জন-জীবনের কথা

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

প্রাইমারীতে অধ্যয়নকালীন হাইস্কুলের গন্ডিতে  পৌঁচ্ছানোর তীব্র আকাঙ্খা কাজ করতো। চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থেকেছি কবে হাইস্কুলের গন্ডিত মারাবো। মনে হতো হাইস্কুলে গেলেই বড় হয়ে যাবো একদিনে। তখন হাইস্কুল ও প্রাইমারী একই প্রাঙ্গণে হওয়ায় হাইস্কুলের শিক্ষকদের দেখতে পেতাম। তাদের ধীর-স্থির পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া দেখে মনে হতো জ্ঞানের তীব্র মার্গে তাদের বাস। তখনকার প্রত্যেকজন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে নিরূপণ করা ছিলো সহজ ব্যাপার। অন্যদিকে হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় স্কুলে আসা দেখতে ভালো লাগতো। বগলের নিচে মোটা বই নিয়ে স্কুলে আসা দেখে ভাবতাম জ্ঞানের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সবাই। সে সময় শুনতাম, বীজগণিতের কথা; যা ইংরেজিতে করতে হয়। সাপ্তাহের শুক্রবার হাফস্কুল থাকায় হাইস্কুল ও প্রাইমারীর ছাত্রছাত্রীদের একসাথে এসেম্বলী করতে হতো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখতাম। প্রাইমারীর ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় সঙ্গীতের বারোটা বাজিয়ে দিতো বলে মাঝে মাঝে প্রাইমারীদের প্রতি ১৪৪ ধারা জারি করা হতো। আমরা তখন নীরব দর্শক। মনের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বাসনা থাকলেও আইনের প্রতি স্বশ্রদ্ধ প্রণাম ছিলো।

এ ধরণের বহু স্মৃতির মাঝে দু’জন শিক্ষক ছিলেন সবার মধ্যমণি। অপু এবং মনো স্যারকে আলাদাভাবে ছাত্রছাত্রী ও জনগণ সন্মান করতো। সমাজ ও মণ্ডলিতে দু’জনের অবদান ছিলো অনস্বীকার্য। মানুষের দূর্বলতা থাকাটা স্বাভাবিক; দু’জনের মধ্যেও অনেকক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা ছিলো তবে তাদের অবদানের কাছে সেগুলো তুচ্ছ। শিক্ষাক্ষেত্রে অপু ও মনো স্যারের শিক্ষা প্রদান পদ্ধতির অভিনবত্ব সবাইকে আকর্ষণ করতো। হাইস্কুলে ওঠার পর অপু ও মনো স্যারের ক্লাস প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছি। খুব কাছে থেকে দেখেছি তাদের প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণতা! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বোর্ণী ধর্মপল্লীর নিঃস্বার্থ অভিভাবকই ছিলেন অপু ও মনো স্যার।

অপু খ্রিস্টফার দেশাই। যিনি অপু স্যার, খ্রিস্টফার স্যার বা দেশাই স্যার এই তিনটি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে স্যারের জন্ম। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল অপুর স্যার মথুরাপুর ধর্মপল্লীর মিটিল্ডা গমেজকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিয়ের পূর্বেই ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। সামুয়েল স্যারের অবসরের পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অত্যন্ত বিশ্বস্ত্যতা ও প্রশংসার সাথে তিনি তার এই গুরু দায়িত্ব পালন করে যান। যেহেতু তিনি দীর্ঘ সময় ধরে স্কুলের সাথে জড়িত ছিলেন তাই স্যারকে বিভিন্ন এলাকার অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও দেশাই স্যার ধর্মপল্লী, ক্রেডিট ইউনিয়ন ও সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন।

তখন মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। অপু স্যারকে দেখতাম বেত হাতে নীরব ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে। প্রায়শই পেছনে দু’হাত রেখে শ্রেণীকক্ষের বারান্দা দিয়ে পায়চারী করতেন। তবে স্যারকে সহজে কাউকে শাস্তি দিতে দেখতাম না। তবে যদি রেগে যেতেন তাহলে অগ্নিমূর্তি ধারণ করতেন। স্কুল ছাড়াও মাণ্ডলিক কাজে অপু স্যার ছিলেন সব সময় অগ্রগণ্য। রবিবারের খ্রিস্টযাগে উপস্থিত থেকে সব সময় খ্রিস্টবিশ্বাসের পরিচয় বহন করতেন। এছাড়াও বোর্ণী ক্রেডিট ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভায় স্বপ্রতিভ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ত, দূরদর্শিতা, যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ ও বিচক্ষণতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। অপু স্যার ছিলেন যেন সবার অভিভাবক। অপু স্যার কোন কথা বললে সে কথার ওপরে আর কারো কথা বলার ক্ষমতা থাকতো না।

নবম ও দশম শ্রেণীতে আমাদের বাংলা ক্লাস নিতেন অপু স্যার। ক্লাসের প্রথম দিনই তিনি আমাদের ক্লাস নোট করে পড়াশুনা করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও বলেন, বাংলায় যে আমার কাছে পাশ নাম্বার পাবে ম্যাট্রিকে সে ভালো নাম্বার পাবেই। স্যারের কথা শুনে আমাদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দেখা গেল একজন মাত্র ছাত্র পঞ্চাশ থেকে আঠার পেয়ে পাশ করেছে। যাক্ পরবর্তীতে বহু কষ্টে পাশ নাম্বার কোনভাবে উঠতো। তিনি প্রায়ই ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের লক্ষ্য গঠনের কথা বলতেন। স্যার বাংলা সাহিত্য ও ইংরেজীতে বেশ দক্ষ ছিলেন। অপু স্যার যখন ক্লাস নিতেন ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনতো। তিনি প্রায়ই বাংলা সাহিত্যের বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। কত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে তিনি সাহিত্যের রস জুগিয়ে দিয়েছেন। মনে পড়ে স্যার ক্লাসে সাহিত্যের বিষয়ে বেশী আলোচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কত কাহিনী যে তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের কাহিনী অপু স্যার আমাদের বাংলা ক্লাসেই বলেছিলেন। এই উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ’ স্যার এমন মজা করে বলতেন যা আজও কানে বাজে। পরবর্তীতে আমি যখন নটর ডেম কলেজে পড়ি আমাদের বাংলা শিক্ষিকা প্রমিলা ভট্রাচার্য একদিন এই উক্তিটি উল্লেখ করে উপন্যাসের নাম জানতে চেয়েছেন। আমি অবলীলায় অপু স্যারের নিকট থেকে শোনা উপন্যাসের নাম বলে দিলাম। প্রমিলা ম্যাডাম এর পর থেকে আমাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করতেন।

সাহিত্যে আরোহণ ও সাহিত্যরস আহরণ কিভাবে করতে হয় অপু স্যার আমাদের শিখিয়েছেন। স্কুলে বড় কোন ছুটির আগে তিনি সব সময় বলতেন লিস্ট করে বিখ্যাত বইগুলো পড়ে ফেলতে। এবং বছর শেষে কে কতটি বই পড়েছি তা তিনি জিজ্ঞাসা করতেন। অপু স্যারের উৎসাহেই আমরা কয়েকজন পড়ুয়া ছাত্র স্কুলের ছুটির পর লাইব্রেরী থেকে বই নেবার আশায় বিশ্বরঞ্জন স্যারকে গিয়ে ধরতাম। প্রধান শিক্ষকের বর্তমান অফিস ঘরের জানালার পাশে ছিলো অপু স্যারের টেবিল। একদিন বরান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। তাকিয়ে দেখি অপু স্যার বই পড়ায় ব্যস্ত। বইটির নাম দেখেছিলাম ‘সঞ্চয়িতা’। তখন বুঝতে পারিনি কার লেখা। পরবর্তীতে ঠিকই বুঝেছি অপু স্যার ছিলেন রবি ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্তপাঠক। এছাড়াও শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ থেকে কত কাহিনী যে তিনি আমাদের শুনিয়েছেন তার শেষ নেই। জানি না বর্তমানে বাংলা শিক্ষকরা নিজেরা বই পড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যরস জোগাতে সক্ষম কিনা!

দশম শ্রেণীতে ঠিক টেস্ট পরীক্ষার আগে অপু স্যার নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন বলা আমাদের নোটগুলো চাইলেন। হায়! আমরা তো কেউ নোট করিনি। কি করি! স্যার বলে দিলেন, কেউ যদি নোট জমা না দেয় তাহলে টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করানো হবে না। কি আর করা। তড়িঘড়ি করে সবাই নোট করতে বসে গেলাম। ফলে হয়েছে কি সকল প্রশ্নের উত্তরগুলো নোট করাতে পড়তে হয়েছে আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। স্কুলের শৃঙ্খলা রক্ষায় অপু স্যার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। শুনেছি যে, একবার স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন সরকারী কর্মকর্তা। স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই কর্মকর্তার জিজ্ঞাসা, স্কুল কি ছুটি? অপু স্যার বললেন, না তো! কর্মকর্তা অবাক হয়ে বললেন, স্কুলে তো কোন প্রকার চিৎকার চেঁচামেচি শুনছি না? কর্মকর্তা অন্যান্য স্কুলের অভিজ্ঞতার আলোকে ভেবেছিলেন এই স্কুলেও একইভাবে চিৎকার, হৈহুল্লোড় থাকবে হয়তো।

অপু স্যারের মৃত্যুটা আসলে অপ্রত্যাশিত। শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছিলো তবে তিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন কেউ ভাবতে পারেনি। অপু স্যার ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন অবস্থায় ঢাকায় হৃদযন্ত্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্যারের অন্তোষ্ট্যিক্রিয়ায় বহু লোকের সমাগম হয়েছিলো। স্যারের মৃত্যুর কিছুদিন পর স্যারের অভাব সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মপল্লীতে খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।

মনো স্যার নামেই সবচেয়ে বেশী পরিচিত ছিলেন এন্ডু মনো গমেজ। মনো স্যারের জš§ ১৬ মে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ অক্টোবর বাগবাচ্চা গ্রামের মেরী রোজারিওকে বিয়ে করেন। স্কুলের মধ্যে হাস্যরসবোধ শিক্ষক হিসাবে মনো স্যার ছিলেন জনপ্রিয়। ছাত্রছাত্রীরা মনো স্যারের সাথে একজন অভিভাবক এবং বন্ধুর মতো কথা বলতে পারতো। ইংরেজীতে দক্ষ হিসাবে মনো স্যারের প্রশংসা ছিলো বেশ। তাই বেশীর ভাগ শ্রেণীতে তিনি ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী ঞবহংব তিনি যাদের একবার শিখিয়েছেন তারা আর কখনো ভুলে যায়নি। তার শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। শিক্ষকতা ছাড়াও মনো স্যার ধর্মপল্লী, ক্রেডিট ইউনিয়ন ও সামাজিক নানাবিধ কাজে জড়িত ছিলেন। “তোমার রাজ্য আসুক প্রভু, তোমার রাজ্য আসুক” গানটি যখন তিনি গির্জায় খ্রিস্টযাগে হারমোনিয়ামে তুলতেন তখন ভক্তিময় একটা পরিবেশের সৃষ্টি হতো।

আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। মনো স্যার আমাদের ইংরেজি ক্লাস নেন। এমনিতেই নতুন ক্লাস। পড়াশুনা বুঝতে একটু কঠিন লাগে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা তখন চলছে। ইংরেজি পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছি। প্রশ্নপত্রের কিছুই বুঝি না। পরীক্ষার সময় চুপচাপ বসে আছি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি প্রায় সবারই একই অবস্থা। মনো স্যার পরীক্ষার হলে এলেন। আমাদের অবস্থা দেখে দেখি তিনি মুচকি হাসছেন। বললেন, প্রশ্ন কি কঠিন হয়েছে? ভীষণ কঠিন হয়েছে শুনে বললেন, ক্লাসে মনোযোগী না থাকলে হবেই তো। আমরা কয়েকজন সাদা কাগজ জমা দিতে গিয়েছি। মনো স্যার দেখে বললেন, জায়গায় গিয়ে কিছু একটা লেখেক; নাম্বার দিইয়ি দিবোনি! কি আর করা। আবার জায়গায় গিয়ে বসলাম। কিন্তু কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না।

মনো স্যার ধুমপান করতেন খুব। হাতে সব সময় দেয়াশলাই থাকতো। মাঝে মাঝে দেয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে দাঁত খুঁচাতেন। মনো স্যারের ‘সেন্স অফ হিউম্যার’ ছিলো বেশ। যে কোন ভাড়িক্কী পরিবেশে মনো স্যারের কথায় প্রাণ ফিরে আসতো। মূহুর্তেই সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো। শোনা কথা; একবার নাকি ইচড়ে পাক্কা কয়েকজন ছাত্র রাতের বেলা বিড়ি খাবার জন্য দেয়াশলাই খুঁজছে। পথমধ্যে এক লোককে আসতে দেখে ছাত্ররা গিয়ে লোকটিকে বললো, ভাই ম্যাচটা দেন তো! লোকটিও ম্যাচ বের করে দিলো। বিড়িতে আগুন জ্বালাতেই বাঁধে বিপত্তি! দেয়াশলাইয়ের আগুনে দেখে সামনে এতো মনো স্যার। কিসের বিড়ি জ্বালানো; ছাত্ররা তখন পালাতে পারলে বাঁচে। পরদিন মনো স্যার ক্লাসে এসে হাস্যরসাত্মকভাবে বললেন, ছাত্ররা আজকাল আমার কাছে ধুমপানের জন্য ম্যাচও চায়! স্যারের ইংরেজি জ্ঞান ছিলো চমৎকার। ইংরেজি তিনি পানির মতো সহজ করে বুঝাতে পারতেন। আশেপাশের স্কুলগুলোতেও সবাই তা জানতো। শুনেছি মনো স্যার একাধিকবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে যে মনো স্যারের ইংরেজি শিখানোর অভাব কখনো পূরণ হবে না।

মনো স্যারকে কখনো ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক আঘাত করতে দেখিনি। এটা সত্য যে, তিনি হাতে বেত নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন; মারতে গিয়ে এমন ভাব করতেন মনে হয় চরম আঘাত করবেন। কিন্তু বেত দিয়ে আঘাত করার স্টাইল দেখলে ছাত্রছাত্রীরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো। ক্লাসে কোন ছাত্রছাত্রীকে দুষ্টামী করতে দেখলে মনো স্যার পাশের জনকে ইশারায় বলে দিতেন দুষ্টামীরত দুজনের মাথায় ঢিস মারতে। আর এটা নিয়েও ক্লাসে চরম আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো। ছাত্রছাত্রীরা হাসি থামিয়ে রাখতে পারতো না। সবাই অপেক্ষায় থাকতো মনো স্যারের ইশারা দেখার জন্য। কেউ কেউ আছেন যাদের কথা শুনতে বেশ মজা লাগে। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা দ্বারা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পারেন। আমার মনে হয় মনো স্যার ছিলেন সেই ধরণের ব্যক্তিত্বের। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মনো স্যার ধারাভাষ্যের দায়িত্ব পালন করতেন। যে ব্যক্তি কোনদিন হাসেনি স্যারের ধারাভাষ্য শুনে সেও যে হাসবে তা নিশ্চিত বলা যায়। স্কুলের ফুটবল খেলায় স্যারকে খেলা পরিচালনার দায়িত্ব নিরপেক্ষতার সাথে পালন করতেও দেখেছি।

অসুস্থ্যতাজনিত অবস্থায় হাইস্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর মনো স্যার বাড়িতেই ছিলেন। সে সময় আমি সেমিনারীতে। একবার ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। এক রবিবারে দেখি মনো স্যার গির্জায় এসেছেন। সম্ভবত তখন তিনি লাঠি নিয়ে চলাফেরা করতেন। খ্রিস্টযাগের পর স্যারের সাথে দেখা। বললেন, আমাকে ব্রিজটা পার করে দিয়ে আয় তো! মনে আছে স্যারকে ধরে মিশনের বড় গেটের কাছে যাই। স্যার বললেন, একটু দাঁড়া; বিড়ি ধরিয়ে নিই। স্যারকে বিড়ি খাওয়ার কথা নিষেধ করাতে বললেন, দূর…যতদিন বেঁচে আছি খেয়ে যাই তো আগে! এরপর আর কিছু বলার ছিলো না। স্যারকে ব্রিজ পার করে দিয়ে ফিরে আসি। ছাত্রছাত্রী ও মানুষের মাঝে আনন্দদানকারী ঈশ্বরের সেবক মনো স্যার ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
বোর্ণী ধর্মপল্লীকে আজকের অবস্থানে আসতে অনেকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ছিলো। কালের ধারায় এখনো পর্যন্ত সে চক্র অব্যাহত রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট লগ্নে অনেকের মাঝে কিছু ব্যক্তি সর্বত্র সকল শ্রেণীর মাঝে রেখাপাত করতে পেরেছেন। আমি মনে করি অপু ও মনো স্যার তাদের মধ্যে অন্যতম। দুই জন ছিলেন দুই ধরণের ব্যক্তিত্বের তবে দুইজনই জনগণের মাঝে একই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। অপু ও মনো স্যারের চলে যাওয়াটা এক বছরের ব্যবধানে হওয়ায় বড় একটি সংকট পার করতে হয়েছে বোর্ণী ধর্মপল্লীকে। বিশেষভাবে অপু দেশাই স্যারের মৃত্যুতে সেন্ট লুইস উচ্চ বিদ্যালয় হারিয়েছে একজন যোগ্য প্রধান শিক্ষককে। যার ফল পরবর্তীতে বহু বছর যাবৎ টানতে হয়েছে। আর মনো স্যারের অসুস্থ্যতায় একজন ইংরেজির জাহাজকে হারিয়েছে প্রতিষ্ঠান। আর দুইজনের মৃত্যুকে একত্রিত করে বলা যায়, অপু ও মনো স্যারের চলে যাওয়ায় বোর্ণী ধর্মপল্লী দুইজন যোগ্য অভিভাবককে হারিয়েছে; যার ঘানি পরবর্তীতে টানতে হয়েছে বহু বছর যাবৎ।

 

Please follow and like us: