গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ছিল বিশ্ব রেডিও বা বেতার দিবস। এই দিবসে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের আয়োজনে এবং রেডিও জ্যোতির পরিচালনায় উদযাপন করা হয় বিশ্ব রেডিও দিবস। দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “রেডিও এবং শান্তি”। এই মহতি অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশীয় সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের সভাপতি, পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও, এসটিডি, ডিডি, রাজশাহী, শ্রোতা সম্মেলনে বা Meet the Press এর আহ্বায়ক শ্রদ্ধেয় ফাদার সুনীল দানিয়েল রোজারিও, পরিচালক, রেডিও জ্যোতি, রাজশাহী। ধর্মপ্রদেশীয় সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের আহ্বায়ক ফাদার বাবলু কোড়াইয়া, কমিশনের সদস্য ফাদার সাগর কোড়াইয়া, হলিক্রস স্কুল এবং কলেজের অধ্যক্ষ ব্রাদার প্লাসিড রিবেরু এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত সম্মানিত ২৬ জন রেডিও জ্যোতির শ্রোতা বন্ধুগণ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সকলের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেন রেডিও জ্যোতির পরিচালক ফাদার সুনীল দানিয়েল রোজারিও। পরে তিনি শ্রোতা সম্মেলনের লক্ষ ও উদ্দেশ্য কী এবং বিশ্ব বেতার দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১০ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ রেডিও একাডেমির এক অনুরোধে, স্পেন প্রস্তাব করেছিল, যেন ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ড বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে একটি দিনকে ঘোষণা করেন। ইউনেস্কোর কার্যনির্বাহী বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দে “বিশ্ব বেতার দিবস” ঘোষণার জন্য প্রস্তাব করেন। তাই, পরবর্তীতে ইউনেস্কোর সহযোগী দেশগুলোর অনুরোধে জাতিসংঘ ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এক প্রস্তাব গ্রহণ ক’রে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়।

তিনি আরো বলেন, এ বছর বেতার দিবসের মূল বাণী হলো, “বেতার এবং শান্তি।” অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ কখনোও শান্তি স্থাপন করতে পারে না। কিন্তু রেডিও তার সম্প্রচার প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে শান্তির বার্তা বহন করতে পারে। এছাড়া আদিকাল থেকেই দেখা গেছে, যারা আন্তর্জাতিক বেতার প্রতিষ্ঠানের শ্রোতা, দেশের সীমান্ত তাদের জন্য কোনো বেড়াজাল নয়। দেখা সাক্ষাৎ না হলেও তারা পরস্পর বন্ধু। তারা কখনোও তাদের এই বন্ধুত্ব রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে যায় না। রেডিও তাদের মধ্যে একতার, শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেয়। যারা বিশ্ব বেতারের সঙ্গে জড়িত, রেডিওর ভাষায় তাদের বলা হয় ডি-এক্সার। যারা শুধু স্থানীয় বেতারের সঙ্গে তাদেরকে ডিএক্সার বলা হয় না। আজকের এই বিশ্ব বেতার দিবস উপলক্ষে বিশ্বের ডি-এক্সার ও শ্রোতাবন্ধুদের জানাই বিশ্ব বেতার দিবসের শুভেচ্ছা। নিজে বেতার শুনুন এবং অন্যকে শুনতে সাহায্য করুন।

সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের আহ্বায়ক ও খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রের পরিচালক ফাদার বাবলু কোড়াইয়া সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ রাজশাহী ডায়োসিসের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই খ্রিস্টীয় সামাজিক যোগাযোগ কশিনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এটা সম্পূর্ণরূপে একটি অরাজনৈতিক এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ডায়োসিসের প্রধান হলেন বিশপ মহোদয় এবং তাঁর নেতৃত্বেই সামাজিক যোগাযোগের কমিশন তার সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত করে থাকে। অর্থাৎ আমাদেরকে চেইন অফ কমান্ড মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের দর্শন ও স্বপ্ন সম্বন্ধে আলোকপাত করে বলেন যে, আমাদের এই কমিশনের কাজ হচ্ছে খ্রিস্টীয় যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, সর্ব ধর্মীয় মূল্যবোধে প্রচার করা, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা, এবং সেই সাথে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন লেখক ও শিল্পী তৈরী করা। এই লক্ষ্যে গত ২৮ বছর ধরে বরেন্দ্রদূত দ্বিমাসিক মূখপত্র নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে, এবং এরই সঙ্গে গত ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪ বছর ধরে অনলাইন বরেন্দ্রদূত নিউজ পোর্টালে প্রতিদিনকার খবরাখবর নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছে। এর উদেশ্য হলো দেশ-বিদেশে ভাই-বোনদের কাছে এদেশের খবর, বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসবাদির সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। তাছাড়াও ৩ জুন ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অনলাইন রেডিও জ্যোতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা তৈরী করছেন এবং তা নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করছেন। এ সমস্ত প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হলো দেশ-বিদেশে বাঙালি ভাষাভাষি ভাই-বোনদের কাছে এদেশের খবর, বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসবাদির সংবাদ প্রকাশ করা। বিশেষভাবে; অনলাইন রেডিও জ্যোতিতে যে সমস্ত অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করা হয় তা হলো মহিলাদের আসর, যুব তরঙ্গ, শিশুদেরকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান কাকলি, খ্রিস্টীয় ও মানবীয় মূল্যবোধের আলোকে নাটিকা, বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার করা। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেমন. বড়দিন, ইস্টার সানডে, ইদুল ফিতর, ইদুল আযহা’র উপলক্ষ্যে বিশপ মহোদয়ের বাণী সম্বলিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা, গীতবাণী ও গীতিআলেখ্য সম্প্রচার করা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানসমূহ সম্প্রচার করে জনগণকে সচেতন করে তোলা।

সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের সভাপতি পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আজ আমি সত্যিই বুঝতে পারছি যে, রেডিও’র সাথে শ্রোতা বন্ধুদের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। আর সেটা প্রকাশিত হয়েছে আপনাদের আবেগ জড়িত অনুভূতি ব্যক্ত করার মধ্যদিয়ে। আমিও খুব রেডিও শুনতে পছন্দ করতাম। বিভিন্ন কাজের কারণে দিনে রেডিও শুনার সুযোগ না হলেও রাতে ঘুমাতে গিয়ে রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। রেডিও প্রোগ্রামগুলো মূলত আমাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধগুলো প্রচার করে থাকে। রেডিও’কে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয় সেটা কিন্তু যারা টেলিভিশন দেখে তাদের মধ্যে হয় না। সেজন্য আমি মনে করি যে, রেডিও’র মধ্যদিয়ে আমাদের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ, ভ্রাতৃসূলভ এবং শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। রেডিও’র মধ্যদিয়ে আমরা সকলকে আহ্বান জানাতে পারব একটা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার জন্য। আমরা যে ধর্মেরই হই না কেন শান্তি আমাদের সকলেরই কাম্য। আর সেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করাটাই হচ্ছে আমাদের জীবনের একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। আমাদের বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস আবুদাবিতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে তিনি মিশরের আলহাজ্ব মসজিদের ইমাম এবং আবুদাবির গ্রান্ট ইমামের সাথে এবং সেখানকার সুলতানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। সেখানে তাদের সকলের কন্ঠে একটি মাত্র সুরই ধ্বনিত হয়েছে আমরা সকলেই একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট। আমরা সকলেই ভাই-বোন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের বর্তমান পোপ তার একটি সর্বজনীন প্রৈরিতিক পত্র লিখেছেন যার মূলভাব তিনি দিয়েছেন “আমরা সকলেই ভাই-বোন।” এই মনোভাবটা রেডিও আমাদের সৃষ্টি করেছে আর আমরাই তার প্রমাণ।

শ্রোতাবন্ধুদের মধ্যে থেকে মি: টোকেন তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন ঠিক এভাবে, যতদিন রেডিও বেঁচে আছে ততদিন আমরাও বেঁচে থাকব, আমাদের বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। তারই সাথে সহমত প্রকাশ আরো একজন শ্রোতা বলেন, সোনার ভিতরেও ভেজাল আছে কিন্তু রেডিও শ্রোতা প্রেমীদের মধ্যে কোন ভেজাল নেই। তাই, আসুন রেডিও শুনার প্রতি আমরা আগ্রহ বাড়াই এবং সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলি।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু কোড়াইয়া

Please follow and like us: