জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
ভাষার মাস এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের দিকে সবাই দৃষ্টি দেয়। তখন বাংলা ভাষা গেল গেল বলে রব উঠে। ফেব্রুয়ারি চলে গেলে যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্নতে রূপ নেয়। তবে আমি বলবো, বাংলা ভাষাকে যেন প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করা হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে বাংলা ভাষাকে আঁতুড় ঘরে পাঠাতে পারলেই যেন বাঁচে। বাংলা ভাষা ধর্ষণের প্রাথমিক কাজটা হচ্ছে ভাষা বিকৃতি। বাংলা ভাষা বিকৃতি নতুন কোন ইস্যূ নয়। ভাষা বিকৃতির চিত্র হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা বিকৃতির চিত্র ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকৃতভাবেই লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা আগুনের মধ্যে যেন ঘি ঢেলে দিচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের ভাষার প্রতি সে দেশের জনগণের যে দরদ, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রয়েছে সে তুলনায় বাংলা ভাষার প্রতি বাঙ্গালীর যেন অনেকাংশে কমই।
সাদা চামড়ার বিদেশীদের প্রতি বাঙ্গালী বরাবরই দূর্বল। বিদেশীদের দেখলে অধিকাংশেরই কথা বলার আগ্রহ জাগে। ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই নিজেকে স্মার্ট ভাবে। আমাদের গ্রামের এক পরিবারে একজোড়া ব্রিটিশ দম্পত্তিকে আসতে দেখতাম। গ্রামের প্রতি তারা এতই আকৃষ্ট ছিলো যে শেষে ঐ পরিবারের সাথে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ব্রিটিশ মহিলা চমৎকার বাংলা শিখে যায়। মহিলার মুখে গ্রামের আঞ্চলিক বাংলা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়তো। একবার হয়েছে কি- ব্রিটিশ দম্পত্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমাদেরই বাড়ির পাশের স্কুলপড়ুয়া এক ছেলে দম্পত্তির সামনে গিয়ে ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করে দিলো। বিপরীতে আঞ্চলিক বাংলায় মহিলার উত্তর শুনে ছেলেটি এমনই লজ্জা পেলো যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউরোপের অনেক দেশের জনগণ সে দেশের ভাষা জানা না থাকলে কথার উত্তর দিতে চান না। তারা নিজের ভাষাকে এমনই ভালবাসেন যে, বিদেশীরা আগে তাদের ভাষা শিখুক তারপর কথা বলবে। তবে আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র; নিজের ভাষাকে বিকিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ জাগে না।
‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’ বাক্যটির সাথে আমাদের দেশের ভাষাও জড়িত। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছিলো কিন্তু দুঃখের বিষয় সে ভাষার মান রক্ষার্থে প্রচেষ্টা এখন সময়ের চাহিদা। বাংলা ভাষার অবিকৃত রূপ ঐতিহ্য ধরে রাখা যেন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমরা হারাতে বসেছি প্রকৃত বাংলা ভাষাকে। ভাষা নদীর প্রবাহের মতো সর্বদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু ইচ্ছাকৃত বাংলা শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ভাষা বিকৃতির প্রাথমিক চিত্র বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মহামারি আকার ধারণ করছে। বাংলা ভাষার মধ্যে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যার অর্থই পাল্টে দিচ্ছে। প্রকৃত পরিপূর্ণ এবং যথাযথ শব্দ যথাস্থানে ব্যবহার না করা যেন বর্তমানে একটি ফ্যাশন। সংক্ষিপ্তাকারে শব্দ ব্যবহার করার ফলে অনেকেই তা বুঝতে পারছে না।
তরুণদের মধ্যে প্রচলিত একটি শব্দ হচ্ছে ‘প্যারা’। কথায় কথায় অনেকে মা বাবাকে বলে, ‘এতো প্যারা দিও নাতে’। কিন্তু প্যারা শব্দের অর্থ তো আসলে অন্য কিছু বুঝায়। সন্তানের মুখে এই শব্দ শুনে বাবা-মা হতভম্ব। এছাড়াও ‘মাল’ শব্দটি এক সময় ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন শব্দটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় বহু অর্থ দাঁড়ায়। আসলে কোনটা যে সঠিক তা বুঝা মুশকিল। এছাড়াও ফেসবুকীয় অভিধান থেকে বাংলায় তোমরা থেকে ‘তোম্রা’, ‘জোস’, ‘ব্যাপক’, ‘চরম’, ‘অস্থির’, ‘বিনুদুন’, ‘কুল’, ‘অসাম’, ‘ক্যারে’, ‘লুল’সহ এ ধরণের আরো বহু শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এমনকি এই শব্দগুলো পরীক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার খাতায়ও লিখছে। পরীক্ষার্থীদের কি দোষ। তারা যা শুনছে তাই তো তারা শিখবে ও লিখবে।
বাংলা ভাষার শব্দ বিশ্বের অন্যান্য ভাষার চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষায় অর্থ প্রকাশ করতে একটি শব্দের একাধিক সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। আবার বাংলা সকল ধ্বনি প্রকাশ করতে সক্ষম বর্ণমালা রয়েছে। যা পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় নেই। তারপরও এমন কিছু শব্দ বিকৃতভাবে ব্যবহার করায় বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে যার অর্থ বাংলা অভিধানে নেই। অনেকে শব্দের প্রকৃত উচ্চারণ ত্যাগ করে বিকৃত উচ্চারণ করাকেই আনন্দদায়ক মনে করে। ভার্চুয়াল জগতে বাংলা ‘ছ’ বর্ণমালা হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন, বলছে শব্দকে ‘বলসে’, খাচ্ছে শব্দ ‘খাইতাসে’ আসছে শব্দ ‘আইতাসে’ যাচ্ছে শব্দ ‘যাইতাসে’ তে পরিণত হচ্ছে। আরেকটি মজার বিষয় বাংলা শব্দের সাথে একই অর্থবোধক ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে- যেমন, ‘ফলফ্রুট, ভাইব্রাদার’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা শব্দের ব্যবহার দেখে মনে হয় বাংলা ভাষা ও শব্দ যেন অনেকটা প্রতিবন্ধী অবস্থায় পড়ে আছে। যেমন ‘আজিব, ফালতু, বেল নাই, টাইম নাই, গুণলাম না, অফ যা’ শব্দগুলোর ব্যবহার তাই প্রকাশ করে।
এক সময় হয়তোবা বাংলা একাডেমি শব্দগুলো অভিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হবে। অনেকে হয়তো এর ভিন্ন মত পোষণ করে বলতে পারেন, শব্দ যেমনই হোক না কেন, বুঝতে পারলেই তো হলো। কিন্তু সবাই মিলে যখন একসাথে বৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করে তখন তা সত্যিই উদ্বেগজনক। আর সেটিই হচ্ছে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। বাংলা ভাষা বিকৃতির বল্গাহীন দৌঁড় চলতে থাকলে প্রমিত বাংলা ভাষা এক সময় আন্দামানে নির্বাসনে যাবে। বাংলা শব্দের সাথে ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ লক্ষণীয়। কথা বলার সময় অর্ধেক বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে পারাকে অনেকে স্মার্টনেস ভেবে থাকে। অনেকে আবার এর পোশাকি নাম দিয়েছে ‘বাংলিশ’। বিদেশী ভাষা জানা অপমানের কিছু নয়; বরং একাধিক ভাষা জানা থাকাটা ভালো তবে বাংলার সাথে অন্য ভাষা মিশ্রণ দূষণীয় এবং বাংলা ভাষার প্রতি অপমান।
বাংলা ভাষার এমন বিকৃত রূপ সত্যিই অশনি সংকেত। রাষ্ট্রের সুশীল সমাজ ফেব্রুয়ারি এলে এ বিষয়ে সোচ্চার হন। সামাজিক ও রাষ্ট্রিয়ভাবে বাংলা ভাষার বিকৃত চর্চা রোধে একযোগে কাজ করতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে শুধু ফুল দিলে চলবে না বরং ভাষার শুদ্ধ অনুশীলন অত্যন্ত জরুরী। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার সাহিত্যকর্মগুলো জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা অবিকৃত বাংলা জানা থেকে বঞ্চিত থাকবে। ২০২৩ সালের এই ভাষার মাসে বিশুদ্ধ বাংলা প্রতিধ্বনি উচ্চারণই হোক আমাদের অঙ্গীকার।