ভাষান্তর: ফাদার প্যাট্রিক গমেজ
সেক্রেটারি
সিবিসিবি সংলাপ কমিশন, বাংলাদেশ

সারকথাঃ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানগণ করুণা (Karuna) ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার (Agape) দ্বারা মানবতা ও পৃথিবীর ক্ষতসমূহ নিরাময় করে।

প্রিয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বন্ধুগণ,
বৌদ্ধ পূর্ণিমা তথা বৌদ্ধ জন্ম-জয়ন্তী উপলক্ষে ভাটিকানের আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিষয়ক পোপীয় কাউন্সিল আপনাদেরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানায়। বৌদ্ধ জয়ন্তী হল এমনই একটি উৎসবমূখর সময় যখন আপনারা বৌদ্ধদেবের জন্ম, বোধিজ্ঞান ও মৃত্যু উদযাপন করেন। এই উৎসব দুঃখের (duhkha) প্রকৃতি, বিভিন্ন পরিবেশ যার কারণে এই দুঃখ নেমে আসে, কিভাবে এই দুঃখকে অতিক্রম করা যায় এগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধান করার ইচ্ছাকে চলমান রাখতে আপনাদেরকে আরো একটিবার উদ্বুদ্ধ করুক।

দুঃখ-যন্ত্রণা ও বিভিন্ন ক্ষত জীবনের একটি অংশ; আর উৎসব সংক্রান্ত উপলক্ষগুলো নিত্যদিনের কর্মসূচী থেকে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে রাখে, যেন আমরা নবায়িত সূক্ষদৃষ্টি দিয়ে এইগুলোকে বিবেচনা করি। বিশ্বায়নের এই পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান গণসংযোগ আমাদের সচেতন করে দেয় যে, বর্তমানে আমরা যে-সকল সমস্যার সন্মুখীন হই সেগুলো নতুন বা পৃথক কিছু নয়, সেগুলো মানব মনের এক চাপা বেদনা এবং মন্দতার ফল, যা মানব সমাজকে বিপর্যস্ত করে। বিশ্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এমন বিভিন্ন ক্ষত অত্যাধিকঃ দারিদ্র, বৈষম্য, সহিংসতা, দরিদ্রদের প্রতি উদাসীনতা, দাসত্ববন্ধন; এমন ক্ষতগুলো হল উন্নয়নের বিভিন্ন অফলপ্রসূ মডেল যা নাকি মানব ব্যক্তি ও প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে ব্যর্থ, তারই ফলস্বরূপ ঘৃণা, যা ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী দ্বারা বিদগ্ধ এবং সর্বোপরি জীবনের প্রতি হতাশাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী যা বিভিন্ন ধরণের উদ্বেগ ও আসক্তি দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত বাস্তবতাই বেদনাদায়কভাবে আমাদের সবার সহভাগী দুর্বলতাকে উন্মুক্তভাবেই প্রকাশ করে।

আমাদের এই সহভাগী দুর্বলতার উপর আমাদের সূক্ষ সচেতনতা সংহতির নতুন নতুন ছাচ গঠন করার আহ্বান জানায়; যা আমাদের আপন আপন ধর্মীয় ঐতিহ্য দ্বারা গড়া; যার মধ্যে আমরা খুঁজি জীবনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর; “মানুষের অস্তিত্বের অমিমাংসিত ধাঁধাগুলোর উত্তরের জন্য মানুষ তাদের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। যে সমস্যাগুলো মানুষের অন্তরে ভারী হয়ে থাকে তা অতীতকালে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে” ( প্রসঙ্গ: Vatican II, Nostra Aetate no. 01) ।

আমরা একটি মানব পরিবার বলেই, ভাইবোন হিসেবে আমরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত; এই পৃথিবীর পারস্পরিক নির্ভরশীল সহবাসিন্দা। আমরাতো একই নৌকায় পাল তুলে বয়ে চলেছি, যেখানে একজনের সমস্যা হল সকলেরই সমস্যা আরো একটিবার আমরা উপলব্ধি করি যে, কেউই একা রক্ষা পায় না , আমরা কেবলমাত্র একসাথে রক্ষা পেতে পারি (Pope Francis, Fratelli Tutti, 32)। এই কারণেই আমাদের আপন আপন ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোর বিভিন্ন সম্ভাবনা পুনরায় স্মরণ করা উপযুক্ত মনে করি, কেননা এগুলোই দেখিয়ে দিবে বিভিন্ন প্রতিকার যা আমাদের ভয়াবহ ক্ষতগুলোর এবং আমাদের পরিবারগুলোর, জাতিসমূহের ও আমাদের গ্রহের ক্ষতগুলোর নিরাময় এনে দিতে সক্ষম।

সুপ্রিয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বন্ধুগণ, আপনারা নিরাময় প্রদান করেন যখনই আপনারা করুণা (karuna) তথা সকল সত্তার প্রতি সমবেদনাকে মূর্ত করেন, যা বৌদ্ধদেবেরই শিক্ষাপ্রসূত (Nipata Sutta 1.8, Sutta Nipata 2.4); অথবা যখন আপনারা নিঃস্বার্থভাবে কর্ম সম্পাদন করেন, যেমনটি করেছিলেন বেধিসত্যভা, যিনি নির্ভানায় (Nirvana) প্রবেশ-করা পরিহার করেছিলেন এবং সমস্ত মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা উপশম করার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তাদের পূর্ণ মুক্তি বাস্তবায়ন পর্যন্ত তিনি এই পৃথিবীতেই রয়ে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধদেব একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে করুণা (karuna) দ্বারা অবহিত বলে বর্ণনা করেন, যখন “তিনি এমন মন-অন্তর নিয়েই বসবাস করেন যে মনের অনুসঙ্গী হল সহানুভূতি, মায়ামমতা, আবৃত করেন একটি গতিপথ; দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ গতিপথও হতে পারে। এইভাবেই ঊর্ধ্বে, নিম্নে, চতুর্দিকে, সর্বস্থানে সবকিছুর সাথে নিজেই নিজের পরিচয়কে ব্যক্ত করে তিনি বসবাস করেন সকল ব্যক্তি সত্বার এই পৃথিবীকে আচ্ছাদিত করে ; বসবাস করেন তিনি এমনই এক মন ও মানসিকতা নিয়ে যার অনুসঙ্গী হল সহানুভূতি, মায়া মমতা, যা সুপ্রসারিত, শ্রেষ্ঠ, মহত্তর, সীমাহীন, যেখানে নেই কোন শত্রুতা, নেই কোন অশুভ ইচ্ছা” (Abhidamma Pitakaya Vibhanga b)। যারা মমতা-অনুসঙ্গী মন নিয়ে বসবাস করেন তারা বিশ্বব্যাপী সংকটগুলোর জন্য প্রদান করেন একটি প্রতিষেধক যা ইতিমধ্যে উক্ত করা হয়েছে; প্রদান করে বহুবিস্তৃত এবং পরস্পরসংযুক্ত মন্দগুলোর সামনে সাড়া স্বরূপ ব্যাপক মমতা, সহানুভূতি, দয়ামায়া।

একইভাবে, খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্যেও, নিঃস্বার্থ ভালবাসার (Agape) অনুশীলনের চেয়ে ক্ষত নিরাময়ের জন্য অধিকতর ফলপ্রসূ কোন প্রতিকারই নেই; এমন ভালবাসার মহান আদেশই যিশু দিয়ে গেছেন তাঁর অনুসারীদের কাছে। যিশু তাঁর শিষ্যদের দান করেন ঐশপ্রেমের অনুগ্রহ, নিঃস্বার্থ ভালবাসা (Agape) এবং শিক্ষা দিয়ে বলেন একে অন্যকে ভালবাসতে (প্রসঙ্গঃ যোহন ১৫ঃ১৩)। উদাহারণস্বরূপ তিনি দয়ালু সামারীয়ের উপমাটি তুলে ধরেনঃ
একজন সামারীয় যাত্রা করার সময় শত্রু দ্বারা আহত এক ব্যক্তির কাছে আসলে পর তাকে দেখে তার খুব মায়া হয়েছিল; সে তার কাছে গিয়ে তার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল; তেল ও দ্রাক্ষারস ঢেলে দিল; এরপর গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে তাকে একটি সরাইখানায় হাজির করল ও তার সেবাযত্ন করল (লুক ১০:৩৩-৩৪)। এই সামারীয় লোকটিই অভাবী মানুষের প্রতি বাস্তবধর্মী নৈকট্য তথা প্রেমপূর্ণ সেবা তুলে ধরে।

এই প্রসঙ্গে আমি এখন পোপ ফ্রান্সিসের আবেদন উল্লেখ করতে চাই। সেই আবেদন বা আহ্বান হল মায়ামমতার সাথে অপরকে সেবা করা, বাস্তবভাবে ভালবাসা, নিছক ভাবগত নয়; এমন ভালবাসা যা হল “অনুগ্রহ, দয়া বা বদান্যতা, নিজের কাছে আনার একটি বাসনা, এমনই এক ভালবাসা যা তার ভালবাসার মানুষটির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দয়া, প্রেম-ভালবাসা হল, যাকে আমরা ভালবাসি তার সাথে সবকিছুতেই সহভাগিতা করি। ভালবাসা আমাদের অভিন্ন করে তোলে; সমতা সৃষ্টি করে, সকল প্রকার প্রাচীর ভেঙ্গে দেয়, সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় (প্রসঙ্গঃ পোপ ফ্রান্সিসের তপস্যাকালীন বাণী ২০১৪)। অনুরুপভাবে হৃদয় জয় করার উপর বৌদ্ধদেবের গুরুত্ব বিষয়টি বিশেষভাবে মূল্যবান যখন একত্রে ক্ষত-নিরাময়ের প্রচষ্টায় আমরা একসঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হই। “সহানুভূতি, মায়া-মমতা উপর ধ্যানসাধনা বিকশিত কর, কেননা যখন তুমি সহানুভূতি, মায়া-মমতার উপর তোমার ধ্যান-অনুধ্যান গভীর কর, তখনই নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা হবে পরিত্যক্ত” (Maharahulovada Sutta – MN 62)।

আসুন আমরা সবাই অধিকতর ভালবাসা ও সহানুভূতি নিয়ে বসবাস করার কঠোর প্রচেষ্টা চালাই এবং অধিকতর ন্যায্যতাপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য একত্রে কাজ করি। কামনা করি, আপনারা যেন সমগ্র পৃথিবীর উপর অপরিসীম ভালবাসার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দেন, উর্ধ্বে, নিম্নে এবং এপার-ওপার অপ্রতিহত, অশুভ বাসনা বর্জিত, যেখানে নেই কোন শত্রুতা বা ঘৃণা” (Karanya Metta Sutta, Sn. 1.8)।

সুপ্রিয় বৌদ্ধ ভাই ও বোনেরা, এই বৌদ্ধ পূর্ণিমা তথা বৌদ্ধ জয়ন্তী মহোৎসবে আপনারা উপভোগ করুন সুপ্রচুর আশীর্বাদ এবং আরো উপভোগ করুন সমাজ ও আমাদের সবার গৃহ এই পৃথিবীর ক্ষত নিরাময়ের জন্য অবদান রাখার আনন্দ।

মিগুয়েল এঞ্জেল কার্ডিনাল আইউসো গুইস্কট, এমসিসিজে
বিভাগীয় অধ্যক্ষ
মন্সিনিয়র ইন্দুনিল কাদিয়ক্ক জ্ঞানাকারাত্নে কানকালামালাগে
সচিব
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিষয়ক পোপীয় কাউন্সিল, ভাটিকান।

Please follow and like us: