ফা. সুনীল ডানিয়েল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক।
(রাজশাহী ডাইয়োসিসের বিশপ জের্ভাস রোজারিও’র পালকীয় পত্রটি বরেন্দ্রদূত পত্রিকার ২৮বর্ষ- ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশপের পালকীয় পত্রটির উপর আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো)।
১. রূপকল্প : গত দিনগুলোতে মণ্ডলির পালকীয় জীবন ঘিরে আলোচিত বিষয় ছিলো- সিনোডাল চার্চ- যেখানে মূখ্য এ্যাজেন্ডা ছিলো; খ্রিস্টভক্তের দায়িত্ব- তথা মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ। বিশপ জের্ভাস রোজারিও তাঁর পালকীয় পত্রে বিষয়গুলোর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে চার্চে বিশপ, যাজক ও ব্রতধারি, খ্রিস্টভক্তের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার ব্যক্ত করেছেন। বিশপ তাঁর পালকীয় পত্রে প্রথমেই নিজের কাঁধে অর্পিত দায়িত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
২. চার্চে “বিশপ ও যাজকদের আসল দায়িত্ব” হলো- খ্রিস্টের বাণী প্রচার এবং সেবাকাজ। ক্যাথলিক চার্চে সেবাকাজের পরিধি অনেকদূর বিস্তৃত। অভিষিক্তগণ এই সেবা কাজটি খ্রিস্টীয় শিক্ষার আলোকে তার বিভিন্ন অঙ্গ-সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করে থাকেন। আর নিজেদের কাজ হলো- বাণী প্রচার- অর্থাৎ বিশপ ও যাজকদের দায়িত্ব হলো- খ্রিস্টভক্তদের আধ্যাত্মিক সেবা যা মূলত: সাক্রামেন্তীয়/খ্রিস্টপ্রসাদীয়। এগুলোই তাদের মূখ্য দেবার বিষয়। “পরমেশ্বরের বাণী প্রচার ফেলে রেখে খাদ্য- পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত থাকা আমাদের কাজ নয়” (প্রেরিত ৬:২)। অর্থাৎ একজন অভিষিক্ত ব্যক্তি হিসেবে এর বাইরে বিশপ বা যাজকগণ অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য নন। যিশু বলেছেন, “তোমরা আমাকে মনোনীত করোনি, আমিই তোমাদের মনোনীত করেছি আর নিযুক্তও করেছি” (যোহন ১৫:১৬)। মণ্ডলিতে যাজকগণ সন্ন্যাসব্রতীদের নিয়ে কাজ করেন। পালকীয় পত্রে সন্ন্যাসব্রতীদের প্রতি বিশেষ বাণী ছিলো, “তারা ব্রতীয় জীবনে এসেছেন নিজেদের ও সমষ্টিগত সুবিধা অর্জনের জন্য নয়- বরং ঈশ্বর ও মণ্ডলির সেবা কাজের জন্য।” সবাই মিলে জনগণকে নিয়ে সেবার কাজ করতে হবে। মণ্ডলিতে সেবা কাজ করতে গিয়ে শ্রবণ করতে হবে সবাইকে, সবাই মিলে। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ”তোমরা হৃদয়ের কান দিয়ে শ্রবণ করো।” এটা হলো চার্চে বিশপ, যাজক ও সন্ন্যাসব্রতীদের উপর ন্যস্ত আধ্যাত্মিক পরিচর্যা। তবে চার্চের অন্যান্য দায়িত্ব যে ফেলে রাখা হয়েছে তা কিন্তু নয়। আমরা যখন চার্চ বা মণ্ডলি বলি, তখন ঘর-বাড়ি নয়, বিষয়-সম্পক্তি নয় কিন্তু সামনে আসে খ্রিস্টভক্তগণ।
৩. চার্চের কতোটুকু জায়গাজুড়ে খ্রিস্টভক্তগণ অবস্থান করছেন? বিশপ তাঁর পালকীয় পত্রে, “খ্রিস্টভক্তগণের দায়িত্ব” প্রসঙ্গটি টেনে সে সবের রসায়ন তুলে ধরেছেন। চার্চে সকলেই সমান অধিকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। পবিত্র আত্মা যাকে যতোটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন- দেবার ক্ষমতা তার মধ্যে ততোটুকু (১ম করি ১২:৫-১১)। আমি যেটুকু পেয়েছি- তা আমার জন্য ষোল আনা। ঈশ্বর প্রত্যেককে “দিয়েছেন”, যেনো “হয়ে ওঠে” তৈরি হোন “দেবার জন্য”। এই দেবার জন্য প্রত্যেককে তার সামর্থ্যের গভীরে প্রবেশ করতে হয়। যিশু পিতরকে বলেছিলেন, “নৌকাটা গভীর জলে নিয়ে যাও আর জাল ফেলো”(লুক ৫:৪)। জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়লো- তখন ভাগীদারেরা সাহায্যে এগিয়ে এলেন। এই জগতে চলার পথে সবাই ভাগীদার ও সহযাত্রী। আমরা প্রত্যেকে পেয়েছি ভাগীদার-সহযাত্রীদের জন্যেও। দেওয়াটা যেনো শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যের খাতিরে না হয়- বরং হয় যেনো আনন্দের। দেবার মধ্যদিয়ে তৃপ্তিবোধ ও আনন্দকে উপভোগ করতে হবে- এই ভেবে যে, ঈশ্বরের নামে সহযাত্রীদের জন্য কিছু করতে পেরেছি। একজন খ্রিস্টভক্ত হিসেবে প্রথম দায়িত্ব হলো তার সহযাত্রীদের প্রতি। “খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ ছিলেন ঐক্যবদ্ধ। তাদের সব কিছুই ছিলো সকলের সম্পত্তি। তারা বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি ক’রে যা পেতেন তা প্রয়োজন অনুসারে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতেন” (শিষ্যচরিত ২:৪৪-৪৫)।
৪. খ্রিস্টভক্তগণ যেমন সহযাত্রীদের জন্য- তেমনি মণ্ডলির জন্য। খ্রিস্টের শিষ্য হওয়া মণ্ডলির প্রতি সব অবদান নয়- এটি হলো ঈশ্বরের দান। এই দানটির জন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়নি। “বিনা মূল্যে যা পেয়েছো, বিনা মূল্যেই তা দিয়ে যাও” (মথি ১০:৮)। আবারোও প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, “পেয়েছি হয়ে ওঠার জন্য যেনো দিতে পারি।” ঈশ্বরের দান আমাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল, সৃজনশীল। মানুষ কতোভাবে সৃষ্টি করে চলেছেন। সৃষ্টি-সভ্যতা কারোও মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়- সবার জন্য। আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছি- প্রতিদানে কী দেবো? ঈশ্বর তো আর কাঙাল নন যে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবেন। আমি যখন ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে মণ্ডলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই- আসলে হাতটি ঈশ্বরের দিকেই বাড়িয়ে দেওয়া হলো। আজকের এই স্থানীয় মণ্ডলি গড়ে ওঠার পিছনে আমার অবদান কতোটুকু? ভাবতে হবে। আমরা যদি ভাবনার গভীরে প্রবেশ করি দেখবো- কতো না পেয়েছি মণ্ডলি থেকে- লেখাপড়া, আশ্রয়, জমি-জমা, অনুদান, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, আইনী সহায়তা ও আরোও কতো কী। জবাবে আমি কতোটুকু করেছি মণ্ডলির জন্যে? ঈশ্বর যেমন বিশ্বকে লালন-পালন করার দায়িত্ব মানুষের হাতে দিয়েছেন তেমনিভাবে মণ্ডলিকে লালন-পালন করার দায়িত্বও তাঁর ভক্তের হাতে ন্যস্ত করেছেন। বিশপ তার পালকীয় পত্রে অনেকটা হতাশার সঙ্গেই বিষয়টি বলার চেষ্টা করেছেন। এই দায়িত্ব পালনে ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্ট-সমাজ বড়ই ব্যর্থ হয়েছেন।
৫. গত ২০১০ খ্রিস্টাব্দের পালকীয় অধিবেশনের বিভিন্ন কর্মশালায় “আমার ধর্মপল্লী আমার দায়িত্ব” নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। অতীতের পালকীয় অধিবেশনগুলোর মধ্যে এটিই ছিলো সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও অংশগ্রহণমূলক পালকীয় অধিবেশন। সেই অধিবেশন থেকে একটা মুভমেন্ট তৈরি হয়েছিলো- আমার ধর্মপল্লী আমার দায়িত্ব। মনে হয়েছিলো- খ্রিস্টভক্তগণ জাগরণে জেগেছে- তারা এগিয়ে আসবেন ধর্মপল্লীর উন্নয়ন ও আর্থিক প্রয়োজনে। কেনো জানি অংকুরেই বিনষ্ট হলো সেই জাগরণ। মনে হয় সুদক্ষ অনুসরণের অভাবে হারিয়ে গেছে সেই আন্দোলন। কিন্তু খ্রিস্টভক্তগণ মনে প্রাণে জানেন যে, মণ্ডলিকে দেখ-ভাল করার দায়িত্ব তাদের। এই বিষয়টি ঘিরে আবারোও আলোচনায় আসতে হবে।
৬. উপসংহার-১ : এই পাঠে পুনরায় বলতে চাই- মণ্ডলিতে বিশপ, যাজক ও ব্রতধারিদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে- মণ্ডলিতে খ্রিস্টভক্তদের- খ্রিস্টভক্তদের প্রতি দায়িত্ব; চার্চ বা মণ্ডলির প্রতি খ্রিস্টভক্তদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে- এগুলো যেনো পালকীয় অধিবেশনের বিভিন্ন কর্মশালায় জোড়ালো ও ফলপ্রসূভাবে আলোচনায় স্থান পায়। কর্মশালার সমাপ্তিপর্বে অধিক সংখ্যায় মিশন-ভিশন গ্রহণ না ক’রে দু’তিনটি গ্রহণ করতে হবে- যাতে করে ভক্তদের স্মরণে থাকে এবং সারা বছর অনুসরণ করতে সহজ হয়।
৭. উপসংহার-২ : পালকীয় অধিবেশনের বিভিন্ন কর্মশালায় যারা অনুধ্যান দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হবেন, তাদের অবশ্যই বিষয় বস্তুর উপর পারদর্শী এবং স্থিতিশীল থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে- অনুধ্যানে অযথা গল্প-কাহিনী, বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে বা মনগড়া কথাবার্তা বলে কাল ক্ষেপন ও মনোযোগ নষ্ট না করা হয়। সবশেষে বলতে চাই, মঞ্চে যারা কর্মশালা পরিচালনা করেন- তাদের অবশ্যই কিছুটা পেশাদারি হতে হবে- যেনো সঞ্চালনা বিরক্তিকর না হয়। পালকীয় পত্রের জন্য বিশপ জের্ভাস রোজারিও’কে ধন্যবাদ। সফল হোক আগামী পালকীয় অধিবেশন। পালকীয় টিম ও অংশগ্রহণকারিদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।