‘অন্তর দিয়ে বলা’
“ভালবাসায় সত্যনিষ্ঠ” (এফেসীয় ৪:১৫)
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, ভালো যোগাযোগের শর্ত হিসেবে, বিগত বছরগুলোতে ‘যাও ও দেখ’ এবং ‘শোন’ ক্রিয়াপদগুলো নিয়ে আলোচনা করে এই ৫৭তম বিশ্ব যোগাযোগ দিবসের বাণীতে ‘অন্তর দিয়ে বলা’ বিষয়টিতে আমি জোর দিতে চাই। এই হৃদয়ই আমাদেরকে কোথাও যেতে, কিছু দেখতে ও শুনতে উৎসাহিত করে এবং এই হৃদয়ই আমাদেরকে যোগাযোগের উন্মুক্ত ও স্বাগতম জানানোর ধারায় চালিত করে। শোনার অভ্যাস অপেক্ষা ও ধৈর্যের মতোই আমাদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করার দাবি করে। একবার শোনার অভ্যাস করে ফেললে আমরা সংলাপের গতিময়তা ও সহভাগিতায় প্রবেশ করতে পারি, যা অবিকল আন্তরিক যোগাযোগের মতোই। বিশুদ্ধ অন্তরে অন্যদের কথা শোনার পরে, আমরাও ভালোবাসায় সত্য অনুসরণ করে কথা বলতে সক্ষম হব (দ্র: এফেসীয় ৪:১৫)। সত্য ঘোষণা করতে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়, যদিও মাঝে মাঝে তা অস্বস্থিকর হয়ে পড়ে যখন তা দয়া ও হৃদয় ছাড়া করা হয়। পোপ ১৬শ বেনেডিক্ট যেমন লিখেছেন, খ্রিস্টানদের প্রোগ্রাম হলো একটি হৃদয় যা দেখে। একটি হৃদয় নিজ স্পন্দনের সাথে আমাদের অস্তিত্বের সত্যতা প্রকাশ করে, তাই অবশ্যই তা শুনতে হবে। শোনার এই অভ্যাস আমাদেরকে হৃদয়ের একই তরঙ্গে একাত্ম হতে অর্থাৎ যারা শোনে তাদেরকে তাদের হৃদয়ের মধ্যে অন্যদের হৃদস্পন্দন শুনতে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত চালিত করে। এভাবে মুখোমুখি সাক্ষাতের অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে, যা আমাদেরকে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাতে সহায়তা করে; গুজব, বিভেদ-বিভাজনের বিচার না করে পারস্পরিক দুর্বলতাগুলোর প্রতি সহনশীল হয়ে পরস্পরকে সম্মান জানাই।
যিশু আমাদের সতর্ক করেন এ বলে, প্রতিটি বৃক্ষের পরিচয় তার ফলেই (দ্র: লুক ৬:৪৪):“ভাল লোক তার অন্তরে সঞ্চিত ভালোর ভান্ডার থেকে যত ভাল কিছুই তো বের করে আনে; তেমনি খারাপ লোক তার খারাপের ভান্ডার থেকে যত খারাপ কিছুই তো বের করে আনে; কেননা মানুষের অন্তর যা দিয়ে ভরা থাকে, মানুষের মুখ তেমন কথা-ই বলে (দ্র: এফেসীয় ৪:৪৫)। এই জন্য দয়ার সাথে সত্যের যোগাযোগ করতে হলে আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা দরকার। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ অন্তরে শুনে ও কথা বলার মাধ্যমে আমরা বাহ্যিকতার উর্ধ্বে দেখতে পারি এবং অস্পষ্ট কোনকিছুকে জয় করতে পারি। এই জটিল বিশ্বে যেখানে আমরা বাস করি অর্থাৎ তথ্য জগতেও এ অস্পষ্টতা রয়েছে; যা আমাদেরকে সাহায্য করে না কোন কিছু নির্ধারণ করতে। আমরা এমন সময়ে বাস করছি যা উদাসীনতা ও ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের প্রতি অনুরক্ত; যা কখনো কখনো মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করে ও নিজের কাজে লাগায়। এমনিতর সময়ে অন্তর দিয়ে কথা বলার আহ্বান আমাদের বর্তমান সময়কে সম্পূর্ণভাবে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে।
আন্তরিকতার সাথে যোগাযোগ
আন্তরিকতার সাথে যোগাযোগ করার অর্থ হলো যে, যারা আমাদের কথা শুনে ও পড়ে তারা আমাদের সময়ের নারী-পুরুষদের আনন্দ, ভয়, আশা এবং দুঃখ-কষ্টে অংশগ্রহণে স্বাগতম জানাতে আমাদেরকে পরিচালিত করে। যারা এইভাবে কথা বলে তারা অন্যকে ভালোবাসে কারণ তারা তাদের স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন না করে যত্ন ও রক্ষা করে। গলগথায় ঘটে যাওয়া ট্রাজেডির পরে আমরা এই স্টাইলটি সেই রহস্যময় যাত্রীর মধ্যে দেখতে পাই যিনি এম্মাউন্সের পথে এগিয়ে চলা শিষ্যদের সাথে কথোপকথন করেন। পুনরুত্থিত যিশু অন্তর দিয়ে এম্মাউন্সের পথের যাত্রীদের সাথে কথা বলেন, যাত্রীদের কষ্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের সঙ্গ দেন, নিজের মতকে চাপিয়ে না দিয়ে বরং তা তাদের কাছে উত্থাপন করেন, কি ঘটেছিল তার গভীর অর্থ বুঝার জন্য ভালোবাসার সাথে তাদের হৃদয় উন্মুক্ত করেন। তাইতো তারা প্রকৃতভাবেই আনন্দ চিৎকারে বলতে পারে যে, তিনি যখন পথে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ও শাস্ত্রের অর্থ অমন বিশদভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তখন আমাদের ভেতরে কি একটা আগুন জ্বলছিল না (দ্র:লুক ২৪:৩২)।
মেরুকরণ ও বৈপরীত্য দ্বারা চিহ্নিত একটি ঐতিহাসিক যুগে (যা থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাণ্ডলিক সম্প্রদায়ও মুক্ত নয়) ‘উন্মুক্ত হৃদয় ও খোলা কলম’ নিয়ে যোগাযোগ করার অঙ্গীকার শুধুমাত্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্যই নয় তা সকলেরই কর্তব্য। আমরা সকলেই সত্য খুঁজতে ও সত্য কথা বলতে এবং দয়ার সাথে সত্যের কাজ করতে আহ্বান পেয়েছি। বিশেষভাবে আমাদের খ্রিস্টানদেরকে বিশেষ অনুরোধ করা হচ্ছে আমাদের জিহ্বাকে মন্দতা থেকে দূরে রাখার জন্য (দ্র: সাম ৩৪:১৩), কারণ পবিত্র শাস্ত্র আমাদের শিক্ষা দেয়, একই জিহ্বা দিয়ে আমরা প্রভুর স্তুতি করি এবং তাঁরই সাদৃশ্যে সৃষ্ট নর-নারীকে অভিশাপ দেই (দ্র: যাকোব ৩:৯)। আমাদের মুখ থেকে খারাপ কথাবার্তা বের হওয়া উচিত না, “বরং মানুষের যা ভালো করতে পারে, প্রয়োজন মতো গঠনমূলক কোন কিছু করতে পারে, তোমরা তেমন কথাই বলো, যাতে, যারা শুনছে, তাদের যেন কিছু উপকার হয় (এফেসীয় ৪:২৯)। কখনও কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন পাষাণ হৃদয়ের কঠিনতা ভেঙ্গে উন্মুক্ত করে দিতে পারে। আমাদের সাহিত্যেও এর প্রমাণ আছে। আমি ইতালিয়ান উপন্যাস বেট্রোথেড (The Betrothed ) এর একাদশ অধ্যায়ের স্মরণীয় পৃষ্ঠাগুলোর কথা মনে করতে পারি যেখানে লুসিয়া নাম না জানা একজনের সাথে অন্তর দিয়ে কথা বলেছে যতক্ষণ না নাম না জানা ব্যক্তিটি নিরস্ত্রী হয়েছে এবং একটি সুস্থ অভ্যন্তরীণ সংকট দ্বারা যন্ত্রণাপ্রাপ্ত হয়েছে, যা ভালবাসায় মৃদু শক্তি দেয়। আমরা সমাজে এটি অভিজ্ঞতা করি যে, দয়া শুধুমাত্র ‘শিষ্টাচার’ এর প্রশ্ন নয় কিন্তু তা নিষ্ঠুরতার একটি প্রকৃত প্রতিষেধক। এই নিষ্ঠুরতা আমাদের অন্তরকে বিষিয়ে আর সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলতে পারে। দয়া মিডিয়ার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন, যাতে করে যোগাযোগ ধারা উত্তেজনা ও ক্রোধ সৃষ্টি না করে এবং সংঘর্ষের দিকে চালিত না করে; বরং মানুষ যে বাস্তবতায় বসবাস করছে তা শান্তিপূর্ণভাবে অনুধাবন এবং সর্বদা শ্রদ্ধাশীল মনোভাব নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখা করতে সহায়তা করে।
হৃদয় থেকে হৃদয়ে যোগাযোগ: ভালো কথা বলার জন্য, ভালো ভালোবাসাই যথেষ্ট
‘অন্তর দিয়ে কথা বলার’ অন্যতম উজ্জ্বল এবং এখনও পর্যন্ত আকর্ষণীয় উদাহরণগুলোর মধ্যে একজন হলেন মণ্ডলির আচার্য সাধু ফ্রান্সিস ৫৭তম বিশ্ব যোগাযোগ দিবস উপলক্ষ্যে পুণ্যপিতা পোপ মহোদয়ের বাণী অন্তর দিয়ে বলা “ভালবাসায় সত্যনিষ্ঠ” (এফেসীয় ৪:১৫) পথচলার ৮৩ বছর : সংখ্যা – ১৭ ২১ – ২৭ মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ – ১৩ জৈষ্ঠ্য, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ৭ দ্য সেলেস, যার মৃত্যুর ৪০০ বছর পর আমি আমার প্রৈরিতিক পত্র ‘Totum Amoris Est,: সবকিছু ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত’ লিখেছি। ৪০০ বছরের গুরুত্বপূর্ণ এই পূর্তি ছাড়াও আমি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি পূর্তির কথা উল্লেখ করতে চাই: তা হলো পোপ ১১শ পিউস কর্তৃক তার সর্বজনীন পত্র (Rerum Omnium Perturbationem) দ্বারা সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলেসকে কাথলিক সাংবাদিকদের প্রতিপালক হিসেবে ঘোষণা দানের শতবর্ষের পূর্তি। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন ক্যালবিনপন্থীদের সাথে তীব্র মতবিরোধ চলছিল তখন এই উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবী, ফলপ্রসূ লেখক ও প্রাজ্ঞ ঐশতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস দ্য সেলেস জেনেভার বিশপ ছিলেন। তাঁর নম্র আচরণ, মানবতাবোধ এবং ধৈর্যসহকারে সকলের সাথে বিশেষ করে যারা তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করে তাদের সাথে সংলাপ করার ইচ্ছা তাঁকে ঈশ্বরের করুণাময় ভালোবাসার অসাধারণ সাক্ষী করে তুলেছিল। তাঁর সম্বন্ধে কেউ বলতে পারে: “মধুর কণ্ঠ বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করে, শালীন কথন শান্তি-কামনা আকর্ষণ করে” (সিরাখ ৬:৫)। সর্বোপরি, তার বিখ্যাত উক্তিগুলোর একটি ‘হৃদয় হৃদয়ের সাথে কথা বলে,’ বিভিন্ন প্রজন্মের বিশ্বাসীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যাদের মধ্যে সাধু হেনরী নিউম্যানও আছেন, যিনি তার মটো/জীবনবাণী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হৃদয় হৃদয়ের সাথে কথা বলে (Cor ad cor loquitur)। তাঁর একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ভালো কথা বলার জন্য, ভালো ভালোবাসাই যথেষ্ট। আজকাল যোগাযোগকে কৃত্রিমতা ও বিপণন কৌশলের একটি মাধ্যম মনে করলেও তিনি যোগাযোগকে কখনই কৃত্রিমতায় বা বিপণন কৌশলে হ্রাস করা উচিত নয় বলে মনে করতেন। বরং যোগাযোগ হলো প্রাণের প্রতিফলন, যা অদৃশ্য ভালোবাসার নিউক্লিয়াসের একটি দৃশ্যমান পৃষ্ঠ। একই মনোভাবে সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলেস বলেছিলেন, “হৃদয়ের মধ্যে এবং হৃদয়ের মাধ্যমে, একটি সুক্ষ্ণ , তীব্র ও একীভূতকরণ প্রক্রিয়া আসে যার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরকে জানতে পারি। ‘ভালোভাবে ভালোবেসে’, সাধু ফ্রান্সিস বধির-মূক মার্টিনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন, যে পরে তার বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাইতো সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলেস যোগাযোগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিপালক হিসেবেও পরিচিত।
‘ভালোবাসার মাপকাঠি’ থেকে উৎসারিত তাঁর লেখা ও জীবন সাক্ষ্যের মাধ্যমে জেনেভার সাধু সুলভ বিশপ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘আমরা যা যোগাযোগ করি আমরা আসলে তা-ই’। কিন্তু বর্তমান সময়ের যোগাযোগের ধারণা অনেকটাই বিপরীতধর্মী – যা আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিজ্ঞতা করি। যা আছি তা নয় কিন্তু যেরূপ হতে চাই জগতকে সেরূপ দেখাতে যোগাযোগের সুযোগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলেস তার লেখা অনেক বই জেনেভার জনগণের কাছে বিতরণ করেছিলেন। ‘সাংবাদিকতা সংক্রান্ত’ অন্তর্দৃষ্টির জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যা দ্রুত তাঁর ধর্মপ্রদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত তা টিকে আছে। পোপ ৬ষ্ঠ পল উল্লেখ করেন, তাঁর লেখনী পাঠের জন্য অত্যন্ত উপভোগ্য, শিক্ষামূলক ও মর্মস্পর্শী। আজ আমরা যদি যোগাযোগের ক্ষেত্রের দিকে তাকাই, তাহলে কি এগুলি ঠিক সেই একই বৈশিষ্ট্যগুলি নয় যা একটি আর্টিকেল, প্রতিবেদন, টেলিভিশন বা রেডিও প্রোগ্রাম অথবা সামাজিক মিডিয়ার পোস্টে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত? যারা যোগাযোগ ক্ষেত্রে কাজ করে তারা যেন এই কোমল-সুবিবেচক সাধু দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় সাহস ও স্বাধীনতার সাথে সত্যের সন্ধান করতে এবং সত্য কথা বলতে। একইসাথে উত্তেজনাপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক অভিব্যক্তি ব্যবহার করার প্রলোভন প্রত্যাখান করতে।
সিনোডাল প্রক্রিয়ায় অন্তর দিয়ে কথা বলা
মণ্ডলীর মধ্যেও শোনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ করে একে অপরের কথা শোনা অতীব দরকার – যার উপর আমি জোর দিয়েছি। ‘শোনা’ অত্যন্ত মূল্যবান ও জীবনদায়ী উপহার যা আমরা পরস্পরকে উপহার দিতে পারি। কোন পক্ষপাত/পূর্বধারণা ছাড়া মনোযোগ সহকারে ও অকপটে শোনা ঈশ্বরের স্টাইল অনুসারে কথা বলার জন্ম দেয় যা ঘনিষ্ঠতা, সমবেদনা ও কোমলতা দ্বারা বেষ্টিত। আমাদের মণ্ডলীতে এমন যোগাযোগ জরুরী আছে যা অন্তরকে প্রজ্জ্বলিত করে, যা ক্ষতের উপর মলম লেপে দেয় এবং যা ভাই-বোনদের চলার পথ আলোকিত করে। আমি এমন এক মাণ্ডলিক যোগাযোগের স্বপ্ন দেখি যা জানে কিভাবে পবিত্র আত্মা দ্বারা পরিচালিত হতে হয় এবং একই সাথে নম্র ও প্রাবক্তিক হতে হয়; যা জানে তৃতীয় সহস্রাব্দে চমৎকারভাবে মঙ্গলবাণী ঘোষণার জন্য কিভাবে নতুন নতুন পথ ও উপায় খুঁজে বের করতে হয়। একটি যোগাযোগ জানে ঈশ্বর ও প্রতিবেশির বিশেষ করে সবচেয়ে অভাবী ব্যক্তির সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্রে রাখতে এবং জানে নিজেকে তুলে ধরার প্রবণতা সংরক্ষণ না করে বিশ্বাসের আলো জ্বালাতে। শ্রবণে নম্রতা এবং বলায় সাহসিকতা – এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগের একটি ধরণ যা দয়া থেকে সত্যকে কখনো আলাদা করে না।
শান্তির বাণী ঘোষণা করে আত্মাকে কলুষ মুক্ত করা
প্রবচনমালা গ্রন্থে লেখা আছে “ কোমল জিহ্বা হাড় ভেঙে ফেলতে পারে” (২৫:১৫)। যেখানে যুদ্ধ আছে সেখানে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য অন্তর দিয়ে কথা বলা আগের চেয়ে এখন আরো বেশি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; পথ উন্মুক্ত করতে হবে যাতে করে ঘৃণা ও শত্রুতার উন্মাদনার পরিবর্তে সংলাপ ও পুনর্মিলন স্থান পেতে পারে। আমরা যে বৈশ্বিক সংঘাতের সম্মুখীন হচ্ছি তার নাটকীয় প্রেক্ষাপটে, বৈরি নয় এমন একটি যোগাযোগ ধারা বজায় রাখা জরুরী। শ্রদ্ধাশীল সংলাপ চালু করার চেয়ে শুরু থেকেই প্রতিপক্ষদের সুনামহানি ও অপমান করার প্রবণতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। আমাদের এমন যোগাযোগকারীদের প্রয়োজন যারা সংলাপে উন্মুক্ত, সার্বিক কলুষমুক্ত রাখতে নিযুক্ত এবং আমাদের হৃদয়ে বাসা বেঁধে থাকা যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেমনটি সাধু ২৩শ যোহন ‘জগতে শান্তি’ (Pacem In Terris) নামক তাঁর সর্বজনীন পত্রে প্রাবক্তিক তাগিদ দিয়েছিলেন এ কথা বলে: “পারস্পরিক আস্থাতেই কেবল সত্যিকারের শান্তি গড়ে ওঠে” (নং-১১৩)। আস্থায় আশ্রিত ও বন্ধ যোগাযোগকারীদের কোন প্রয়োজন নেই কিন্তু সাহসী ও সৃজনশীলদের দরকার যারা মিলনের জন্য সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেতে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত । ষাট বছর আগে যেমন ছিল, এখন এই সময়েও আমরা অন্ধকারে বাস করছি যেখানে মানবতা ক্রমবর্ধমান যুদ্ধকে ভয় করছে; এ যুদ্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ হওয়া উচিত, যোগাযোগের স্তরেও এ যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার। কত সহজেই মানুষ ও এলাকা ধ্বংসের আহ্বান জানানো হয় তা শুনলেই তো ভয় লাগে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের কথাগুলো প্রায়ই জঘন্য সহিংসতার যুদ্ধে পরিণত হয়। এই কারণেই যুদ্ধবাজ বাগ্মীতাসহ নিজ মতাদর্শিক প্রচারের উদ্দেশে যারা সত্যকে বিকৃত করে তাদেরকে প্রত্যাখান করতে হবে। পক্ষান্তরে, যোগাযোগের এই ধারাকে প্রচার করতে হবে যা জনগণের মধ্যকার বিবাদগুলির সমাধান করার উপায় তৈরি করতে সহায়তা করে।
খ্রিস্টান হিসেবে আমরা জানি যে শান্তির ফল নির্ধারিত হয় হৃদয়ের রূপান্তর দ্বারা, তদ্রুপ যুদ্ধের ভাইরাস আসে মানুষের হৃদয় থেকেই। একটি আবদ্ধ ও বিভক্ত বিশ্বের ছায়া দূর করতে হৃদয় থেকেই সঠিক কথা বেরিয়ে আসে এবং হৃদয় থেকে আসা এই সঠিক কথাই পারে আমরা যে সভ্যতা পেয়েছি তাকে আরো উন্নততর করে গড়ে তুলতে। আমাদের প্রত্যেককেই এই প্রচেষ্টায় জড়িত হতে অনুরোধ করা হচ্ছে, তবে এটি এমন একটি বিশেষ আবেদন যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে যারা কাজ করছেন তাদের দায়িত্ববোধে পড়ে, যাতে করে তারা তাদের পেশাকে একটি প্রেরণকর্ম হিসেবে চালিয়ে যেতে পারেন।
প্রভু যিশু, পরম পিতার হৃদয় থেকে উৎসারিত বিশুদ্ধ বাক্য, আমাদের যোগাযোগকে স্পষ্ট, উন্মুক্ত ও হৃদয়গ্রাহী করতে সহায়তা করুন। প্রভু যিশু, যিনি বাক্যে দেহ ধারণ করলেন, তিনি আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে, পরস্পরকে ভাই-বোন হিসেবে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে এবং যা কিছু বিভক্তি আনে সে শত্রুতা দূর করতে সাহায্য করুন। প্রভু যিশু, যিনি সত্য ও ভালোবাসাময় বাণী, আমাদেরকে দয়ার্দ্র অন্তরে সত্য বলতে সহায়তা করুন; যাতে করে আমরা একে অপরের রক্ষাকারী হিসেবে উপলব্ধি করতে পারি।
পোপ ফ্রান্সিস
(রোম, সাধু জন লাতেরান, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩
সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলেসের স্মরণ দিবস)
ভাষান্তর: ফাদার আগস্টিন বুলবুল রিরেরু