জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
সকাল থেকে ভারতীয় শিল্পী অরিজিৎ সিংএর আবেগী ও দরদী কণ্ঠে ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়/ আঁধারের শেষে ভোর হবে/ হয়তো পাখির গানে গানে/ তবু কেন মন উদাস হলো’ গানটি কমপক্ষে বিশবার শুনেছি। গানটির মধ্যে মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত করার মতো একটি বিষয় রয়েছে। বিকাল ৫:৩০ মিনিটে ফেসবুকে ফাদার লিও’র মৃত্যু সংবাদটি পাই। ফাদার লিও দেশাই চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। শরীর বলতে গেলে শক্ত সামর্থই ছিলো। যদিও শারীরিক কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যেতো মাঝে মাঝে। শেষবার ফাদার লিও’র সাথে বনানী সেমিনারীতে দেখা। অনেক গল্পের মাঝে ফাদার তার শরীরের যন্ত্রাংশ যে অকেজো হয়ে যাচ্ছে সেই কথাই ব্যক্ত করেছিলেন। ফাদারের পায়ের দিকে তাকতেই বুঝতে পারলাম পা ফোলা ভাব। তবে শারীরিক কষ্টের চেয়ে ফাদার লিও’র মনের জোর ছিলো বেশ জোরালো। ফাদার লিও দেশাইকে বনানী সেমিনারীতে শিক্ষাগুরু হিসাবে পাওয়াতে তাকে আরো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
ফাদারের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান বিস্তর। কিন্তু ফাদারের সাথে গল্প জমে গেলে বয়সের ব্যবধান দূর হতো নিমিষেই। আর এর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন ফাদার নিজেই। ছোটবেলায় শুনতাম ফাদার ইম্মানুয়েল প্রফুল্ল গমেজ, ফাদার লিও দেশাই, ফাদার প্যাট্রিক গমেজ, ফাদার পৌল ডি’রোজারিও এবং ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও’র নাম। ফাদারগণ প্রত্যেকেই বোর্ণী মায়ের সন্তান। আর আমি বোর্ণী ধর্মপল্লীর হওয়ায় এই কয়েকজন ফাদারকে দেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই ছিলো। সবাইকে দেখার সৌভাগ্য হলেও ফাদার লিও দেশাইকে তখনো পর্যন্ত দেখিনি। এর কারণ হচ্ছে ফাদার লিও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশে কাজ করেছেন এবং উনি উৎসবাদিতে শুধু বাড়িতে আসতেন।
বনানী সেমিনারীতে অধ্যয়নকালে ফাদার লিও দেশাইকে প্রথমবার দেখি। এরপর থেকে ফাদারের সাথে অন্যরকম এক হৃদ্যতাপূর্ণ দাদু-নাতির সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাঝে মাঝে দুষ্টামী করে ফাদারকে দাদু বলে ডাকলে শুভ্র দাঁড়ির ফাঁক গলিয়ে মুচকি একটি হাসি ছড়িয়ে দিতেন। বোর্ণী ধর্মপল্লী তথা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অনেকেই আছেন যারা ফাদার লিও সুকলেশ দেশাইয়ের নাম শুনেছেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেখেননি। মজার বিষয় হচ্ছে- বোর্ণী ধর্মপল্লীতে অনেকেই ফাদার লিও দেশাইকে ফাদার সুকলেশ আবার দেশাই বাড়ির ফাদার নামে চিনে। ফাদার লিও দেশাইয়ের বড় ভাই অপু খ্রিস্টফার দেশাই আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ফাদার লিওকে প্রথমবার দেখে অপু স্যারের মতোই মনে হয়েছে। কথা বলা, হাঁটা চলার মধ্যে অপুর স্যারের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলাম।
ধীরস্থির, শান্ত স্বভাবের ফাদার লিও দেশাইকে বনানী সেমিনারীর লাইব্রেরীতে সময় কাঁটাতে দেখেছি বহুবার। সিঁড়ি বাইতে কষ্ট হতো বিধায় অনেকবার ফাদার লিওকে লাইব্রেরীর দোতালা থেকে বই নামিয়ে দিয়েছি। একটা মানুষ বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যে এতটাই দখল রাখতে পারেন কিভাবে তা ফাদার লিওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। বগলদাবা করে সাহিত্যের বই তিনি ঘরে নিয়ে যেতেন। কতদিন লাগবে পড়তে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘দূর পড়ি নাতো, ঘরে ফেলে রাখি’ বলে একগাল হাসি ছড়িয়ে দিতেন। শুনেছি ফাদার লিও দেশাই এমনই বইয়ের পোকা ছিলেন যে বই পড়তে পড়তে সারারাত পার করে ফেলতেন।
ফাদার লিও দেশাই আমার লেখার যেমন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তেমনি ছিলেন কড়া সমালোচনাকারী। আর ফাদারের এই দিকটি আমার বেশ ভালো লাগতো। ফাদার লিও দেশাই বছরের তিনটি মাস বনানী সেমিনারীতে অবস্থান করে শিক্ষকতা করতেন। আর এই তিনটি মাস ফাদারকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। প্রায়ই বলতাম, ফাদার আপনি এতো পড়েন কিন্তু লেখেন না কেন? ফাদার বলতেন, আমার লেখার হাত কাঁচা! আমার দ্বারা হবে না। একবার এক সেমিস্টারে বনানী সেমিনারীতে ফাদার লিও দেশাই সেমিনারীয়ানদের জন্য অর্ধদিবসব্যাপী একটি কর্মশালা চালাবেন। তাই তার প্রস্তুতির পালা। ফাদার লিও দেশাই আমাকে তার উপস্থাপনার বিষয়বস্তু মুখে বলেছেন আর আমি তা ফাদারকে কম্পিউটারে লিখে দিই। সে সময় দেখেছি ফাদার স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি সাধারণ বিষয়কে কত বিশদভাবে বলতে পারেন। ফাদার লিও দেশাই ছিলেন বাংলাদেশের ফাদারদের মধ্যে প্রথমসারির পিএইচডি ডিগ্রীধারী। এছাড়াও জার্মান ভাষার ওপর তার বেশ দক্ষতা ছিলো। তিনি মণ্ডলির যে একজন নির্মোহ সেবক ছিলেন তা তার জীবনের বহু ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে।
ফাদার লিও’র কিছু অদ্ভূত অভ্যাস ছিলো। এ নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। প্রতিদিন সকালবেলা ফাদার গ্লাসে করে পান্তাভাত খেতেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে পান্তাভাত নিয়ে ইতিবাচক গবেষণার কথা ফলাও করে ঘোষণা করতেন। আমাদের কথায় কখনো রাগ করতে দেখিনি ফাদারকে। ফাদার লিওকে অনেকেই হুজুর বলে সন্মোধন করতেন; ফাদারও মজা করে উত্তর দিতেন বেশ। শান্ত স্বভাবের হলেও ফাদার লিও সত্য বলতে কখনো দ্বিধাবোধ করেননি। সত্য কথাই তিনি এমন শান্তভাবে বলতে পারতেন যা কাউকে কখনো পরাভূত করতো না। ফাদার লিও আগের মানুষদের বেশ খোঁজখবর রাখতেন। অনেক মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেনও। শুনেছি বাড়িতে এলে ফাদার নিজ গ্রামের বাড়িগুলো ঘুরতেন। ফাদার দিলীপ এস. কস্তার যাজকীয় অভিষেকের রজত জয়ন্তীতে ফাদার লিও দেশাইয়ের সাথে দেখা। আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ফাদার লিও’র হাতে দিলে তিনি খুব খুশি হয়ে বলেন, ‘তোমার বইটি আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলবো’। এরপর কয়েকবারের সাক্ষাতে বইটি নিয়ে তিনি আলাপচারিতা করছেন।
ফাদার লিও দেশাইয়ের মৃত্যু খবর দেখে প্রথমে যে উপলব্ধিটা মনে জাগলো, আমরা একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছি। বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলেও ফাদারের মৃত্যুর কারণ জানতে পারিনি। অতঃপর দিনাজপুর থেকে একজন ফাদারের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ জানতে পারলাম। গত ১ ডিসেম্বর কাশি, জ্বর এবং লাঞ্চ ইনফেকশনের কারণে ফাদার লিও দেশাইকে দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি করানো হয়। তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন বিধায় ফলো আপ ও ভালো সেবা শুশ্রুষার জন্য সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে আনা হয়। সেখানেই বিকাল ৪:৩০ মিনিটে ফাদার লিও দেশাই নামক পঁচাত্তর বছর বয়সী নক্ষত্রের মৃত্যু হয়। ফাদার লিও দেশাইএর মৃতদেহ নিজ ধর্মপল্লী বোর্ণীতে আনার পর দিনাজপুরে কসবা বিশপ হাউজ প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হবে। শারীরিক দিক দিয়ে মৃত্যু হলেও ফাদার লিও দেশাইএর মতো ভালো মানুষের কখনো মৃত্যু হয় না।