ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক
বিশাল ভারতে ২৮টি রাজ্য এবং ৮টি ইউনিয়ন টেরিটরির মধ্যে মণিপুর একটি রাজ্য। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটির উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম এবং পূর্বে মিয়ানমার। বাংলাদেশের সঙ্গেও সীমান্ত রয়েছে। মোট আয়তন ২২,৩২৭ কিলোমিটার, রাজধানী ইম্ফল। বর্তমান বিজেপি সমর্থনপুষ্ট ও সংখ্যাগুরু মৈতৈ সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত মূখ্যমন্ত্রী হলেন বীরেন সিং। মণিপুর রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা ৩৩ লাখ, যার মধ্যে ৪১.৩৯% হিন্দু, ৪১.২৯% খ্রিস্টান এবং ৮.৪% মুসলিম। এই রাজ্যের দু’টি প্রধান সম্প্রদায় হলো মৈতৈ এবং কুকী। মৈতৈরা হিন্দু এবং কুকীরা খ্রিস্টান ধর্মালম্বী। মৈতৈরা রাজ্যে ৫৩% এবং বাকিরা হলো কুকী, নাগা এবং আরো ১৬টি আদিজনগোষ্ঠী। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে হিন্দু ধর্মলম্বীর সংখ্যা ছিলো মোট জনসংখ্যার ৬২% যা ২০১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি গণনায় কমে দাঁড়িয়েছে ৪১ শতাংশে। অন্যদিকে একই সময়ে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ১৯% থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মৈতৈ জনগোষ্ঠী থেকেও অনেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। ভারতের হিন্দুবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য খ্রিস্টান সংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় উদ্বেগের ঘটনা। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম প্যাটিগ্রিউ নামে একজন বৃটিশ মিশনারি ভারতে এসে এই রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তন করেন। তাঁকে মিশনারি কাজের জন্য বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানীত করা হয়েছিলো।
মণিপুর রাজ্যে গোষ্ঠীগত দাঙ্গা বহুদিনের। এখানকার কুকী আদি জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিগ্রহের কারণে আলাদা রাজ্যের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলো। এই দাবির পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। মৈতৈ জনগোষ্ঠী বাস করে ইম্ফল শহরের আশপাশে যেখানে রয়েছে সমতল ভূমি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা। অন্যদিকে কুকী জনগোষ্ঠী বাস করে দুর্গম পাহাড়ী জনপদে। যেখানে নাগরিক সুবিধা নেই, অনুন্নত এলাকা। তাদের একমাত্র ভরসা খ্রিস্টান মিশনারিকর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্য, যেগুলোকে বলা হয় ‘সেভেন সিস্টারস’, এই রাজ্যগুলোর সংখ্যালঘুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও আস্থার পিছনে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান অনস্বীকার্য।
সম্প্রতি সরকার রাজ্যের জন্য কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো সবই সংখ্যাগুরু মৈতৈদের অনুকূলে গেছে। যেমন- মৈতৈরা বন-জঙ্গল-ভূমি অধিক পরিমাণে দখল করতে পারবে। এই বন-জঙ্গল-ভূমি দখল হলো কুকী জনগোষ্ঠীর প্রতি একটা বড় হুমকি। এছাড়া মৈতৈ সম্প্রদায় কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাখাতে অগ্রাধিকার এবং সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা লাভ করতে পারবে। এছাড়া গত মার্চমাসে আদালত সংখ্যাগুরু মৈতৈদের তফসিলভূক্ত ক’রে ঘোষণা দেয়- ফলে স্পষ্টতই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো যে নাগরিক অধিকার প্রশ্নে বৈষম্য তৈরি করছে তা পরিষ্কার। একটা দেশ বা রাজ্যে বিভিন্ন জন সম্প্রদায় থাকতে পারে, কিন্তু সরকারিভাবে বৈষম্য থাকতে পারে না। রাজ্যের সভায় সংখ্যাগুরু মৈতৈদের আসন ৬০, ফলে সব সিদ্ধান্ত তাদের অনুকূলেই যাবে- স্বাভাবিক। রাজ্যসভার এই একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে কুকী ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠে, তবে তাদের প্রতিবাদ ছিলো শান্তিপ্রিয়ভাবে।
গত ৩ জুলাই সম-অধিকার প্রশ্নে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় মৈতৈদের সঙ্গে কুকী ছাত্রদের সংঘর্ষ শুরু হয়। মৈতৈরা সংখ্যাগুরু ও সরকারি মদদপুষ্ট হওয়ায় নির্দ্বিধায় কুকী খ্রিস্টানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়, গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়, লুটপাট করে এবং মহিলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্যাতন করে। মৈতৈ সম্প্রদায় থেকে যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে তাদের জোরপূর্বক হিন্দুধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। অবস্থা এমন হওয়া সত্বেও মূখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ও তার নিরাপত্তা বাহিনী কিছুই করতে পারেননি। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বদেশ মন্ত্রী অমিত শাহ্ মে মাসের শেষের দিকে মণিপুর সফর করলেও তার লাঠিয়াল মেজাজ কিছুই করতে পারেনি। তিনি একটি শান্তি কমিটি গঠন করে দিলেও কোনো লাভ হয়নি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মণিপুর ব্যাপারে মাসখানেক চুপচাপ থাকার পর টনক নড়ে যখন দুইজন কুকী মহিলাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ঘুরাণো হয় এবং হত্যা করা হয়। অবশেষে মোদি বলেন, “what happened to the daughters of Manipur can never be forgiven”. মণিপুর কন্যাদের নিয়ে কী ঘটছে- কিছুতেই ক্ষমা করা হবে না। তিনি এটাও বলেছেন যে, এই ঘটনা দেশের জন্য লজ্জাজনক। কিন্তু বাস্তবে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কীনা তার কোনো প্রমাণ নেই। নারী নিগ্রহের এই ঘটনা গোটা ভারত তথা বিশ্বের কাছে ধর্ম নিরপেক্ষতার বার্তা দেয়নি বরং সম্প্রতি কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, উড়িস্যা, ছত্তিসগড়, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলাগুলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মণিপুর রাজধানী ইম্ফলের ক্যাথলিক আর্চডাইয়োসিসের আর্চবিশপ ডমিনিক লুমন- খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়, কমপক্ষে ২৪৯টি চার্চ, চার্চ সেন্টার ও চার্চের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৪০জন নিহত হয়েছে এবং ৫০ হাজারের অধিক কুকী তথা খ্রিস্টান এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মণিপুর ঘটনায় ভারতের কিছু নারী সংগঠন প্রতিবাদ জানালেও ক্ষমতাসীন বিজেপি সমর্থনপুষ্ট হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো কোনো ভূমিকা নেয়নি। অনেকে মণিপুর সংঘর্ষকে গৃহযুদ্ধের আলামত হিসেবে দেখছেন। এই আলামতগুলো ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে- এমনটি বলতেও বিশ্লেষকগণ দ্বিধা করছেন না।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে খ্রিস্টানদের উপর হত্যাকান্ড, অমানবিক নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়। গত ২ তারিখে ঢাকার আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রুশের নেতৃত্বে বিশিষ্ট্য নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল ভারতীয় হাই কমিশনের মিনিস্টার শ্রী রাজেশ কুমার অগ্নিহোত্রী’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দলটি এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী প্রণয় কুমার ভার্মা বরাবরে বাংলাদেশের ক্যাথমিক চার্চ ও বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ২টি প্রতিবাদ লিপি হস্তান্তর করেন। প্রতি উত্তরে শ্রী রাজেশ কুমার অগ্নিহোত্রী, বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিতকরণ এবং সকল ধর্ম, বর্ণ এবং জাতিগোষ্ঠীর সহবস্থান ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের খ্রিস্টান সমাজ যে মণিপুর রাজ্যের খ্রিস্টানদের জন্য নিরাপত্তা ও সম্প্রীতির লক্ষ্যে প্রতিবাদ লিপি দিয়েছেন- তা সত্যিই প্রসংশার দাবিদার।
মানুষের মধ্যে স্বক্ষমতা বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, সচেতনতা বেড়েছে এবং বেড়েছে জাতীয়তাবাদ। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে গঠিত হচ্ছে জাতীয়বাদী সরকার। এশিয়াতে জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের মতো দেশ যেখানে বহু সম্প্রদায়ের বাস- সরকারকে অবশ্যই হিসাব কষে এগুতে হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীর সংগঠনের সংখ্যা কম নয়। এগুলো একসঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সরকারের জন্য ভিন্ন বার্তা বয়ে আনবে। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছ।