জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা সমন্ধে সবাই অবগত আছি। মাত্র করোনা ভাইরাসের তান্ডব থেকে পৃথিবীর মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। করোনা ভাইরাস নেই বললেই চলে। এখন চলছে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলাফল যে কি ভয়াবহ তা বিশ্বের প্রতিটি দেশ অভিজ্ঞতা করছে। যুদ্ধের কারণে অনেক দেশের পণ্য রপ্তানি-আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। তেল গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেশগুলো না পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে অস্বাভাবিক হারে। কৃষক পড়েছে মহাসঙ্কটে। পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়াতে পণ্যের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে বহুগুণ। পক্ষান্তরে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হৃাস পেয়েছে। ভোক্তার আয় সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি।

পৃথিবীর দেশগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত এখন। রাশিয়ার পক্ষাবলম্বনকারী দেশগুলো রাশিয়ার পণ্য আমদানি করছে। আবার ইউক্রেন তথা ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর পক্ষের দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে না। বাস্তব কথা পৃথিবী তো আর দুটি গ্রহ নয় যে দুটি নিজস্ব নীতিতে চলবে। পৃথিবীর নিজস্ব গতি আছে যে গতিকে থামানোর চেষ্টা মানেই বিপদ ডেকে আনা। আমার মনে হয় আমরা বিপদের মাঝখানেই বাস করছি। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আগামী ২০২৩ সালে সারা পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পৃথিবীর মানুষ এই ধরণের ক্রান্তিকাল আর কখনো পার করেনি। পৃথিবী আগে থেকেই নানাবিধ যুদ্ধ সংগ্রামের সাক্ষী। তবে বর্তমানে বিশ্ব যত এগিয়ে যাচ্ছে দেশ ও মানুষের মধ্যে কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিকতা ভর করছে। নিজেদের জাতীয়তাবাদ রক্ষার্থে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কার্যকলাপ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপর নাই’ বাক্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাসনের আস্তাবলে নির্বিকার অবস্থায় পরে আছে।

এত কিছুর পরেও ২২তম ফুটবল বিশ্বকাপের আসর কিছুটা হলেও বিশ্বের মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষ বিগত দুটি মাস যাবৎ ব্যস্ত ছিলো ফুটবলকে কেন্দ্র করে। কাতারের স্টেডিয়ামগুলোতে দেখা গিয়েছে মানুষের ভীড়। যদিও ফুটবল দল সাপোর্টের পাল্লায় পৃথিবীর মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো তবু বলবো এ বিভক্ত দূরত্ব তৈরী করেনি বরং আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিলো। এটাকেই ফুটবল বিশ্বকাপের বড় একটি অর্জন বলবো। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফুটবল উন্মাদনা আরো বেশি করে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের চায়ের স্টলের চায়ের কাপে উঠেছে বিশ্বকাপ ঝড়! ভিন্ন দেশের পতাকার রংএ ভরে গিয়েছিলো গোটা দেশ। প্রিয় দলের সমর্থনে জেগে উঠেছিলো তরুণ থেকে প্রবীণদের গলা। এই ঢেউ চলে গিয়েছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে। পৃথিবীর এতো সমস্যার পরও মানুষ বাঁচতে চায় কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের অনুপ্রেরণায়। এটাই বাস্তবতা- কখনো যুদ্ধ আবার কখনো আনন্দ। আমরা কেউ যুদ্ধ চাই না; আনন্দই হোক গোটা পৃথিবীর একমাত্র লক্ষ্য।

যিশুর জন্মের সময় পৃথিবীটা বড় ছোট ছিলো। মানুষের চিন্তা ছিলো সীমাবদ্ধ। আমেরিকা মহাদেশ তখন কল্পনার বাইরে। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা ব্যাতিত অন্য কোন মহাদেশের অস্তিত্ব ছিলো কিনা সন্দেহ। যদিও তখন পৃথিবীর আকার ক্ষুদ্র তবু শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতনে সাধারণ মানুষ ছিলো জর্জরিত। রোমানরা তখন পৃথিবীর অনেক দেশকে তাদের উপনিবেশ হিসাবে রাজত্ব করতো। প্যালেস্টাইনও এর বাইরে নয়। রোমানরা ইহুদী জাতির ওপর শাসনের জাতাকল বেঁধে দিয়েছিলো। শুধুমাত্র রোমানরাই নয় বরং যুগে যুগে ইহুদী জাতি অন্যান্য অনেক সভ্যতা দ্বারা চালিত হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে ইহুদীরা এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির প্রতিক্ষায় ছিলো। তাদের ধারণা ছিলো ইয়াওয়ের প্রেরিতজন তাদের রাজনৈতিক বন্দিত্ব থেকে উদ্ধার করবেন। যিশুর শিষ্য ও অনুসারীদেরও যিশুর সমন্ধে ঠিক একই ধারণা ছিলো। যিশু যেহেতু রোমানদের নির্যাতন থেকে ইহুদী জাতিকে উদ্ধার করেননি তাই ইহুদীদের কাছে যিশু প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা নন। যিশুর জন্ম রাজনৈতিক মুক্তি দান নয় বরং ইহুদী জাতির মানসিক মুক্তিদানই ছিলো প্রধান। বৈশ্বিক বিধিনিষেধ যা মানুষকে মুক্তি দেওয়ার বিপরীতে আরো আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে তারই শৃঙ্খল ছিন্ন করেছেন যিশু।

বর্তমানে বিশ্বের মানুষ নানাবিধ বন্দিত্ব অবস্থায় রয়েছে। কতিপয় ক্ষমতাশালী দেশগুলো অন্যান্য দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ শাণিত করে রেখেছে। পান থেকে চুন খসে পড়লেই আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। কৃত্রিম খাদ্য ও অর্থ সংকট তৈরী করে মানুষের নার্ভিশ্বাস উঠে যাবার অবস্থা। পৃথিবীর এমন এক অবস্থা যেন মোড়লদেশগুলোই পৃথিবীর মালিক। যুগে যুগে যে মার খেয়েছে দরিদ্র সেই চিত্রই দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। যিশুর জন্মলগ্নের অবস্থা আর বর্তমান প্রেক্ষাপটের মধ্যে মিল রয়েছে। শুধুমাত্র পৃথিবী নয় সমাজ ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত মান্দাতামলের ধ্যান ধারণা পোষণা করে। যার আছে ভুড়ি ভুড়ি তাকে তোষামোদেই ব্যস্ত সবাই। ‘যার নুন আনতে পানতা ফুরোয়’ সে আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনই আছে; শুধু নীতির পরিবর্তন এসেছে কিন্তু কার্যে কোন পরিবর্তনই আসেনি। আইনপ্রণেতা ধনী আর আইন মান্যকারী সমাজের দরিদ্রশ্রেণী। যিশু ধনী গরীব সবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে যিশু জন্মেছিলেন দরিদ্রবেশে দরিদ্র স্থানে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান/দানিয়াছ খ্রিস্টের সন্মান’।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যিশু আবার জন্মগ্রহণ করতে চান। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশু নিরাপত্তা পৃথিবীর অন্যতম দুটি সমস্যা। ২০২২ বছর পূর্বে যিশুর জন্মের সময় একটি নির্দিষ্ট জলবায়ু ছিলো। শীতের রাতে যিশু জন্মগ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। সাথে বৃষ্টি ছিলো বলেও অনেকে মনে করেন। শীতের রাতে মাতা মেরী ও সাধু যোসেফ কোন আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এখনো প্রকৃতিতে শীত আসে, বৃষ্টি হয় কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে যা আসার কথা সেখানে কেমন যেন ছন্দপতন। আর এর পিছনে মনুষ্যসৃষ্ট কারণই দায়ী। আমাদের এই মাতৃতুল্য ধরিত্রী আজ নানাভাবে ধর্ষিত। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর যেভাবে পরিবর্তন ঘটছে তা মানব সভ্যতাকে একটা হুমকীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ধরিত্রী আজ প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে মানবজাতির উপর। স্বার্থন্বেষী মহলের কারণে পৃথিবীর মাটি, পানি ও বায়ু আর আগের অবস্থায় নেই। দিনে দিনে জলবায়ু দ্রæততর উষ্ণতায় রূপান্তরিত হয়ে জনগণ, প্রাণীজগত, দেশের ভৌগলিক অবস্থা ও পরিবেশের জন্য নানা সমস্যা বয়ে আনছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক তদ্বরূপ এ থেকে উত্তরণের উপায়ও খুঁজে ফিরছে সবাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণামের কথা চিন্তা করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সমগ্র পৃথিবীর একসাথে কাজ করা দরকার।
যিশুর জন্মের পর শিশু যিশুর নিরাপত্তাও লঙ্ঘিত হয়েছে। যিশুকে হত্যা করার জন্য যুদেয়ার রাজা হেরোদ উন্মাদপ্রায় হয়ে পড়ে। বেথলেহেম নগরের দুই বছরের নিচের সকল শিশুদের হত্যার নির্দেশ দেয় হেরোদ। এখনো পর্যন্ত শিশু নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয়। হেরোদের মত উন্মাদ রাজারা দেশ ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে। প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর শিশু নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে আসে। শিশুদের প্রতি সকল ধরণের শারীরিক ও আবেগিক দূর্ব্যবহার, যৌন হয়রানি, অবহেলা বা অজ্ঞাসূচক ব্যবহার, ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাদেরকে ব্যবহার বা অন্য কোন প্রকারে তাদেরকে শোষণ করা যার ফলে শিশুর স্বাস্থ, বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা বা পারস্পরিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে মর্যাদা প্রদান, আস্থা বা ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে তাদের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। সকল শিশুর সকল ধরণের নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাবার অধিকার আছে।

পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা ভালো নেই তা যে কেউ বলবে। বৈশ্বিক জলবায়ু থেকে শুরু করে মানুষের মনস্তাত্তি¡ক দিকের আমূল পরিবর্তন ঘটছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানব জাতি কিন্তু হারিয়ে যেতে বসছে মানবিকতা। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধেংহী মনোভাব মানবিকতা বিপর্যয়ের চূড়ান্ত প্রমাণ। মানুষের মূল্য বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শ পৃথক হওয়াতে জনগণের কল্যাণ না দেখে দলের কল্যাণে নিজেকে বাজি রাখার চিত্র আজ বিশ্বব্যাপী। গরীবের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে বিদেশের মাটিতে স্বপ্ন বোনার অলৌকিকতা লৌকিকতায় রূপ নিচ্ছে। শিশু নিরাপত্তা হুমকীর মুখে। যে শিশু আজ বেড়ে ওঠছে তার জন্য সুষম জলবায়ু রেখে যাচ্ছি কিনা না সে প্রশ্নও আজ সামনে হাজির। এমনই পরিস্থিতিতে যিশু আবার জন্মগ্রহণ করতে চান পৃথিবীতে। দূর করতে চান যত জঞ্জাল ও ময়লার ভাগাড়। যেমন ভাবে দূর করেছিলেন জেরুসালেম মন্দিরে ব্যবসায়ীর যত পসরা!

 

 

Please follow and like us: