জেরুসালেমের মন্দিরে যিশুকে নিবেদন পর্বটি প্রথম পালিত হয়, চতুথ শতাব্দীর শেষের দিকে। পর্বটি পালন করা হয় খ্রিস্ট জন্মোৎসবের চল্লিশ দিন পরে। এই পর্বে এই কথা স্মরণ করা হয় যে, মারীয়া ও যোসেফ যিশুর জন্মের চল্লিশ দিন পরে মোশীর বিধান অনুযায়ী জেরুসালেমের মহামন্দিরে গিয়ে তাঁকে তাঁর পরম পিতার চরণে নিবেদন করেছিলেন। প্রাক্তন সন্ধির নিয়ম অনুসারে প্রথম পুত্র-সন্তান মাত্রই ছিল ঈশ্বরের কাছে নিবেদিত মানুষ। তার পিতা-মাতা যাতে সেই সন্তানকে ফেরত পায়, তারজন্যে তার মুক্তিপণ হিসেবে একটি মেষশাবক বা একজোড়া পায়রা দিতে হত, যা প্রথম জাতকের পরিবর্তে বলিদান করা হত। কিন্ত মা মারীয়া যখন সেই ধর্মবিধি পালন করতে এগিয়ে যান, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, যিশু এক নবসন্ধি স্থাপন করতে এসেছেন, তিনি এবার মানবজাতির প্রথম জাতক হয়ে মানবজাতির জন্যে মুক্তিপণ হিসেবে মেষশাবক বা পায়রা নয়, বরং নিজেকে নিবেদন করতে এসেছেন। যিশুর সমস্ত জীবন এক আত্মোৎসর্গ হবে, যা পূর্ণ হবে কালভেরী পর্বতে।

ঐ পর্ব উৎসবকে স্মরণ করে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ রোজ বৃহঃস্পতিবার সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীর ৩০তম প্রতিষ্ঠা দিবস এবং ধর্মপল্লীর পর্ব দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং একই দিনে ৩১০ ছেলে-মেয়েকে হস্তার্পণ সংস্কার প্রদান করা হয়। সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীর প্রত্যেকটি গ্রাম থেকে হস্তার্পণ সংস্কার প্রার্থীগণ দুই দিন যাবৎ ধর্মপল্লীতে অবস্থান করে সকল প্রকার প্রস্তুতিমূলক ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও, পর্বীয় উৎসবের জন্য খ্রিস্টভক্তগণ নয় দিনের নভেনায় অংশগ্রহণ করে নিজেদেরকে আধ্যত্মিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। পর্বের আগের দিন বিকালবেলা হস্তার্পণ প্রার্থীদের জন্য পাপস্বীকার সংস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। পর্বের দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে খ্রিস্টভক্তগণ ধর্মপল্লীতে আসতে থাকেন।

এ মহতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিওসহ ১১ জন পুরোহিত, ৪ জন সিস্টার এবং ৩১০ জন হস্তার্পণ প্রার্থী ও প্রায় ৫০০ খ্রিস্টভক্ত। খ্রিস্টযাগের প্রারম্ভে ফাদার বাড়ির সামনে থেকে সাঁন্তালী কৃষ্টির দাড়াম নৃত্য সহযোগে বিশপ মহোদয় এবং ফাদারগণকে গির্জার প্রবেশদ্বারে বরণ করে নেওয়া হয়। সকাল ৯:৪৫ মিনিটে শুরু হয় পর্বীয় খ্রিস্টযাগ। খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন বিশপ মহোদয় ও তার সহার্পিত খ্রিস্টযাগে ছিলেন ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী, চ্যাঞ্চেলর ফাদার প্রেমু রোজারিও, উন্নয়ন ও প্রশাসক পরিচালক ফাদার উইলিয়াম মূর্মূ, ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার প্রদীপ কস্তা, বিদায় সহকারি পাল-পুরোহিত ফাদার লিটন কস্তা এবং নবাগত সহকারি পাল-পুরোহিত ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন এবং অন্যান্য ধর্মপল্লী ও প্রতিষ্ঠান থেকে আগত ৫ জন পুরোহিত।

খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশপ মহোদয় তার বক্তব্যে বলেন- আমি ছোট বেলায় প্রতিদিন গির্জায় যেতাম ও খ্রিস্টযাগে সেবক হতাম এবং প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় রোজারিমালা প্রার্থনা করতাম। রোজারিমালা প্রার্থনার পরে আমার মা এবং ঠাকুরমা আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, তোমাকে আমরা যিশুর নামে উৎসর্গ করেছি। তাই, তোমাকে ভালমতো প্রার্থনা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে একজন উৎসর্গীকৃত মানুষ হতে হবে। কেননা, তুমি ছোটবেলায় প্রায়ই অসুস্থ্য হতে সেজন্য আমরা তোমাকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করেছি যেন তুমি একজন নিবেদিত মানুষ হতে পার। আমি দুষ্টামি করলে ও প্রার্থনায় অমনোযোগী হলে মা এবং ঠাকুরমা বারে বারে সেই উৎসর্গীকৃত জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। এখানে আমরা বেশ কয়েকজন ফাদার এবং সিস্টারদেরকে দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বাস করি তাদের মা-বাবাও তাদেরকে একইভাবে নিবেদিত জীবনের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে আজকে মণ্ডলির সেবাকাজের জন্য প্রস্তুত করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, তোমাদের মা-বাবাও ঠিক তেমনিভাবে তোমাদেরকে নিবেদিত জীবনের কথা বলবে, উৎসাহিত করবে এবং প্রার্থনা করতে শিখাবে যেন ভবিষ্যতে তোমরাও কয়েকজন ব্রতধারী-ব্রতধারিণী হয়ে মণ্ডলির কাজে সেবাদান করতে পার। এছাড়াও আজকে তোমাদের মধ্য থেকে ৩১০ জন হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত লাভ করবে। অর্থাৎ তোমরা খ্রিস্টের সৈনিক হবে। তবে এ খ্রিস্ট সৈনিক হয়ে তোমরা শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যেন তোমরাও বিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে খ্রিস্টের ন্যায় মুক্তিদায়ী কাজে অংশ নিতে পার।

কারিতাস বাংলাদেশ রাজশাহী অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মি: ডেভিড হেম্ব্রম বলেন, প্রভুর নিবেদন পর্ব উপলক্ষ্যে সকলকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সেই সাথে সকলকে আহ্বান জানাই, যেন আমরাও যিশুখ্রিস্টের ন্যায় নিবেদিত প্রাণ মানুষ হয়ে উঠতে পারি।

সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীর একজন খ্রিস্টভক্ত নিকোলাস মূর্মূ তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আজকে আমরা ধর্মপল্লীর ৩০তম জন্মদিন ও পর্ব উৎসব পালন করছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রভু যিশু খ্রিস্টকে যেমন সাধু যোসেফ ও মা মারীয়া ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করেছিলেন আমরাও আজকে আমাদের সমস্ত হৃদয় মন আত্মাকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করতে চাই; পাশাপাশি, আমরা প্রত্যাশা করি, আমরা পিতা-মাতাগণ যেন আমাদের সন্তানদেরকে প্রভু যিশু খ্রিস্টের মতো ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করতে পারি।

ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার প্রদীপ কস্তা সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, আজকের এই পর্ব দিন উদযাপন করতে যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের সকলকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। এখানে উপস্থিত আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ মহোদয়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই, কেননা, শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাদেরকে ভালবেসে তার এই মূল্যবান সময় উপহার দিয়েছেন। সেইসাথে বিভিন্ন ফাদারগণ ও সিস্টারগণ যারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উপস্থিত হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন তাদেরকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। সর্বোপরি আমাদের ধর্মপল্লীর পালকীয় পরিষদের সকল সদস্য-সদস্যাদেরকে ও সকল খ্রিস্টভক্তদেরকে তাদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সেই সাথে প্রভুর নিবেদন পর্বে সকলকে আহ্বান জানাই, যেন আমরা আমাদের কৃতজ্ঞতার ডালি প্রভু যিশুর চরণে নিবেদন করে নিজেরাও হয়ে উঠতে পারি মণ্ডলির কাজে নিবেদিত মানুষ।

খ্রিস্টযাগের পর খ্রিস্টভক্তদের পক্ষ থেকে সাঁন্তালী কৃষ্টি দান-সামাঙ প্রদান করা হয় বিশপ মহোদয়কে।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার 

Please follow and like us: