আগস্ট ১০-১২, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে ধর্মপ্রদেশীয় যাজকীয় ও ব্রতধারী/ব্রতধারিণীদের জন্য কমিশনের উদ্যোগে ‘ব্রতীয় জীবনে খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব: মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ’ মূলসুরের উপর ভিত্তি করে ধর্মপ্রদেশে সেবারত সিস্টারদের জন্য খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে ৩৩ জন অংশগ্রহণকারী অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানসূচীতে রাখা হয় পবিত্র আরাধনা, উদ্ধোধনী পর্বসহ পরিচিতি পর্ব, শিক্ষণীয় সিনেমা, বাইবেল সহভাগিতা, মূলভাবকে দু’টি অংশে বিভক্ত করে দুইজনের সহভাগিতা, দলীয় আলোচনা, দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন উপস্থাপনা, মূল্যায়ন, ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও সমাপনী খ্রিস্টযাগ যাতে প্রধান পৌরহিত্য করেন ফাদার মার্কুশ মুর্মু। তিনি উপদেশে তুলে ধরেন- যাজকদের ও ধর্মীয় ব্রতী-ব্রতীনিদের অনেক বেশী দায়িত্বশীল, মিলনধর্মী, অংশগ্রহণমূলক ও আদর্শ প্রেরণকর্মী হয়ে উঠতে হয়। যিশুর মণ্ডলির জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে আমাদেরই দায়িত্বশীলতায়।

‘ব্রতীয় জীবনে খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব’ বিষয়ে সহভাগিতা করতে গিয়ে ফাদার কমল কোড়াইয়া তুলে ধরেন ব্রতধারী-ব্রতধারিণীদের খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব হলো- খ্রিস্টবাণী আদর্শপূর্ণভাবে প্রচার করা অর্থাৎ জীবনাদর্শ দিয়ে প্রচার করা। খ্রিস্টবাণী প্রচারের জন্য অধিক জাগতিক জ্ঞানের প্রয়োজন এমনটি ভাবা ঠিক নয় বরং সকল জ্ঞানের উৎস যিশুর উপর বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতার অধিক প্রয়োজন। যিশুর সার্বজনীন ভালবাসার দূত হয়ে সর্বদা সর্বত্র যাওয়া অধিকতর দরকার। নিজেকে নিবেদন করা শুধু দৈহিকভাবে নয় বরং অন্তর-আত্মায়-সামগ্রিকভাবে খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিবেদন করা। ‘আমাদের বিচ্ছিন্ন মনোভাব (মিলিত মনোভাবের অভাব, অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা) আমাদের খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্বকে বাধাপ্রাপ্ত করছে। ত্যাগী মনোভাবের অভাব আমাদের জাগতিকতায় নিম্মজিত করে।

সিস্টার কল্যাণী আগ্রেশ পালমা, এসসি ‘ব্রতীয় জীবনে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ’-এর উপর সহভাগিতায় তুলে ধরেন- মিলন হলো পরস্পরের সাথে একাত্ম বা এক হওয়া। যিশু তাঁর শিষ্যদের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, “আমরা যেমন এক, তারাও যেন এক হয়..”  যোহন ১৭:২১-২৩)। খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের কাছে মিলন হলো- রুটি ভাঙ্গার” সাহস, রুটি ভাঙ্গতে, যিশুকে চিনতে এবং অন্যদের সাথে সহভাগিতা করার সাহস। এম্মাউসের পথে যিশু যাদের সাথে যাত্রা করেন সেই দুই শিষ্য কেবল ‘রুটি ভাঙ্গার’ সময় তাকে চিনতে সক্ষম হন। মিলন হল আমাদের সংকীর্ণতা, কুসংস্কার, একচেটিয়া তা অতিক্রম করার অনুগ্রহ-বিশেষ করে হারিয়ে যাওয়া, ক্ষুদ্রতম ও পিছিয়ে পড়াদের কাছে পৌঁছানো।

আমরা যারা দীক্ষাস্নান লাভ করেছি আমরা হলাম যিশুর শিষ্য। আর তাই যিশু আমাদের কাছে চান আমরা যেন আমাদের ধর্মীয় সংঘের ভগিনী এবং প্রতিবেশী ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে জীবন-যাপন করি।

আমরা যেন মণ্ডলি ও ব্রতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিচক্ষণতার সাথে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করি। ছোট ও বড়, অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ, সুস্থ ও অসুস্থ, প্রতিভা সম্পন্ন ও স্বল্প প্রতিভা সম্পন্ন সকলে যেন নিজস্ব মতামত ব্যক্ততে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ক’রে আমাদের জীবনকে আরো সুন্দর, সমৃদ্ধশালী ও ফলপ্রসূ করে তুলি।

মণ্ডলি সহজাতভাবেই প্রেরণধর্মী। প্রেরণ হলো এগিয়ে যাওয়া এবং পাঠানোও। এটা একটি যাত্রা যা করতে আমরা সবাই আহুত। আমাদের নিজস্ব স্বত্তা থেকে বাহির হওয়ার যাত্রা। প্রাচীর নয় বরং সেতু নির্মাণ, ক্ষত নয় বরং নিরাময়, ঘৃণা নয় বরং ভালোবাসার যাত্রা।

পুণ্যপিতা আহ্বানে যত্নশীল হয়ে প্রেরণকাজে আরো বেশী সচেতন হতে হয়। ‘করার’ চেয়ে ‘হওয়াকে’ বেশী প্রাধান্য দেয়া। সাধু পলের উপদেশ আমাদের প্রতি, “ভ্রাতৃপ্রেম যেন তোমাদের মধ্যে গভীর স্নেহ বন্ধন গড়ে তোলে। তোমরা একে অন্যকে বেশী সম্মানের যোগ্য বলেই মনে কর” (রোমীয় ১২:১০)। “তোমরা পরস্পরের জন্য অপেক্ষা ক’রো” (১ করি ১১:৩৩)। “তোমরা ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরের সেবা কর” (গালাতীয় ৫:১৩)। “তোমরা একে অন্যকে উৎসাহিত কর, একে অন্যকে গড়ে উঠতে সাহায্য কর” (থেসা. ৫:১১)। “গভীর ভালবাসায় পরস্পরের প্রতি ধৈর্যশীল হও তোমরা” (এফে. ৪:২)। “তোমরা একে অন্যের প্রতি সহৃদয় হও, হও কোমলপ্রাণ। পরস্পরকে তোমরা ক্ষমা করে নাও যেমন খ্রিস্টে  তোমাদের আশ্রয় দিয়ে পরমেশ্বরও তোমাদের ক্ষমা করেছেন” (এফে.৪:৩২)

তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে দলীয় আলোচনার পর প্রতিবেদনে যা উঠে আসে, বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের পালকীয় সেবাকাজের সীমাবদ্ধতাগুলো- ফাদার-সিস্টারদের মধ্যে সহভাগিতার-সহযোগিতার অভাব, কনভেন্টে প্রার্থনা-নিয়মের সাথে ধর্মপল্লীর পালকীয় সেবার সময়ের হেরফের হওয়া, পদ্ধতিগত কাঠামোর অভাব, ত্যাগস্বীকারের মনোভাবের অভাব, কর্ম-পরিকল্পনার অভাব, একচেটিয়া মনোভাব, পরিবারে পিতা-মাতাদের সহযোগিতার অভাব, আন্তরিকতার অভাব, গ্রহণীয় মনোভাবের অভাব, মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারের অভাব, সৃজনশীলতার অভাব, উপকরণের অভাব ও বদ্ধ মূল ধারণা পোষণ করা।

এইগুলো উত্তরণের উপায়সমূহ- পায়ের জুতা খুলে মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সেবার জীবনে, সহযোগিতা-সহমর্মিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করা, আন্তরিকতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, সংলাপের মধ্য দিয়ে কাজ করা, একে-অন্যকে সমর্থন করা, পালকীয়কাজে সৃজনশীল হওয়া, ধের্য্যশীল হওয়া, পরষ্পরের কাজে সহযোগিতা-সমর্থন করা, বিচক্ষণ হওয়া পালকীয় কাজে এবং প্রার্থনায় বিশ্বস্থ হওয়া।

ব্রতীয় জীবনে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ-বিষয়ে সহভাগিতা শোনার পর যে বিষয়গুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে- যেখানে সেবারত আছি সেই স্থানকে নিজের বাড়ীর মনে করা, মনোযোগ সহকারে সকলের কথা শোনা ও গুরুত্ব দেয়া, সকলের জীবনে সূর্য হয়ে উঠা অর্থাৎ সকলকে ভালবাসা, সম্পূর্ণ তোমারি হয়ে উঠা ও শোনার মানুষ হতে হবে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সকালে পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে সেমিনারের পরিসমাপ্তি হয়।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার স্বপন পিউরীফিকেশন

Please follow and like us: