ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক

গত প্রায় দুই বছর ধরে মণ্ডলিতে সিনোডাল চার্চ নিয়ে আলোচনা চলে আসছে। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ৯-১০ অক্টোবর রোম নগরীতে বিশপীয় ধর্মসভার প্রস্তুতি যাত্রা শুরু হয়েছিলো। সেই থেকে শুরু। সিনোডাল চার্চের প্রথম অধিবেশন বসবে আসছে অক্টোবর মাসে এবং দ্বিতীয় অধিবেশন হবে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাথলিক চার্চের শতকোটি মানুষ, খ্রিস্টভক্তের দায়িত্ব- তথা মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সভা সেমিনার করছেন, উদ্যোক্তা ও আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করছেন। সময় নিয়ে চলার কারণে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, চলার পথে আমরা সহযাত্রী- সবাইকে হতে হবে সবার তরে। বিষয়টির প্রেক্ষিতে আজকে দেখতে চাই- ক্যাথলিক চার্চের যে সব অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান রয়েছে সিনোডাল চার্চের যাত্রাপথে সেগুলোর মধ্যে কতটুকু সংস্কার এসেছে- অবদান কোথায় এবং কতটুকু।

সিনোডাল চার্চের কার্যকর দলিলে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর Vatican synodality text calls for structural reforms শিরোনামে বলা হয়েছিলো Church’s global synod on synodality has called for institutional and structural reform of the Church at all levels, অর্থাৎ গোটা বিশ্বব্যাপী চার্চের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন- যেন খ্রিস্টসমাজের জীবনের সঙ্গে সবকিছু একীভূত হতে পারে। কিন্তু কার্যকর দলিলে নির্দিষ্ট কোন অভিমত দেয়নি যে, চার্চের প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোর কোন্ কোন্ জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। দলিলে অভিমত না দেওয়ার পিছনে বড় কারণ ছিল ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা, সংস্কৃতি ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী।

বাংলাদেশে ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম- বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। চার্চের সংস্কারীয় পালকীয় সেবা খ্রিস্টভক্ত পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকলেও উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড মেঠোপথ পযর্ন্ত বিস্তৃত। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যারা সেবা লাভ করছেন তাদের বেশির ভাগ অ-খ্রিস্টান ভাই-বোন। সিনোডাল চার্চের যে মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে- সেই প্রেক্ষিতে আমরা অ-খ্রিস্টান ভাই-বোনদের কতটুকু আমাদের সম্পর্কে বলতে পেরেছি? মণ্ডলির প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে হয়ে উঠতে হবে জনগণের অংশগ্রহণমূলক অবকাঠামো, যাত্রাপথে একটি সমন্বিত আহ্বান। চার্চ সূর্যের আলো নাও হতে পারে কিন্তু একটি মাটির প্রদীপ তো হতে পারে। যিশু বলেছেন, “মানুষের সামনে তোমাদের আলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলুক, যাতে তোমাদের সৎকর্ম দেখে সকলেই তোমাদের স্বর্গনিবাসী পিতার বন্দনায় মূখর হয়ে ওঠে” (মথি ৫:১৬)। আমরা কী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যদিয়ে উজ্জ্বল আলো হয়ে জ্বলে উঠেছি?

মানুষের কাছে এমনিতেই যাওয়া যায়না- যথার্থ কিছু এ্যাজেণ্ডা থাকতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোই চার্চের এ্যাজেণ্ডা। সাহায্য সংস্থার মধ্যে কর্মরত এবং যারা বেনেফিসিয়ারি তাদের সংখ্যা কতো? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই চিত্র। এগুলোর মধ্যদিয়ে ঈশ্বর আমাদের কত বড় সুযোগ করে দিয়েছেন মানুষের সর্বত্র যাবার জন্য। যিশু বলেছেন, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও, বিশ্বসৃষ্টির কাছে ঘোষণা করো মঙ্গলসমাচার” (মার্ক ১৬:১৫)। এছাড়াও গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর দুর্গম এলাকার মানুষের রয়েছে বড় আস্থা। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তারা সেবা পেয়েই সন্তুষ্ট- নাকী আমরা তাদের কাছে আমাদের মূল্যবোধ তুলে ধরতে পেরেছি? আমরা কী শুধু খ্রিস্ট সমাজের জন্য? যিশু শিষ্যদের বলেছেন, “যারা তোমাদের ভালোবাসে শুধু তাদেরই যদি ভালোবাসো, তবে তোমরা কী পুরস্কারই বা আশা করতে পারো?” (মথি ৫:৪৬)। সিনোডাল চার্চের কার্যকর দলিলে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে, The ultimate purpose of the synodal process, “is not to produce documents but to open horizons of hope for the fulfillment of the Church’s mission.” অর্থাৎ সিনোডালের যে মৌলিক উদ্দেশ্য সেটা দলিলপত্র তৈরি বা প্রকাশনা নয় কিন্তু চার্চের মিশন যেন পূর্ণতা পায় তার জন্য আশার নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করা। সিনোডাল চার্চ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় একটা বড় সুযোগ ছিল আশার নতুন দিগন্ত তৈরি করার। কিন্তু বাস্তবে চোখে পড়ার মতো আশার তেমন ফ্রন্টিয়ার খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিনোডাল চার্চের আলোকে ও যাত্রাপথে দিক-নির্দেশনা আরোও সৃজনশীল হওয়া উচিত। চার্চ তার প্রশাসনিক অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত না থেকে আশার নতুন দিগন্ত খোলার আয়োজন করতে পারতো। হতে পারে সংখ্যালঘু হিসেবে একটা ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করছে। কিন্তু ইতিহাস কী বলে? এই বিশাল ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম কতজন এসেছিলেন খ্রিস্টের বাণী প্রচার করার জন্য? ঈশ্বর তাঁর ভক্তগণের আশ্রয় নিশ্চিত করে বলেছেন, “সদাপ্রভু আমার জ্যোতি, আমার পরিত্রাণ- আমি কাকে ভয় করবো? সদাপ্রভু আমার জীবন-দুর্গ- আমি কাকে ভয় করবো” (সাম ২৭:১)।

সিনোডাল চার্চ সামনে রেখে চার্চের হাতে সময় ছিলো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু সংস্কার সাধন করা। হয়ে থাকলেও চোখে পড়ছে না। কার্যকর দলিল এটাকে বলেছে, Reform of all ecclesiastical structures. অন্য কথায় ভক্ত সমাজ যে অবকাঠামোর মধ্যে অবস্থান করছে- সে সব জায়গায় সংস্কার সাধন। দলিল জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে, “All Church institutions, as fully participatory bodies, are called to consider how they might integrate the call to synodality into the ways in which they exercise their functions and their mission, renewing their structures and procedures” ও যার মূল বার্তা হলো, মণ্ডলির প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণমূলক অঙ্গ হিসেবে আহ্বান করা হয়েছে যেন কাজকর্ম, প্রেরণের নিমিত্তে অবকাঠামোর পুর্নবিন্যাস ও পরিচালনায় সমন্বয় সাধন করতে পারে। দলিলে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হলেও এটাই মূখ্য নয়, “there is a need for ongoing formation to support a widespread synodal culture, the need for more specific formation in listening and dialogue” তার মানে বিস্তৃতভাবে সিনোডাল সংস্কৃতিকে সমর্থন দেওয়ার জন্য চলমান গঠনপ্রণালী প্রয়োজন, সেই সঙ্গে প্রয়োজন শ্রবণ এবং সংলাপ, থাকতে হবে সিনোড প্রতিনিধিত্বকারি ও কর্মীদল।

উপসংহারে বলতে চাই- সিনোডাল মণ্ডলির এই যাত্রা শেষ হবার নয়। এই যাত্রা আগামীদিনেও মণ্ডলির পালকীয় জীবনের সর্বস্তরে বিরাজমান থাকবে। তাই আজকের সিনোডাল চার্চের যাত্রায় ভাবতে হবে- আজ না হোক, ভবিষ্যতকাল ধরে চার্চের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটি সমন্বিত সেবার কৃষ্টি যেন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: