জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
আমার ধারণা ছিলো ঠাকুরের গীতে পাদুয়ার সাধু আন্তনীর জীবনীকেই তুলে ধরা হয়। তবে আমার জানার ভুল ভেঙ্গেছে অনেক পরে। পাদুয়ার সাধু আন্তনী ও মেষ সাধু আন্তনীর পালাগান একটি অপরটির চেয়ে ভিন্ন। তবে মেষ সাধু আন্তনী নামক কোন সাধু মণ্ডলিতে আছেন কিনা জানা নেই। হতে পারে পাদুয়ার সাধু আন্তনীকে দুটি রূপে প্রকাশ করার জন্য এই প্রচেষ্টা। আবার অন্যদিকে মেষ সাধু আন্তনীর পিতামাতার নাম ও পাদুয়ার সাধু আন্তনীর পিতামাতার নামের পার্থক্য রয়েছে। পাদুয়ার সাধু আন্তনীর পালাগান রচয়িতা হিসেবে তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর চড়াখোলা গ্রামের পিটার ডমিনিক রোজারিও’র (১৮৮০-১৯৬৭) অবদান রয়েছে; যিনি ডেঙ্গু পণ্ডিত নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। আর মেষ সাধু আন্তনীর পালাগানের মৌখিক রূপটিতে চড়াখোলা গ্রামের দলু গমেজের অবদান অনস্বীকার্য। ‘এছাড়াও পণ্ডিত প্রবর দোম আন্তোনিয়ো দা রোজারিও অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই গান রচনা করেন বলে মনে হয়’ (দ্রষ্টব্য- সাধু আন্তনীর পালাগান: ভাওয়াল-খ্রিস্টানদের লোকায়ত সাধনা, প্রদীপ পেরেজ, এস.জে., শতবর্ষের অনুগ্রহ স্মরণিকা, উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসন শতবর্ষ, ২৮ মে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)।’
মেষ সাধু আন্তনীর পালাগানের প্রচারের ক্ষেত্রে কথিত একটি ঘটনার প্রচলন রয়েছে। তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর চড়াখোলা গ্রামের দলু গমেজ বিলের ধারে গরু চড়াতে যেতেন। তিনি প্রায়ই সাধু আন্তনীর একটি ছোট্ট মূর্র্তিকে তার সামনে এসে নাচানাচি করতে দেখতেন। দলু বিরক্ত হয়ে মূর্তিটিকে ডাংটঙ্গি খেলার টঙ্গি বানিয়ে খেলা শুরু করেন। স্বপ্নে সাধু আন্তনী দলু গমেজকে দেখা দিয়ে আঘাত না করার জন্য অনুরোধ জানান এবং প্রতিশ্রুতি দেন যদি আঘাত না করেন তবে তাকে একটি উপহার দিবেন। উপহার হিসেবে স্বপ্নেই মেষ সাধু আন্তনীর পালাগান শেখান। এরপর থেকে দলু গমেজ দল বানিয়ে মেষ সাধু আন্তনীর পালাগান গাইতে থাকেন। দলু গমেজ এক সময় সবার নিকট দলু গায়েন নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন।
সময় ও কালের পরিক্রমায় দলু গমেজের গাওয়া ঠাকুরের গীত অনেকের নিকট হস্তান্তরিত হয়। ভাওয়াল অধ্যুষিত বাঙ্গালী এলাকায় ঠাহুরের গীত বা ঠাকুরের গীত নামেই পরিচিত মেষ সাধু আন্তনীর পালাগান। মানতি বা মানত পূর্ণার্থে বাড়িতে বাড়িতে ঠাকুরের গীত গাওয়ানোর রীতি বেশ পুরাতনই বলা চলে। গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চল থেকে পাবনা ও নাটোর অঞ্চলে খ্রিস্টানগণ অভিবাসিত হওয়ার পাশাপাশি ভাওয়াল কৃষ্টিসংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ঠাকুরের গীতও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে বনপাড়া ধর্মপল্লীর যোসেফ ডেঙ্গু কস্তাকে অত্র এলাকায় ঠাকুরের গীত প্রচলনের অগ্রজ বলা চলে। গায়েন বাড়ির আলেকজাণ্ডার গমেজও ঠাকুরের গীত গাওয়ায় এক সময় বেশ নাম করেছেন।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়া বিশেষভাবে বোর্ণী, বনপাড়া, মথুরাপুর, ভবানীপুর, ফৈলজানা, গোপালপুর ধর্মপল্লীগুলোতে বর্তমানে সুব্রত সিলভেস্টার গমেজই ঠাকুরের গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। গায়েন বাড়ির পূর্বপুরুষ দলু গমেজের স্বপ্নে পাওয়া ঠাকুরের গীত ধরে রাখার কাণ্ডারী হিসেবে সুব্রত সিলভেস্টার গমেজ আজ সবার কাছে সুব্রত গায়েন নামেই অধিক পরিচিত।
যোসেফ ডেঙ্গু কস্তার সুযোগ্যশিষ্য বনপাড়া গ্রামের ‘সুব্রত গমেজ গায়েনবাড়ির জন কস্তা ও ডরথি রোজারিওর সন্তান। তিনি প্রথমে তাঁর ওস্তাদ যোসেফ ডেঙ্গু কস্তার গানের দলে খোলবাদক হিসেবে যোগ দেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুব্রত গমেজ গায়েন হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। সবাই তাঁর নম্র ও ভদ্র কথাবার্তা এবং ব্যবহারের তারিফ করেন। আমি যত জন গায়েন দেখেছি, তাঁদের মধ্যে সুব্রত গমেজ বয়সে সবার চেয়ে ছোট। তাঁর গায়কীতে যেমন অনায়াস সিদ্ধি আছে, তেমনি আছে আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি।’ (দ্রষ্টব্য- সাধু আন্তনির পালাগান: ভাওয়াল-খ্রিস্টানদের লোকায়ত সাধনা, প্রদীপ পেরেজ,এস.জে., শতবর্ষের অনুগ্রহ স্মরণিকা, উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিবাসন শতবর্ষ, ২৮ মে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)।’
সুব্রত সিলভেস্টার গমেজ ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বনপাড়া ধর্মপল্লীর গায়েন বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অভিবাসনের পথ ধরে গায়েন বাড়ির বংশধরগণ তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর চড়াখোলা গ্রাম থেকে বনপাড়াতে এসে বসতি গড়েন। সুব্রত গমেজ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরের খ্রিস্টিনা হাসি পিউরীফিকেশনকে বিয়ে করেন। সুব্রত গায়েন বর্তমানে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। সুব্রত গমেজ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না জানলেও ঠাকুরের গীত সমন্ধে তাঁর রয়েছে অগাধ জ্ঞান ও ভক্তি। অবলীলায় ঠাকুরের গীতের বারো পালি গান গেয়ে যেতে পারেন। প্রথম দিকে যোসেফ ডেঙ্গু গায়েনের দোহারী হিসেবে গান গাইতেন। পাশাপাশি খোল ও হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন প্রায় ৩৫ বছর। সুব্রত গায়েন জানান, ইতিমধ্যে প্রায় আশিজন যোসেফ ডেঙ্গু গায়েনের সাথে ঠাকুরের গীত গেয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে যোসেফ ডেঙ্গু গায়েন সুব্রত গমেজকে ঠাকুরের গীত গাওয়ার দায়িত্ব হস্তান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রথমদিকে তিনি এই গুরুদায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। অনেকেই সুব্রত গমেজকে ঠাকুরের গীত গাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে উৎসাহ দেন। এছাড়াও স্বপ্নে কেউ একজন দায়িত্ব নিতে বলেন জানান সুব্রত গমেজ। পরে গ্রামের অনেকের সাথে আলাপ আলোচনা করে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরপর শুরু হয় সুব্রত গমেজের অন্যরকম এক আধ্যাত্মিক যাত্রা। দায়িত্ব নেবার পর সুব্রত গমেজ একজন দাঁড়িওয়ালা লোককে স্বপ্নে দেখতেন। যিনি তাঁকে ঠাকুরের গীত গাওয়া শেখাতেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সুব্রত গায়েন প্রথম ঠাকুরের গীত গান। ওস্তাদ যোসেফ ডেঙ্গু গায়েনকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। সেদিন অন্যরকম এক অনুভূতি সুব্রত গায়েন নিজের মধ্যে অনুভব করেন। তিনি ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন। ওস্তাদ যোসেফ ডেঙ্গু ও ঈশ্বরের আশীর্বাদে সফলভাবেই অবশেষে ঠাকুরের গীত সমাপ্ত করেন। এরই মধ্যে কেঁটে যায় একুশ বছর। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে গিয়েছেন; বিশেষভাবে বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, শৈলপুর, কুষ্টিয়া অন্যতম। ৭-১০ অক্টোবর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নবজ্যোতি নিকেতন মঠবাড়ি, গাজীপুরে অনুষ্ঠিতব্য সাধু আন্তনীর পালাগানের জাতীয় উৎসবে ১৮ জন গায়েনের মধ্যে সুব্রত গায়েনই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
ঠাকুরের গীত গাইতে গেলে গানের এত কথা ও লাইন কিভাবে মনে আসে; কৌতুহলবশত সুব্রত গায়েনকে জিজ্ঞাসা করাতে জানালেন, গান গাওয়ার সময় আধ্যাত্মিক একটি অনুভূতি কাজ করে। ঠাকুর সাধু আন্তনী নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করেন। যতদিন পারি গেয়ে যাবো। দায়িত্ব নেবার মতো যোগ্য কাউকে যদি পাই দায়িত্ব হস্তান্তর করবো। ঠাকুরের গীত গেয়ে আমার আয় খুবই সীমিত; তবু ঈশ্বর ও সাধু আন্তনীর ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। ফলে দেখি আমার সত্যিই কোন অভাব-অনটন নেই। দিব্যি সংসার চলে যাচ্ছে। ঠাকুরের গীত থেকে সবচেয়ে প্রিয় একটি লাইন গাইতে বললে সুব্রত গায়েন সুমিষ্ট সুরে গাইতে থাকেন, “সেই ঘরের নিকটে যাইয়া মায় নজর কইরা চায়/দেখিয়া শুয়র, মেরা বলছে হাইরে হায়/পিতায় যে করে কান্দন আছাড় পিছাড় খাইয়া/মা জননী করে কান্দন ভূমিষ্ঠে গড়াইয়া/আহা! প্রভু দীননাথ এই হাল কেন হইলো/মিলিয়া চান্দের বাজার ভাইঙ্গা কেন গেল/ছোট ছোট পাথর মায় ডাইনে বামে থুইয়া/বড় বড় পাথর ভাঙ্গে মায় সিঁড়িতে ঠুলিয়া”।
সুব্রত সিলভেস্টার গমেজ আজ সুব্রত গায়েন নামেই পাবনা ও নাটোরের ভাওয়াল অভিবাসী খ্রিস্টানদের নিকট সমধিক পরিচিত। সুব্রত নামের পরিপূর্ণ অর্থ তিনি প্রতিনিয়ত কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে যাচ্ছেন। ভাওয়ালবাসীর প্রাণের ঐতিহ্য ঠাকুরের গীত রক্ষক হিসেবে সুন্দর একটি ব্রত নিয়েছেন। সে ব্রত শুধু কথায় নয় কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন গত কয়েক দশক ধরে। অর্থের লোভ নয় বরং ঠাকুরের গীতের মাধ্যমে সুমিষ্ঠ কণ্ঠের যাদুতে আসলে যিশু ঠাকুরকেই প্রচার করছেন। উত্তরবঙ্গে ভাওয়ালবাসী খ্রিস্টবিশ্বাসের যাত্রাপথে ঠাকুরের গীত রক্ষক হিসেবে সুব্রত গায়েন শুধুমাত্র একজনই।
ফটো ক্রেডিট
প্রথম ছবি, প্রদীপ পেরেজ, এস.জে. ও দ্বিতীয় ছবি লিঙ্কন উইলিয়াম গমেজ।