ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক।
একুশ ফেব্রুয়ারি, আজ বাংলাদেশের শহীদ দিবস থেকে- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার দাবিতে বাংলাদেশে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের জীবন বৃথা যায়নি। একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্যদিয়ে ভাষা শহীদের আত্মত্যাগ গৌরবান্বিত হলো। তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তোমাদের ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই। অমর হয়ে থাকবে বাংলার আকাশে বাতাসে, মেঠোপথে, আমাদের প্রাণে প্রাণে, গানে গানে, বসন্তের হাওয়ায়। ভারতবর্ষ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিভক্ত হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব ও পশ্চিম অংশ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ছিলো বাংলা। তা সত্বেও পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে- শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। বাংলার আপামর জনগণ রাজপথে নেমে আসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবিতে। মাতৃভাষার দাবিতে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে একুশ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় ছাত্র-জনতা। এতে করে গোটা বাংলা আরো জ্বলে উঠে। অবশেষে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজপথ রাঙিয়ে বাংলা ভাষা তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে।
একুশ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগ নেন, কানাডা বসবাসরত দুইজন বাঙালি- রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস ছালাম। তারা ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে পৃথিবীর ভাষা রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের জন্য আবেদন জানান। তারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের জন্য তারিখ হিসেবে একুশ ফেব্রুয়ারি পত্রে উল্লেখ করেন। কানাডা বসবাসরত রফিকুল ইসলাম, জাতিসংঘের মহাসচিব বরাবর যে পত্রটি পাঠিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ প্রস্তাবটি গ্রহণ ক’রে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি দেশের রাজধানী প্যারিস শহরে অবস্থিত ইউনেসকো সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোর স্থায়ী সদস্য সায়েদ মোয়াজ্জেম আলি এবং তার পূর্বেকার ইউনেস্কো মহাসচিবের উপদেষ্টা তোজাম্মেল টনি হক, পুরো বিষয়টি নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অবশেষে, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে, বাংলাদেশের শহীদ দিবস একুশ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বিশ্বের নানা ভাষাকে রক্ষা ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য ইউনাইটেড নেশানস এডুকেশনাল সায়েন্স এ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন- সংক্ষেপে ইউনেস্কো ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, একুশ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দান করে। পরে ২০০২ খ্রিস্টাবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একুশ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রস্তাব অনুমোদন করে। সেই সঙ্গে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বছর” হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘ তার ঘোষণায় বলে, মাতৃভাষা দিবস হলো একটি বৃহত্তর উদ্যোগ “যা বিশ্বের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তা সংরক্ষণ ও নিরাপদকরণ।” ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত একুশ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল বাণী হলো, “ বহুভাষিক শিক্ষা- শিক্ষা প্রসারে জরুরি।”(multilingual education – a necessity to transform education). এখানে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কারণ মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ কোনো দেশেই তেমনটি নেই।
বিশ্বে এখন কতোগুলো ভাষা জীবিত আছে- তার সঠিক হিসাব নিয়ে মতভেদ থাকলেও, বলা যায় কমপক্ষে এখনো ৭,১০০টি ভাষা জীবিত আছে। যার মধ্যে ৪০ শতাংশ ভাষা দিন দিন বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা মানে প্রায় ২,৮০০শত ভাষা আজ হুমকির মধ্যে রয়েছে। তবে সুখের বিষয় যে, বিশ্বে এখনো যে ২৩টি ভাষায় বিশ্বে অর্ধেকের বেশি মানুষ কথা বলে, তার মধ্যে বাংলা অন্যতম এবং সপ্তম স্থানে রয়েছে। বিশ্বে ২৬৫.২ মিলিয়ন মানুষ এখনো বাংলা ভাষায় কথা বলে। সেই সঙ্গে লেখনী পদ্ধতি এবং নান্দনিক উচ্চারণের জন্য বিশ্বে ফরাসী ভাষার পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলা ভাষা। অমর হোক একুশ। রক্ষিত হোক বিশ্বের মাতৃভাষা।