ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক

ভূমিকা : ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিলো ঘোষিত মুক্তির পূণ্যবর্ষ। এই বর্ষের সমাপ্তিপর্বে, পোপ ২য় জন পৌলের আহ্বানে গোটা বিশ্ব থেকে তিন লাখ যুবক ভাটিকানে সাধু পিতর গির্জা চত্বরে সমবেত হয়েছিলেন- সেটাই ছিলো প্রথম বিশ্ব যুব জয়ন্তী। পোপ বিশ্ব যুব দিবস প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা দেন ২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে। পরে প্রথম বিশ্ব যুবদিবস পালিত হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে রোম নগরীতে। আর মূল বিষয় ছিলো, “বরং তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রভুর, অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্যে পেতে রাখ শ্রদ্ধার আসন। অন্তরে তোমরা যে আশা লালন করছো, সেই আশার ভিত্তিটা কি, যখন যে কেউ তা জানতে চাক না কেনো, তোমরা তার উত্তর দিতে সর্বদাই প্রস্তুত থেকো। তবে উত্তর দিয়ো সবিনয়ে, সমুচিত সম্মান দেখিয়ে (১ পিতর ৩:১৫)।”

(সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, পোপ ফ্রান্সিস ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের লিসবন বিশ্ব যুব দিবস উপলক্ষে যে বাণী দিয়েছেন তার বাংলা অনুবাদ আপনাদের জন্য তুলে ধরা হলো)

মারীয়া বাড়ি ছেড়ে … তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন (লুক ১:৩৯)

স্নেহের যুব সম্প্রদায়,
গত পানামা বিশ্ব যুব দিবসের (২০১৯) বিষয় ছিলো, মারীয়া তখন বললেন, “আমি প্রভুর দাসী, আপনি যা বলেছেন, আমার তা-ই হোক (লুক ১:৩৮)।” সেই ঘটনার পর, আমরা আর একটি নতুন গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু করেছি- লিসবন ২০২৩, অন্তরে ঈশ্বরের জলন্ত হৃদয় ও অপরিহার্য আহ্বানে ওঠো- বাণী নিয়ে। গত ২০২০ সম্মেলনে আমরা ধ্যান করেছি যিশুর বাক্য, “যুবক, আমি তোমাকে বলছি, ওঠো” নিয়ে (লুক ৭:১৪)। গতবারেও আমরা প্রেরিতদূত পৌলের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি, যখন তাকে পুনরুত্থিত প্রভু বলেছিলেন, “তুমি যা দেখছো তার সাক্ষি হিসেবে আমি তোমাকে মনোনীত করছি” বিষয়টি নিয়ে (প্রেরিত ২৬:১৬)। লিসবন শহরে পৌঁছার পূর্বে চলার পথে আমাদের অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে নাজারেথের সেই কুমারী- যিনি দূত সংবাদের পরে পরেই “ওঠলেন এবং তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন” (লুক ১:৩৯)। এই তিনটি ঘটনার মধ্যে সাধারণ বিষয়টি হলো: “ওঠো”, এই শব্দটি যা আমাদের স্বরণ ক’রে দেয়- বলে দেয়, যেনো সুখনিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে আমাদের পারিপার্শিক জীবনের সঙ্গে জেগে থাকি।

এই সংকটময় সময়ে, যখন মানব পরিবার, ইতিমধ্যেই মহামারির কারণে মানসিক আঘাতে পরীক্ষিত, শোকবহ যুদ্ধের কারণে ধ্বংসের পথে- তখন মারীয়া আমাদের সবাইকে দেখাচ্ছেন, বিশেষভাবে তোমাকে, তাঁর মতো যুবককে, পথের নৈকট্য ও সাক্ষাত লাভ। আমি আশা করি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আগস্ট মাসে লিসবনে তোমাদের অনেকের অভিজ্ঞতা তোমার এবং গোটা মানব সমাজের জন্য নতুন ক’রে শুরুর প্রতিনিধিত্ব করবে।

মারীয়া ওঠলেন : দূতসংবাদের পরে, মারীয় তাঁর জীবনের দিকে এবং তাঁর নিজের দুঃশ্চিন্তা, নিজের নতুন অবস্থা ও ভয়ের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের সমীপে সমর্পণ করলেন। তখন তাঁর চিন্তা প্রসারিত হলো এলিজাবেথের প্রতি। তাই তিনি ওঠলেন এবং বিশ্ব জীবনে গতিময়তা আনতে সম্মুখ পথে অগ্রসর হলেন। যদিও স্বর্গদূতের বিস্ময়কর বার্তা তাঁর পরিকল্পনায় একটি কম্পন তৈরি করেছিলো, তবুও যুবতী মারীয়া অক্ষম ছিলেন না কারণ তাঁর মধ্যে ছিলেন খ্রিস্ট- যিনি ছিলেন পুনরুত্থিত ও নব জীবনের শক্তি। ইতিমধ্যেই মারীয়া তাঁর মধ্যে অবশান্ত যজ্ঞের মেষ ধারণ করেছিলেন কিন্তু তা ছিলো জীবিত। তিনি ওঠলেন এবং বের হলেন কারণ তাঁর মধ্যে দৃঢ়তা ছিলো যে, ঈশ্বরের পরিকল্পনা তাঁর জীবনের জন্য উত্তম। মারীয়া হয়ে উঠলেন ঈশ্বরের মন্দির, তীর্থ মণ্ডলির প্রতিরূপ, একটি সেবার মণ্ডলি, একঠি মণ্ডলি যে সবার জন্য মঙ্গলবার্তা বহন করে নিয়ে যায়।

আমাদের জীবনে অভিজ্ঞতা লাভ করা, যেখানে পুনরুত্থিত খ্রিস্ট উপস্থিত রয়েছেন এবং তাঁকে জীবন্তরূপে অনুধাবন করা হলো সবচেয়ে বড় আধ্যাক্তিক আনন্দ এবং সবাইকে স্পর্শ করা একটা আলোর ঝলক। মারীয়া তীব্র প্রত্যাশী হয়ে তখনই এই বার্তা অন্যের সঙ্গে, আনন্দের সাক্ষ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্যে রওনা হলেন। খ্রিস্টের পুনরুত্থানের পরে প্রথম শিষ্যদের মধ্যে এমনি অনুভূতি তৈরি হয়েছিলো। “তখন (নারীগণ) ভয় মেশানো এক গভীর আনন্দ নিয়ে তাড়াতাড়ি সমাধিস্থান ছেড়ে চলে গেলেন- তাঁরা ছুটে চললেন যিশুর শিষ্যদের কাছে এই সংবাদ জানাতে” (মথি ২৮:৮)।

খ্রিস্টের পুনরুত্থানের এই ঘটনাবলীতে আমরা দু’টি ধ্বনির মুখোমুখি হই “জেগে থাকো” এবং “ওঠো”। এই বাণীর মধ্যদিয়ে প্রভু যিশু আমাদের অনুপ্রাণিত করছেন- আলোর পথে বের হওয়ার জন্য, যেনো তিনি বদ্ধ দ্বারের পথ পেরিয়ে যেতে আমাদের পরিচালিত করেন। “এই ভাবমূর্তি মণ্ডলির জন্য বড় অর্থ বহন করে। আমরাও খ্রিস্টের শিষ্য এবং খ্রিস্টভক্ত হিসেবে আহ্বান করা হচ্ছে যেনো ত্বরিতে ওঠে তাঁর পুনরুত্থানের রহস্যে প্রবেশ করি, যেনো প্রভু স্বেচ্ছায় তার মতো ক’রে আমাদের পরিচালিত করতে পারেন” (সাধু পিতর ও পৌলের পর্ব উপলক্ষে উপদেশ, ২৯ জুন, ২০২২)।

প্রভুর মাতা মারীয়া যুব সমাজের জন্য একটি আদর্শ – যিনি চলার পথে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধ্যানে মগ্ন না হয়ে অথবা জালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চান নি। মারীয়ার সব সময় লক্ষ্য ছিলো বর্হিঃমুখী। তিনি ছিলেন পুনরুত্থানের নারী, অনবরত অগ্রসরমান, নিজের থেকে বৃহত্তরের উদ্দেশ্যে যাত্রা, যিনি হলেন ঈশ্বর এবং অন্যের দিকে যাত্রা, যারা তাঁর ভাই-বোন, বিশেষ করে বৃহৎ প্রয়োজনে এ যাত্রা তাঁর জ্ঞাতি বোন এলিজাবেতের মতো।

এবং তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন : মিলান শহরের সাধু আমব্রোজ, লুক রচিত মঙ্গলসমাচারের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, মারীয়া তাড়াতাড়ি পার্বত্য অঞ্চলের দিকে যাত্রা করলেন, কারণ তিনি তাঁর অঙ্গীকারে আনন্দিত এবং অন্যকে সেবা করার জন্য উচ্ছ্বলিত- যা আনন্দ হয়ে তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছে। তিনি পুরো ভাগে ঈশ্বরের- যতো না উচ্চতার শিখরে। মারীয়ার তাৎক্ষণিক যাত্রা হলো তাঁর সেবার একটা চিহ্ন, তাঁর আনন্দ প্রকাশ এবং সন্দেহাতীতভাবে পবিত্র আত্মার অনুগ্রহের প্রতি প্রত্যুত্তর।

মারীয়া প্রণোদিত হয়েছিলেন তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠা বোনের প্রয়োজনের তাগিদে। তাই তিনি পিছনে ফিরেন নি বা ঔদাসিন্য থাকেন নি। মারীয়া নিজের চেয়ে অন্যের বিষয় বেশি ভাবতেন- যা তাঁর মধ্যে উচ্ছ্বাস তৈরি করতো- অন্যের দিকে নিজেকে পরিচালনা করার জন্যে। “আমি কীভাবে চারিপাশে অন্যের প্রয়োজন দেখে নিজের মধ্যে প্রতিক্রিয়া অনুভব করি? আমি কী তাৎক্ষণিকভাবে সম্পৃক্ত না হওয়ার জন্যে নিজের মধ্যে কোনো কারণ খুঁজে পাই? অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসি?” এটা ঠিক যে, তুমি পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। তবুও তুমি তোমার কাছে-পিছে যে সব সমস্যা রয়েছে, তোমার সমাজে যে সব সমস্যা রয়েছে- শুরু করতে পারো সেগুলো দিয়ে। একজন কোলকাতার সাধ্বী মাদার তেরেজাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি যা করছেন তা মাত্র মহাসাগরে একবিন্দু জলের মতো।” মাদার উত্তর দিয়েছিলেন, “যদি আমি তা না করতাম তাহলে মহাসাগর একবিন্দু জল থেকে বঞ্চিত হতো।”

যখন আমরা সুস্পষ্ট এবং জরুরি প্রয়োজনে মুখোমুখি হই, তখন আমাদের তড়িৎ গতিতে হস্তক্ষেপ করতে হবে। আমাদের এই বিশ্বে কতোজন মানুষ আছে যারা এগিয়ে যায়, যারা মুখোমুখি হয়- সে সব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিকে। কতো বয়স্ক ব্যক্তি, কতো অসুস্থ ব্যক্তি, বাধ্য দেশত্যাগী, কারাগারে বন্দি এবং স্মরণার্থী রয়েছে সে সব ভাই-বোনেরা অবশ্যই আমাদের কাছে সহানুভূতি আশা করে।

স্নেহের যুব সমাজ, তোমাদের কাছে কী ধরনের “তাড়া” রয়েছে? তোমাদের কী তাড়া করে যার ফলে অনুভব করো “ওঠো” এবং “যাও”- বা তুমি শুধুই দাঁড়িয়ে থাকো? অনেকে সমকালীন বাস্তবতা, যেমন; মহামারি, যুদ্ধ, বাধ্য দেশত্যাগী, দারিদ্রতা, সহিংসতা, পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে প্রশ্ন করে- কেনো এসব ঘটছে? কেনো আমার উপর এ সব নেমে আসছে? কেনো? এবং কেনো এখন? কিন্তু এসবের পরিবর্তে আসল প্রশ্ন হলো- কার জন্য আমি বেঁচে আছি?

নাজারেথের এই যুবতীর ত্বরিত হলো সে সব ব্যক্তির মতো- যারা ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ দান পেয়েছে এবং নিজের মধ্যে তাগিদ অনুভব করে, যেনো তাদের এই অনুগ্রহের অভিজ্ঞতা অন্যের মধ্যে সম্পৃক্ত করতে পারে। এই ত্বরিত হলো- প্রয়োজন অনুসারে অন্যের মধ্যে রেখে দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা। মারীয়া হলেন যুব সমাজের জন্য উদাহরণ- যিনি সময়ের অপব্যবহার না ক’রে- আমাদের মতো নিজেদের পছন্দ ও সামাজিক গণমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যের মনোযোগ ও প্রয়োজনের জন্য এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি খোঁজার জন্য যাত্রা শুরু করলেন সবার জন্য, যা অকৃত্রিম “সম্পৃক্ত”- যা আসে অংশগ্রহণ, সহভাগিতা, ভালোবাসা ও সেবার মধ্যদিয়ে।

দূতসংবাদের পরে মারীয়া যখন প্রথম তাঁর বোনকে দেখার জন্য যাত্রা শুরু করলেন- তখন তাঁর যাত্রাপথে অন্য আরোও যার প্রয়োজন ছিলো সেখানে কালক্ষেপণ বা যাত্রা বিরতি করেন নি। আমাদের নিজেদের যাত্রাপথ, যদি ঈশ্বরকর্তৃক মনোনীত হয়, তাহলে অবশ্যই তা আমাদের সরাসরি প্রত্যেক ভাই-বোনদের হৃদয়ের দিকে পরিচালিত করবে। ঈশ্বরের এবং আমাদের মাতা মারীয়া কতো মানুষের জীবন পরিদর্শন করেছেন- সে সবের অনেক সাক্ষ্য আমরা শুনেছি। পৃথিবীর কতো দুর্গম অঞ্চলে মারীয়া যুগে যুগে দর্শন দিয়ে তাঁর জনগণকে অনুগ্রহ দান করেছেন। বাস্তবে পৃথিবীর এমন কোনো ভূ-খন্ড নেই যেখানটা তিনি পরিদর্শনে যান নি। প্রভুর মাতা তাঁর মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও স্নেহপরায়ণ হয়ে তাদের হতাশা ও সমস্যা নিজের ক’রে নিতেন। অন্যদিকে যেখানেই তাঁর নামে স্মৃতিস্তম্ভ, গির্জা উৎস্বর্গকৃত রয়েছে- সেখানে সর্বদাই তাঁর অসংখ্য সন্তান উপস্থিত থাকছেন। এ সব জনপ্রিয়তার বর্হিঃপ্রকাশের বিষয়গুলো ভেবে দেখার বিষয়- তীর্থস্থান, উৎসবাদি, প্রার্থনা, পরিবারের গৃহে নানা প্রকারের প্রতিমূর্তি ছাড়াও নানাভাবে তাঁর প্রতি মানুষের ভক্তি উপযুক্ত প্রমাণ বহন করে যে, মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কতো সুদৃঢ়- যিনি পর্যায়ক্রমে সবাইকে দর্শন দিয়ে থাকেন।

স্বাস্থ্যবান ‘ত্বরা’ আমাদের সর্বদা পরিচালিত করে শিখরে এবং অন্যের দিকে : স্বাস্থ্যবান ত্বরা আমাদের সর্বদা পরিচালিত করে- শিখরে এবং অন্যের দিকে। অন্যদিকে আবার রয়েছে অস্বাস্থ্যকর ত্বরা- যা আমাদের অনর্থক এবং সবকিছু হালকাভাবে গ্রহণ করার দিকে পরিচালিত করে। যার অর্থ হলো- আমরা যা কিছু বিনিয়োগ করি- সেখানে কোনো আবেদন নেই, কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা হতে পারে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। যেমন পরিবারে এবং অন্যের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করি- কিন্তু আমরা অন্যকে শোনার জন্য অপেক্ষা করি না। বন্ধুত্ব্যের বেলায়ও আমরা যখন অপেক্ষায় থাকি তাদের কাছ থেকে আপ্যায়ণ ও আমাদের চাহিদা নিয়ে, কিন্তু যখন দেখি আমাদের বন্ধু সমস্যাগ্রস্থ ও সাহায্যের প্রয়োজন, তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে নিক্ষেপ করি। এমনকী ভালোবাসার যুগলদের মধ্যেও কম সংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা সত্যিকারভাবে একজন অন্যজনকে বুঝে ওঠার সুযোগ গ্রহণ করে। এই মনোভাবের বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আমাদের কর্মক্ষেত্র এবং দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিদ্যমান। শুধু ত্বরিতে কিছু করলে তা ফলদায়ী হয় না। তাতে ঝুঁকি থাকে অনুর্বর ও প্রাণহীনতার। বাইবেলের প্রবচন গ্রন্থে বলা হয়েছে, “পরিশ্রমী মানুষের সুকল্পিত কাজ সমৃদ্ধি আনে, কিন্তু যে তার কাজ করে অতি ব্যস্ততায়, দারিদ্রই হয় তার আমোঘ পরিণাম” (২১:৫)।

মারীয়া যখন জাকারীয়া ও এলিজাবেথের বাড়ি এসে পৌঁছলেন, তখন এক বিস্ময়কর সহবস্থা তৈরি হলো। এলিজাবেথ নিজেও বৃদ্ধা বয়সে ঈশ্বরের বিস্ময়কর অনুগ্রহলাভে সন্তান ধারণ করলেন। এলিজাবেথের অনেক কারণ ছিলো নিজের বিষয়ে কথা বলার জন্য। কিন্তু সে “নিজে পরিপূর্ণ” না থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের যুবতী বোন ও তাঁর গর্ভের সন্তানকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। মারীয়া তাঁকে অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পবিত্র আত্মায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন। যখন আমরা নিজেকে নয় বরং অন্যকে আদর আপ্যায়নের কেন্দ্রে রাখি তখন পবিত্র আত্মা আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে নেমে আসেন। বাইবেলে বর্ণিত জাখেয়’র গল্পে আমরা এমনটা দেখেছি। “যিশু যখন সেখানে এসে পৌঁছলেন, তখন ওপরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, জাখেয় এক্ষুণি নেমে এসো। আমাকে যে আজ তোমার বাড়িতেই থাকতে হবে। জাখেয় তক্ষুণি নেমে এলো এবং যিশুকে গভীর আনন্দের সঙ্গেই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালো” (লুক ১৯:৫-৬)।

আমাদের অনেকেরই যিশুকে আমাদের জীবনে অযাচিতভাবে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা প্রথমে সান্নিধ্যলাভের অভিজ্ঞতা করি, সেখানে থাকে না কোনো অহমবোধ ও অপছন্দ, সেখানে দূর থেকে দেখা যথেষ্ট নয়, বরং তিনি আমাদের কাছে আসতে চান এবং তাঁর জীবন আমাদের সঙ্গে সহভাগিতা করতে চান। অভিজ্ঞতার এই আনন্দ আমাদের ত্বরা করে অভ্যর্থনার জন্য- তাঁকে আমাদের জীবনে প্রয়োজনের জন্য এবং তাঁকে পরিপূর্ণভাবে জানার জন্য। এলিজাবেথ এবং জাকারিয়া তাদের বাড়িতে মারীয়া ও যিশুকে এভাবেই অভ্যর্থনা জানালেন। এসো আমরা এই দু’জন বয়ষ্ক ব্যক্তির কাছ থেকে আপ্যায়ন ও অভ্যর্থনা বিষয়ে শিক্ষালাভ করি। তোমার পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও তোমার সমাজের বয়ষ্ক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করো- ঈশ্বর ও অন্যকে অভ্যর্থনা জানানো তাদের কাছে কী অর্থ বহন করে। যারা তোমার আগে চলে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতার উত্তর শুনে তুমি অবশ্যই উপকৃত হবে।

স্নেহের যুব সমাজ, এখন ত্বরিতে ওঠে অংশগ্রহণ এবং যারা আমাদের থেকে ভিন্ন তাদেরকে সম্মানজনকভাবে গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত সময়। এটাই ছিলো যুবতী মারীয়া এবং বৃদ্ধা এলিজাবেথের মধ্যেকার কাহিনী। এভাবেই আমরা দূরত্ব ঘুচিয়ে বংশ পরম্পরা, সামাজিক বিষয়ে, সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য গোষ্ঠী ও যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারি। যুব সমাজ সব সময় ভেঙ্গে যাওয়া ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানব পরিবারের মধ্যে আশার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এটা মাত্র তখনই সম্ভব যদি তারা তাদের স্মরণ শক্তি রক্ষা করে, যদি তারা প্রবীণদের জীবন নাটক ও স্বপ্নকে শ্রবণ করে। এটা আকস্মিক ঘটনা প্রবাহ নয় যে, ইউরোপে পুনরায় যুদ্ধ ফিরে আসছে- অনেকে ভেবেছিলো যে গত শতাব্দিতে সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের নতুন এবং প্রবীণদের মধ্যে একটা সন্ধি দরকার। আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে যেতে হবে না এবং সেই সঙ্গে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা ও চরমপন্থা পরাভূত করতে হবে।

এফেসীয়দের কাছে সাধু পৌল বলেছেন, “এখন কিন্তু তোমরা যারা এক সময় দূরে ছিলে, খ্রিস্ট-যিশুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তোমরা আমাদের কাছেই এসেছ খ্রিস্টের মৃত্যুবরণেরই ফলে। স্বয়ং খ্রিস্টই তো আমাদের মধ্যে শান্তির বন্ধন, ইহুদি-অনিহুদি এই দুইকে তিনিই তো এক ক’রে তুলেছেন। যে শত্রুতার প্রাচীর তাদের বিচ্ছিন্ন ক’রে রেখেছিলো, তিনি আপন দেহ উৎসর্গ ক’রেই তা ভেঙ্গে দিয়েছেন” (২:১৩-১৪)। মানবতা যে প্রতি মুহুর্তে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়-যিশু-খ্রিস্ট ঈশ্বরের হয়ে সে সবের মোকাবেলা করেন। মারীয়া একইভাবে এলিজাবেথের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নিজের মধ্যে প্রত্যুত্তর বহন ক’রে নিয়ে গিয়েছিলেন। মারীয়া তাঁর জ্ঞাতিবোন এলিজাবেথের কাছে সবচেয়ে বড় যে দান বহন ক’রে নিয়ে গিয়েছিলেন- তা ছিলো যিশু। এটাই ছিলো সবচেয়ে মূল্যবান সহযোগিতা। কুমারী মারীয়া যে তাঁর গর্ভে যিশুকে ধারণ করে জাকারিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন, এটাই ছিলো তাদের জন্য বড় তৃপ্তি ও আনন্দময়- এবং যা ছিলো জীবন্ত ঈশ্বরের সিন্ধুক। পাহাড়ী গ্রামে, যিশু তাঁর শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়ে, কোনো বাক্য ব্যয় না করে প্রথমবারের মতো “পর্বতের উপর উপদেশ” প্রচার করলেন। তিনি নীরবে- যারা দীন-দুঃখী, যার বিনম্র, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তাদের জন্য কল্যাণবাণী ঘোষণা করলেন।

আমার স্নেহের যুব সমাজ, তোমাদের জন্য আমার বাণী হলো- মণ্ডলির উপর অপর্ণকৃত মহান বাণী- এবং যা হলেন খ্রিস্ট- হ্যাঁ, খ্রিস্ট আমাদের সবার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা, তাঁর মুক্তি এবং আমাদের জন্য নতুন জীবন দান। মারীয়া হলেন আমাদের আদর্শ, যিনি আমাদের দেখালেন কীভাবে অমূল্য দানকে আমাদের জীবনে অভ্যর্থনা জানাতে ও তা অন্যের সঙ্গে সহভাগিতা করা যায়, সেই সঙ্গে খ্রিস্টের অকৃত্রিম ভালোবাসা, তাঁর আন্তরিক সেবা এই গভীর ক্ষত-বিক্ষত মানব সমাজে কীভাবে প্রচার করা যায়।

সবাই একসঙ্গে লিসবন যাত্রা : তোমাদের অনেকের মতো মারীয়া ছিলেন যুবতী। তিনি ছিলেন আমাদেরই একজন। দোন তনিমো বেল্লো নামে একজন ইটালিয়ান বিশপ মারীয়াকে সম্বোধন করেছেন “প্রণাম মারীয়া … আমরা ভালো করেই জানি যে, তুমি গভীর সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য পাল তুলেছিলে। যদি আমরা পাড়ে নামতে ভিক্ষা চাই, এর কারণ এই নয় যে, আমরা তোমাকে পিছন দিকে ফিরে যেতে বলছি। কিন্তু কারণ হলো- আমরা দেখি আমাদের জীবনের সাহস-হীনতার পাড়ে তোমার সম্পৃক্ততা, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদেরও আহ্বান করা হয়েছে বাইরে বের হয়ে আসার জন্য- যা তুমি করেছো মহাসমুদ্রে আপন স্বাধীনতায়।”

আমি আমার ত্রৈ-পত্রের বার্তার প্রথমটিতে উল্লেখ করেছিলাম যে, পর্তুগাল থেকে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দিতে অনেক যুবক ও মিশনারি অজানা বিশ্বের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন, অন্য মানুষ ও জাতির কাছে খ্রিস্ট সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করার জন্য। একই ভূমি থেকে বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে, মারীয়া বিশেষ দর্শনদান বেছে নিয়েছিলেন। ফাতিমা থেকে তিনি সব শ্রেণির মানুষের জন্য ঈশ্বরের ভালোবাসার শক্তিশালী ও চমৎকার বাণী দিয়েছেন- যে বাণীর মর্মার্থ ছিলো মন পরিবর্তন ও স্বাধীনতা। আবারোও আমি তোমাদের প্রত্যেককে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি- যুব গোষ্ঠীকে নিয়ে এই আন্তঃমহাদেশীয় তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য- যা আগস্ট মাসে লিসবন শহরে বিশ্ব যুব দিবস হিসেবে পালিত হবে। সেই সঙ্গে আমি তোমাদের স্মরণ ক’রে দিতে চাই যে, আসছে নভেম্বর মাসের ২০ তারিখে বিশ্ব রাজার পর্বদিনে সারা বিশ্বের স্থানীয় মণ্ডলিতে যেনো বিশ্ব যুব দিবস পালিত হয়। এই কারণে, সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত দলিল, খ্রিস্টভক্তদের মিলন (Dicastery) এবং পরিবার ও জীবন- স্থানীয় মণ্ডলিতে বিশ্ব যুব দিবস পালনের উদ্দেশ্যে পালকীয় নির্দেশাবলী- বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়- যারা যুব সমাজকে নিয়ে পালকীয় কাজ পরিচালনা করছেন।

স্নেহের যুব সমাজ, এটা আমার স্বপ্ন যে, এই বিশ্ব যুব দিবসে তোমাদের আনন্দ নবীকরণের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেনো ঈশ্বর ও ভাই-বোনদের মুখোমুখি হতে পারো। দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার পর, লিসবন শহরে আমরা ঈশ্বরের আর্শীবাদে আবার পুনরায় আবিষ্কার করবো- জনগণ ও বংশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের মিলন, পুনর্মিলন ও শান্তির মিলন, নতুন মিশনারিদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের মিলন। পবিত্র আত্মা তোমাদের আলোকিত হওয়ার আশায় হৃদয় জাগ্রত করুক- এবং সব মিথ্যার জায়গাগুলো পিছনে ফেলে, সিনোডাল উল্লাস নিয়ে, একসঙ্গে মিলিত হয়ে যেনো আনন্দে যাত্রা করতে পারো। মারীয়ার মতো এখন “ওঠার” সময়, সুতরাং এসো, “ওঠি এবং ত্বরিতে যাত্রা করি।” এসো আমাদের হৃদয়ে খ্রিস্টকে ধারণ করি এবং যাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত ঘটে তাদের কাছে বহন করে নিয়ে যাই। তোমাদের জীবনের এই সুন্দর মুহুর্তে সামনে চলো- কিন্তু পবিত্র আত্মা তোমার মধ্যে যাকিছু করতে চান- তা অগ্রাহ্য করো না। আন্তরিকভাবে আমি তোমাদের জীবনের প্রতিটি স্বপ্ন এবং প্রতিটি পদক্ষেপকে আর্শীবাদ করছি।

 

Please follow and like us: