনকে পাল-পুরোহিত হিসাবে পান। আন্তনী ক্রুশ প্রায় ১৯ বছর শিক্ষকতা করার পর অব্যাহতি নেন এবং বাড়িতে আবাদি জমি চাষ করতে শুরু করেন।
ফাদার ক্যান্টনের সাথে আন্তনী ক্রুশের বেশ সখ্যতা ছিলো। তাই ধর্মপল্লীর অনেক ঘটনা যা ফাদার ক্যান্টনের সময়ে ঘটেছে তা আন্তনী ক্রুশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলে যেতে পারতেন। তিনি বলেন, ফাদার ক্যান্টন এসে হাইস্কুলের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন না বলেন এবং খ্রিস্টভক্তগণকে অনুদান দিতে অনুরোধ করেন। খ্রিস্টভক্তগণ যে টাকা অনুদান দেন তা দিয়ে পরবর্তীতে জোনাইলের ইন্দিরাপাড়ার বিলে ২৫ বিঘা জমি ক্রয় করা হয়। জমি চাষ, ফসল বোনা, কাঁটা এবং আনা ও গোলাজাতকরণে খ্রিস্টভক্তরাই এগিয়ে আসেন। ১ বছর পর ফাদার ক্যান্টন জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর নিয়ে আসেন। সে ট্রাক্টর বাগবাচ্চা গ্রামের পিটার ড্রাইভার চালাতেন।
এরই মধ্যে সিলেটের চা বাগান থেকে খ্রিস্টানদের নিয়ে যাবার জন্য বোর্ণীতে লোক আসে। বোর্ণী ও ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকে অনেক খ্রিস্টভক্ত সিলেটের চা বাগানে চলে যান। সে সময় সিলেটে বাঙ্গালী খ্রিস্টান বসতি এতটাই বিস্তৃতি লাভ করেছিলো যে, তারা সেখানে নিজস্ব গানের দল গঠন করেছিলেন। এখনো বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিস্টভক্ত সিলেটের বিভিন্ন স্থানে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তনী ক্রুশও নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্ব-পরিবারে সিলেটের রশিদপুর চা বাগানে চলে যান। তার রক্তে মিশে ছিলো শিক্ষকতার আনন্দ। আর সে আনন্দ তিনি সিলেটেও ছাড়তে পারেননি। তাই মানুষ গড়ার কারিগর আন্তনী ক্রুশ সিলেটেও বাঙ্গালী খ্রিস্টান ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শিক্ষকতা করা শুরু করেন। ৩ বছর তিনি চা কারখানায় নৈশ্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তার পিতা শিমন জন ক্রুশের অনুরোধে আবার বোর্ণীতে ফিরে আসেন।
আন্তনী ক্রুশ বোর্ণীতে আগ্নেশের পালা, যিশুর দুঃখভোগের পালায় অভিনয় করতেন। বিশেষ করে তিনি আগ্নেশের পালায় সংলাপ বলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। যিশুর দুঃখভোগের পালায় আন্তনী ক্রুশ কয়েকবার যিশু হয়েছেন এবং যুদাস হতেন রাফায়েল ভক্ত। বড়বাড়ির যোসেফ বায়েন হারমোনি বাদক, বাগবাচ্চা গ্রামের জর্জ পালমা ঢোলবাদক হিসাবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
মাইলানি তোর ফুল বাগানে আমারে রাখিও মালী
আমার নাম সুন্দর মালী, শুকনা গাছে ধরাই কলি।
এই গানটি আন্তনী ক্রুশ বৈঠকী গানের আসরে সব সময়ই গাইতেন। গানটির লাইনের সাথে তার জীবনটা যেন মিশে গিয়েছে। আন্তনী ক্রুশের সংস্পর্শে এসে কত মানুষ যে জীবনের শিক্ষা লাভ করেছেন তা শেষ করা যাবে না। যখন বোর্ণী মিশনে শিক্ষার আলো এসে পৌচ্ছায় নি সেই সময় তিনি সবার জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আসেন। এ যেন শুকনো গাছে কলি ফুটানোর মতই অবস্থা। আন্তনী ক্রুশ একজন সার্থক ব্যক্তি। গল্পের ফাঁকে তিনি সব সময় বলতেন, এখনো যখন অনেকে স্যার বলে সন্মোধন করেন তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তিনি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেন কারো বিষয়ে সমালোচনা করা। যদি কেউ তার কাছে কারো বিষয়ে কখনো সমালোচনা করে তিনি শুধু শুনেন। তিনি সবাইকে দিতে দিতে নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু বিনিময়ে কারো কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেননি। তিনি বলতেন, জীবনে আমার চাওয়া পাওয়া নেই। আমি আমার জন্য সুখী। শিক্ষার বাতিঘর মানুষ গড়ার কারিগর নিভৃতচারী আন্তনী ক্রুশ (মোয়ালী) ২২ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
চৈতালী: পুনরুত্থান সংখ্যা- ২০১৬, বোর্ণী ধর্মপল্লী