গত ১০ ফেব্রুয়ারি, লুর্দের রাণী মারীয়া’র তীর্থ ও বনপাড়া ধর্মপল্লীর পর্ব উদযাপন করা হয়। তীর্থের ও পর্বদিনের খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তাঁর সহাপির্ত খ্রিস্টযাগে ছিলেন ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার দিলীপ এস.কস্তা, সহকারি পাল-পুরোহিত ফাদার পিউস নিকু গমেজ, সেন্ট যোসেফ স্কুল ও কলেজের প্রিন্সিপাল শংকর ডমিনিক গমেজ, রেডিও জ্যোতি রাজশাহী’র পরিচালক ফাদার সুনীল দানিয়েল রোজারিও, খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রের রাজশাহী’র পরিচালক ফাদার বাবলু কোড়াইয়াসহ আরো ৬ জন ফাদার, ১৫ জন সিস্টার ও প্রায় ২০০০ মত খ্রিস্টভক্ত পর্বীয় খ্রিস্টযাগে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও অনেক খ্রিস্টভক্ত তাদের মানত পূর্ণ হওয়ায় মায়ের প্রতি তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার উদ্দেশ্যেও খ্রিস্টযাগে যোগদান করতে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তীর্থের প্রস্তুতিস্বরূপ চলে নয় দিনের নভেনা। বিভিন্ন ফাদারগণ, মা মারীয়ার বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে খ্রিস্টযাগের উপদেশ দেন ও নভেনা পরিচালনা করেন। নভেনার খ্রিস্টযাগে শত শত খ্রিস্টভক্তগণ যোগদান করেছেন বলে জানিয়েছেন নভেনায় অংশগ্রহণকারি খ্রিস্টভক্তগণ।
খ্রিস্টযাগের শুরুতেই বিগত বছরের সকল দয়াদানের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পর্বকর্তা ও মিসার উদ্দেশ্য দাতাদের নাম ঘোষণা করা হয়। অত:পর পর্বীয় মহা খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও।
বিশপ মহোদয় পর্বীয় ও তীর্থ উৎসবের খ্রিস্টযাগের উপদেশে বলেন – লূর্দের রাণী মারীয়া বনপাড়া’র আজকের এই তীর্থ উৎসবে এসে সত্যিই আমার খুব ভাল লাগছে। আর ভাল লাগছে এই কারণেই যে, আমাদের স্বর্গীয় মায়ের কাছে প্রার্থনা করার জন্যেই আমরা এই তীর্থ উৎসবে সমবেত হয়েছি। আজকে যখন আমি গির্জা চত্ত¡রে প্রবেশ করি; তখন একজন মহিলার সাথে একটু হচ্ছিল এই নিয়ে যে, বিশপ, এই লূর্দে রাণী মা মারীয়া’ই আমাকে এখানে নিয়ে আসল। আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছিল। ভেবেছিলাম আর বোধ হয় বাঁচব না কিন্তু লূর্দের রাণী মা মারীয়ার কাছে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে প্রার্থনা করে বলেছিলাম, মা, তুমিই পারবে আমাকে পারবে সুস্থ্য করতে। সত্যিইতো, যিশুর মা মারীয়াই আমাদেরকে সর্বদা তার পুত্রের কাছ থেকে আশীষ চেয়ে নিয়ে সুস্থ্যতা দান করেন। তাই, লূর্দের রাণী মারীয়া রোগীদের সুস্থ্যতা দানকারী মারীয়া।
তিনি মঙ্গলসমাচারের আলোকে আরো বলেন- মা মারীয়া হলেন যিশুর মা। কিন্তু যিশু নিজেই আমাদেরকে তার মা মারীয়াকে উপহার দিয়েছেন। যখন কালভেরী পর্বতে ক্রুশের উপরে থেকে মা মারীয়াকে দেখিয়ে শিষ্য যোহনকে বললেন, ‘ঐ দেখ তোমার মা।’ তাই, আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে এটা বিশ্বাস করি যে, ঈশ্বরের সাথে তিনি আছেন এবং সেখান থেকেই তিনি আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনগুলো দেখেন। আমরা যদি সত্যিই সত্যি বিশ্বাস করি এবং প্রার্থনা করি তার উপর আস্থা রাখি তিনি আমাদের প্রার্থনা ঈশ্বরকে জানান এবং ঈশ্বর আমাদেরকে সেই অনুগ্রহ কৃপা দান করেন। আজকের মঙ্গলসমাচারে আমরা শুনেছি, বিয়ে বাড়িতে যখন দ্রাক্ষারস শেষ হয়ে গেছে। মারীয়া তখন যিশুকে অনুরোধ করেছেন কিছু করার জন্য যেন তাদের সমস্যার সমাদান করা হয়। যদিও যিশু উত্তরে বলেছিলেন, আমার এখনও সময় হয় নি। তারপরও তিনি মা মারীয়ার কথা ফেলেননি। কারণ মা মারীয়ার এমন বিশ্বাস ছিল যে, মা মারীয়া যা চেয়েছিল তা তিনি করেছেন। এটা হল একটি বড় প্রমাণ যে মা মারীয়া নিজে এই কাজ করতে পারতেন না কিন্তু তার অগাধ বিশ্বাস ছিল যে, তার পুত্র যিশু সেই কাজ করতে সক্ষম। কেননা, তিনি ঈশ্বর পুত্র। আর একজন মা হিসেবে পুত্রের প্রতি তার সেই বিশ্বাস প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে গোটা মানবজাতিকে আহ্বান করেন যেন, আমরা তার পুত্রের প্রতি বিশ্বাস রাখি কেননা, তিনি আমাদের জীবনদাতা, মুক্তিদাতা এবং তিনি আমাদের পথ, সত্য ও জীবন।
লূর্দের রাণী মা মারীয়া’র পর্ব ও তীর্থ উৎসব উপলক্ষ্যে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফাদার সুনীল দানিয়েল রোজারিও বলেন- আসুন আমরা সবাই মিলে লূর্দের রাণী মা মারীয়ার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে সকল প্রকার অসুস্থ্যতা থেকে সুস্থ্যতা দান করেন, বিশ্বের যে সমস্ত দেশে অশান্তি বিরাজ করছে সেখানে যেন শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, সর্বোপরি লূর্দের রাণী মা মারীয়া যেন আমাদেরকে সর্বদা তার আশির্বাদ দানে ঘিরে রাখেন। সবার প্রতি রইল তীর্থের প্রার্থনাপূর্ণ শুভেচ্ছা।
বনপাড়া গ্রামের ক্লেমেন্ট কস্তা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন- আজ আমরা আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করতে যাচ্ছি লূর্দের রাণী মারীয়া বনপাড়া ধর্মপল্লীর পর্ব ও তীর্থ উৎসব। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির জন্যে দীর্ঘ নয়দিন ব্যাপী নভেনা প্রার্থনা করেছি। গতকাল ছিল আমাদের নভেনার শেষ দিন। আজকের এই তীর্থ মহোৎসবে আমরা মা মারীয়ার কাছে কাইমনোবাক্যে প্রার্থনা করব যেন মা মারীয়ার আমাদের সর্বপ্রকার আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আজকের এই তীর্থ উৎসবে যারা যোগ দিচ্ছেন তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমরা এই উৎসবকে যেন আরো সুন্দর করতে পারি তার জন্য সকলের সহযোগীতা কামনা করি।
পাল-পুরোহিত দিলীপ এস.কস্তা খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণকারী সকল ফাদার, সিস্টার ও খ্রিস্টভক্তদেরকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন– সবাইকে পর্বীয় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আজকের দিনে এই তীর্থ উৎসব পালন হচ্ছে সত্যিই এটা খুব আনন্দের। এই তীর্থ উৎসবকে ঘিরে অনেক মানুষ এখানে আসেন। তবে স্থানীয় মানুষরা সবসময়ই আসেন প্রার্থনা করতে। এই তীর্থ উৎসবকে ঘিরে গোটা সপ্তাহে অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে এবং আজকে গির্জাঘর কানায় কানায় ভরে গেছে। এ দেখে আমার অনুভ‚তি হলো এই যে, শুধু তীর্থের সময় কেন সপ্তাহের প্রতি রবিবারে আমরা কি একই ভাবে গির্জাঘর পূর্ণ করতে পারি না? তিনি আরো বলেন, আজকে মঙ্গল সমাচারে আশ্চর্যকাজের কথা বলা হয়েছে। আমরাও আশ্চর্য কাজ করতে পারি সেটা হলো সহভাগিতার আশ্চর্য কাজ, দানের আশ্চর্য কাজ অর্থাৎ উদারভাবে দান করে। মারীয়াকে যিশু বলেছেন, দ্রাক্ষারস ফুরিয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই আপনাদের সাহায্য সহযোগীতার মধ্যদিয়ে এই পর্বীয় তীর্থ উৎসব উদযাপন করা হয়। অনেক মানুষ এখানে সমবেত হয় যেমন আজও আমরা প্রায় ২০০০ এর মতো মানুষ এই পর্বীয় তীর্থ উৎসবে সমবেত হয়েছি। সুতরাং এটি হলো আমাদের সহভাগিতার একটি পদ্ধতি অর্থাৎ সহভাগিতার আশ্চর্যকাজে অংশগ্রহণ করা। আজকের এই পর্ব উৎসবকে সুন্দর ও সার্থকভাবে উদযাপন করার জন্য ধর্মপল্লীর বিভিন্ন দল বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগীতা করেছেন তাদের সকলকেই আমার পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। লূর্দের রাণী মারীয়া আমাদের সকলকে আশির্বাদ করুন এই শুভ কামনা করে পর্বীয় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে তার বক্তব্য শেষ করেন।
পবিত্র খ্রিস্টযাগের শেষ আশির্বাদের আগে পর্বীয় বিস্কুট আশির্বাদ করেন। অত:পর পর্বীয় মহা খ্রিস্টযাগের বিশেষ আশির্বাদ দান করেন প্রধান পৌরহিত্যকারী পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তারপর সকল ফাদারগণ লূর্দের রাণী মারীয়ার মূর্তির কাছে গিয়ে নীরবে প্রার্থনা করেন। অত:পর খ্রিস্টভক্তগণও মা মারীয়ার চরণে এসে তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং পরে পর্বীয় মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে লূর্দের রাণী মারীয়ার এই তীর্থোৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু কোড়াইয়া