সিনোডাল মণ্ডলি: খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব-মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ” এ মূলসুরকে কেন্দ্র করে বিগত সেপ্টেম্বর ১১-১৩, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো পালকীয় কর্মশালা ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। উক্ত কর্মশালায় ফাদার, সিস্টার ও খ্রিস্টভক্তসহ ২৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন ধর্মপ্রদেশেদের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও, এসটিডি, ডিডি এবং সঞ্চালনা করেন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য-সদস্যাগণ।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় পরিষদের আহবায়ক ফাদার বাবলু সি. কোড়াইয়া উপস্থিত সকলকে তাঁর স্বাগত বক্তব্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আজ আমাদের ধর্মপ্রদেশের ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। তিনি “সিনোডাল মণ্ডলিঃ খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব-মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ” এ মূলসুর এবং ব্যানারে ব্যবহৃত বিভিন্ন লগো-এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আমরা এ কর্মশালায় এক সাথে বসেছি এবং একসাথে আলাপ আলোচনা করে আমাদের ধর্মপল্লীতে সিনোডাল মণ্ডলি হিসেবে একসাথে কাজ করব এবং একসাথে পথ চলব এ প্রত্যাশা করি।

বিশপ জের্ভাস রোজারিও তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন যেন আমরা সুখী হই ও আনন্দে থাকি। আর আমরা সত্যিকারভাবে সুখ ও আনন্দ পাই আমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের নিয়েই। আমরা যা করি একসাথে করতে হবে -বিশপ, ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার, কাটেখ্রিস্ট, খ্রিস্টভক্তগণ সকলে মিলেই তা করতে হবে।

পূর্বদেশের পন্ডিতগণ আকাশের একটি নতুন ‘তারা’ দেখে যেমন একসাথে যাত্রা করেছিলেন, আমরা সকলে যেন যিশুকে খুঁজে পেতে আজকের যুগচিহ্নের অনুসন্ধান করি। পোপ ফ্রান্সিসের শিক্ষানুসারে এখনও আমরা সকলে ভাই-বোন হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা একে অপরের ভাই-বোন হয়ে উঠার চর্চা করতে পারি।

আমাদের পরিবার যেন সত্যিকারের গৃহমণ্ডলি হয়ে ওঠে যেখানে থাকবে ঈশ্বর-বিশ্বাস, নিয়মিত গির্জা-প্রার্থনা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক, ভাবের আদান-প্রদান ও বিশ্বস্ততা, পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে মিলনের আনন্দ।

তিনি সকলকে আহ্বান  জানিয়ে বলেন, আমাদের প্রতিটি ধর্মপল্লীতে যেন প্যারিস কাউন্সিল গঠন করি এবং  ক্রেডিট ইউনিয়নগুলিকে স্বার্থকভাবে পরিচালনা করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করি।

সিনোডাল মণ্ডলি: খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব-মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ মণ্ডলিতে যাজক ও ব্রতধারী-ব্রতধারিণীদের ভূমিকা সম্পর্কে ফাদার প্রেমু রোজারিও তাঁর সহভাগিতায় বলেন, একজন যাজক হিসেবে যাজকের জীবনাহ্বান ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে যখন চিন্তা করি, তখনই মনে পড়ে পবিত্র শাস্ত্রের সেই বাণী “প্রতিটি মহাযাজক, মানুষের মধ্যে থেকেই মনোনীত হন এবং তিনি ঈশ্বরের সেবাকার্যে মানুষের প্রতিনিধি রূপেই নিযুক্ত হয়ে থাকেন- যাতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি অর্ঘ্য ও বলি নিবেদন করতে পারেন। যারা অজ্ঞ, যারা পথ ভ্রান্ত, তিনি স্বভাবতই তাদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার করতে পারেন, কারণ তিনি নিজেও যে নানা দূর্বলতায় আচ্ছন্ন, আর সেই দূর্বলতার জন্যই তাঁকে সকলের জন্য যেমন, নিজের জন্যও তেমনি পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলি উৎসর্গ করতে হয় (হিব্রু ৫:১৩)”। এ আলোকে যাজকীয় জীবনের কয়েকটি প্রধান মৌলিক বৈশিষ্ট বা কাজ হলো- ১। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন, তাঁর কাজে অংশগ্রহণ ও তাঁর কাজে প্রেরণ, ২। বিশপের সাথে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণকার্যে প্রেরণা লাভ, ৩। ভ্রাতৃ-পুরোহিত ও ব্রতধারী-ব্রতধারিণীদের সাথে মিলন, অংশগ্রহণ ও পালকীয় সেবা-দায়িত্ব এবং ৪। ঐশ জনগণের সাথে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণকর্ম

সিনোডাল মণ্ডলি: খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব-মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ- “আমার ধর্মপল্লীতে আমার দায়িত্ব ও ভূমিকা”- বিষয়ে মিসেস মনিকা ডিনা ক্রুশ তাঁর সহভাগিতায় বলেন, সিনোডাল মণ্ডলি আমাদের কাছে আহ্বান রাখছে ধর্মপলীর ব্রতধারীদের পাশাপাশি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে, অর্থ দিয়ে, উপাসনা কাজে অংশগ্রহণ করে, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে একাত্বতা প্রকাশ করা।

পরিবারে দাম্পত্য সম্পর্ক না থাকলে এবং পিতা-মাতার সাথে সন্তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সংলাপ না থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিবার ও সমাজের জন্য হয় হুমকী স্বরুপ। তাই একজন নারী পরিবার ও মণ্ডলির কাজে যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তা স্মরণ রাখা। 

তিনি আরো বলেন, সমাজে ‘মা মারীয়া সংঘ’ খ্রিস্টীয় সমাজ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশেষভাবে পাড়ায় পাড়ায় রোজারিমালা প্রার্থনায় উদ্বুদ্ধ করা।

সিনোডাল মণ্ডলি: খ্রিস্টবিশ্বাসের দায়িত্ব-মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ- রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টভক্তদের করণীয় সম্পর্কে মি. ডেভিড হেম্ব্রম, আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস রাজশাহী অঞ্চল তাঁর সহভাগিতায় বলেন, খ্রিস্টভক্তদের প্রধান করণীয় হচ্ছে ধর্মশিক্ষা দান ও তা নিয়মিতভাবে চর্চা করা, দয়া ও সেবার কাজ করে ধর্মপল্লীগুলোতে পালকীয় যত্ন নেয়া একইসাথে মণ্ডলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে (Self-Sustainability) প্রতিষ্ঠিত করা। খ্রিস্টভক্তগণ যদি ধর্মপল্লীর তথা মণ্ডলির বিভিন্ন সেবা কাজে অংশ নিয়ে, সন্তানদের ধর্ম শিক্ষা ও নৈতিক গঠন দিয়ে মানুষ করার কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে, দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি দয়ার কাজ করে, যাজকদের ভরণ-পোষণে দায়িত্ব গ্রহণ করে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষনাবেক্ষণে অবদান রাখার মত গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্বসমূহ (রাজকীয়, যাজকীয় ও প্রাবক্তিক) ভূমিকা নিষ্ঠার সহিত পালন করে।

ধর্মপ্রদেশের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কেক কর্তন করেন এ পর্বের বিশেষ অতিথি মি. দেবেন্দ্রনাথ উঁরাও এবং পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও ও অন্যান্য অতিথিবর্গ। এছাড়াও একই দিনে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয় ফাদার শ্যামল গমেজ এবং মুন্সিনিয়র মার্শেল তপ্নকে।

পালকীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী মিসেস নিশিতা রোজারিও বলেন, আমি প্রথমবারের মত যুব প্রতিনিধি হিসেবে পালকীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। এখানে এসে আমার জীবন গঠনের জন্য অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কর্মশালার নিয়ম-শৃঙ্খলা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি আমার খুব ভাল লেগেছে। থাকা-খাওয়া ভাল ছিল। আমি একজন বিশ্বাসী সেবক হিসেবে বাড়ি গিয়ে মণ্ডলিতে সেবা দিব।

পালকীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী মি. ফিলিপ হাঁসদা কলিমনগর ধর্মপল্লীর পক্ষে বলেন, বিশপ মহোদয়ের পালকীয় পত্র এবং উপস্থাপকগণের বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা খুব ভাল ছিল। আলোচনার পদ্ধতি আকর্ষণীয় ছিল এবং কমিটির কার্যক্রমও ভাল ছিল।

পরিশেষে ধর্মপল্লীভিত্তিক দলীয় আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রতিটি ধর্মপল্লী তাদের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি কার্যক্রম নির্ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। অতঃপর মুক্তালোচনা, মূল্যায়ন এবং প্রেরণ বিবৃতি চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে পালকীয় কর্মশালার সমাপ্ত হয়।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : অসীম ক্রুশ

Please follow and like us: