এশিয়ার জনগণ হিসেবে একসাথে যাত্রা করা

“… … … এবং তাঁরা ভিন্ন পথে চলে গেলেন।” (মথি ২: ১২)

ভূমিকা

মানব জাতির ও তাঁর সমস্ত সৃষ্টির কাছে ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করাই হলো যিশু খ্রিস্টের শিষ্যদের দায়িত্ব এবং এইজন্য এশীয় জনগণ হিসেবে সকলে এক সাথে যাত্রা করা। পূর্বদেশীয় পন্ডিতগণ যেমন ঈশ্বরের নতুন তারার নির্দেশনায় একসাথে পথ চলেছিলেন, তেমনিভাবে আজকের যুগচিহ্ন দেখে ও তার অর্থ নির্ণয় করে আমাদেরও একসাথে পথ চলা উচিত। এশিয়া হলো বৃহত্তম ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলির উৎসভূমি; এখানে বহু ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জনগণ আদিকাল থেকেই শান্তিতে সহাবস্থান ও বসবাস করে আসছে। তারা শুধু শান্তি, ন্যায্যতা ও সম্প্রীতি চায়। তাই তাদের প্রতিনিধি হয়ে, পূর্বদেশীয় পন্ডিতদের মত এশীয় বিশপগণ সমবেত হয়ে বর্তমান যুগের যুগলক্ষণ নির্ণয় করবে ও নতুন পথ আবিষ্কার করবে।

তারজন্য তাঁরা একসাথে যাত্রা করবে, আকাশে তাকাবে, অবধারণ করবে, তাদের উপহার প্রদান করবে ও নতুন পথ ধরে পথ চলবে।

১ম ভাগ : একসাথে যাত্রা করা – সিনোডাল পথে চলার আহ্বানে সাড়া দান

বাইবেলে বর্ণিত ইস্রায়েল জাতির নেতাদের মত ‘পূর্বদেশের পন্ডিতগণ তাদের চেনা পথ ছেড়ে তাঁরা ভিন্ন নতুন পথ ধরে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। তারা তাদের আরামের জীবন ছেড়ে কঠিন জীবন বেছে নিলেন যেন শিশু যিশু রক্ষা পায়। তেমনিভাবে এশিয়ার মণ্ডলিতে আমাদের বিশ্বাসের যাত্রাপথে আমাদের নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। কঠিন হলেও আমাদের সেই পথেই এগুতে হবে যেন আমরা খ্রিস্টের পক্ষে জোড়ালো সাক্ষ্য বহন করতে পারি। পন্ডিতগণ আকাশের তারা দেখে পথ চলেছেন, মানুষের সহায়তা তাঁরা নিয়েছেন। আর যারা খ্রিস্টবিশ্বাসী, আমাদের পথ হলো ক্রুশের পথ, যে পথে খ্রিস্ট চলেছেন ও যন্ত্রনাময় ক্রুশীয় মৃত্যু বরণ করেছেন। আমরা কিন্তু যন্ত্রণার পথ এড়িয়ে চলতেই ভালবাসি কারণ আমরা আসল লক্ষ্য ভুলে যাই। মণ্ডলির পথ কিন্তু কঠিন পথ, মণ্ডলির ইতিহাস তাই বলে। মণ্ডলির ইতিহাসের শুরুতে একত্রে যাত্রা শুরু হলেও, দিনে দিনে বিভিন্ন মতাদর্শ ও মতবাদের কারণে অনেকেই ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু যারা বিশ্বস্ত তারা সাধু পিতরের মত বলেছে, “আমরা কার কাছে যাব প্রভু, অনন্ত জীবনের বাণী সে-তো আপনার কাছেই আছে…” (যোহন ৬: ৬৭)। এশিয়ায় প্রথম বাণী প্রচারকদের মধ্যে মাত্তেয় রিচ্চি চীন দেশে ও দি নবিলি ভারতবর্ষে যেভাবে বাণী প্রচার করেছেন সেই নতুন পদ্ধতিই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সে পথ নিশ্চিতই আমাদের কাছে একটি কঠিন দাবী করে, আর সেটি হলো যে আমাদের আরাম আয়েসের পথ ছেড়ে, ত্যাগ-তিতীক্ষার চ্যালেঞ্জপূর্ণ পথ ধরতে হবে। আমরা কি তা করতে প্রস্তুত আছি? এফ.এ.বি.সি.-এর ৫০ বছর পূর্তির বা স্বর্ণ জুবিলীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে এশিয়ার মণ্ডলি হিসেবে বাংলাদেশের মণ্ডলিকেও এই প্রশ্ন করতে হবে। মণ্ডলির নতুন পথ হলো “সিনোডাল পথ”। এই পথের প্রতিপাদ্য হলো: মিলন, অংশ গ্রহন ও প্রেরণ কাজ।

মণ্ডলিতে আমরা সকলেই সমান, আমরা সকলের সঙ্গে মিলে মিশে থাকব এটাই স্বাভাবিক। সেই কারণে আমরা অর্থাৎ বিশ্বাসীরা সকলেই সকলের জীবনে ও কাজে অংশ গ্রহণ করব। আর আমাদের কথাবার্তা, আচার আচরণ ও ব্যবহারের দ্বারা মঙ্গল সমাচারের সাক্ষ্য বহন করব। আমাদের জীবন যাপন থেকেই অন্যরা বুঝবে যে খ্রিস্টই আমাদের প্রেরণ করছেন যেন আমরা তাঁর সুখবর সকলের কাছে প্রচার করতে পারি। এইজন্য অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে সংলাপ খুই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমানে আমাদের বুঝতে হবে যে শুধু একমুখী সংলাপ কার্যকরী হবে না; বরং আমাদের বহুমুখী সংলাপ করতে হবে। এটাও আমাদের জন্য একটি নতুন পথ।

২য় ভাগ: এশিয়ার বাস্তবতা –  এশীয় মণ্ডলির চ্যালেঞ্জসমূহ

রাজা হেরোদের আমলে, যুদেয়ার বেথলেহেম নগরে যিশুর জন্ম হয়। পরে কোন এক সময় প্রাচ্যদেশ থেকে কয়েকজন জ্যোতির্বিদ পন্ডিত জেরেুশালেমে এলেন। এসেই তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন : ইহুদীদের যে রাজা জন্মেছেন, তিনি কোথায়? কারণ আমরা তাঁরই তারাটি উদিত হতে দেখেছি এবং আমরা এসেছি তাঁর চরণে প্রণাম জানাতে” (মথি ২: ১-২)। সেই পন্ডিতদের মত এশিয়ার বিশপগণও এই যুগে যিশুর সন্ধান করে তাঁর পায়ে প্রণাম জানাতে সমবেত হয়েছেন ৫০ বছরের জুবিলীর সময়ে। এই সময় তাঁরা শুধু আকাশে নয়, বরং আশেপাশের বিভিন্ন এশীয় দেশে কিভাবে বাণী প্রচার হয়েছে, কিভাবে মণ্ডলি বেড়ে উঠেছে, এখন তারা কিভাবে পথ চলছে তা দেখেও শিক্ষা লাভ করতে এসেছে। এশীয় দেশগুলির বতমান বাস্তবতাগুলো হলো:

(ক) অভিবাসী, বস্তুচ্যুত আশ্রয়-প্রার্থী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা (খ) পরিবারগুলির বহুমুখী সমস্যা (গ) লিঙ্গ বৈষম্য ও ভেদাভেদ (ঘ) যুবক-যুবতীদের নৈতিক গঠনের সমস্যা (ঙ) ডিজিটাল প্রযুক্তি বা এই প্রযুক্তির অপব্যবহার (চ) গরীব ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য (ছ) আবহাওয়া মধ্যে বিরূপ পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের সকলের বসতবাটি এই পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ (জ) আন্তধর্মীয় সংলাপ – এর মাধ্যমে শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপন।

তৃতীয় ভাগ : অবধারণ –  পবিত্র আত্মা আমাদের কি বলেন?

মথি পূর্বদেশীয় জ্যোতির্বিদ পন্ডিতদের বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন যারা আকাশের তারা দেখেছেন ও সাবধানী হয়ে নীচের মানুষ ও অন্যান্য চিহ্নও দেখে যিশুর অনুসন্ধান করেছেন (মথি ২: ১)। ২য় ভাটিকান মহাসভাও নির্দেশ করেছে যে গোটা বিশ্বাসী সমাজ, যারা পবিত্র আত্মার দ্বারা অবগাহিত হয়েছে, তারা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ভুল করতে পারে না। সিনোড প্রস্তুতির জন্য পাঠানো  ভাদেমেকুম (Vademecum) দেখে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদেরও যুগলক্ষণ যেখতে হবে, মানুষের কথা শুনতে হবে এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠির বিশ্বাসের ঐতিহ্য থেকে শিখতে হবে যেন আমরা এর মধ্যে ঈশ্বরের কথা ও পরিকল্পনা বুঝতে পারি। “যার কান আছে সে শুনুক” (প্রকাশিত বাক্য ৩: ২২) পবিত্র আত্মা মণ্ডলিকে আজ কি বলেন!

(ক) যারা অভিবাসী, বাস্তুচ্যুত, আশ্রয়প্রার্থী, যারা অসহায় ও দরিদ্র আদিবাসী এবং যারা পড়ে আছে সমাজের প্রান্ত-সীমায়, তাদের সঙ্গে যাত্রা করা। তাদের সহায়তা করা মানে যিশুকেই সহায়তা করা। যিশুও মারীয়া ও যোসেফের কোলে চড়ে মিশর দেশে অভিবাসী হয়েছিলেন (মথি ২: ১৩-১৫)। আমাদের দেশ থেকে অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে বা উন্নত জীবন প্রত্যাশায় বিভিন্ন উন্নত দেশে অভিবাসী হয়। তারা সেখানে স্থানীয় মণ্ডলির অনেক সাহায্য সহযোগিতা পায়। কিন্তু আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ অভিবাসী বা গ্রাম থেকে শহরে আসা অভিবাসীদের জন্য আমরা কি করি? আমাদের মনে হয় অনেক কিছুই করার আছে।

(খ) আজকাল পরিবারগুলি বিশেষভাবে খ্রিস্টান পরিবারগুলির বহুমুখী সমস্যা আমাদের বিচলিত করে। নিজেদের বিশ্বাস অনুসারে তারা কি জীবন যাপন করে? তারা কি গীর্জা প্রার্থনায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে? তারা কি মণ্ডলিতে তাদের যে দায়িত্ব তা পালন করে? সন্তানদের বিশ্বাস ও নৈতিক গঠন দান করে নাকি করতে পারছে? এইসব নানা প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলন, সহভাগিতা ও সহমর্মিতা কম দেখা যায়। বাবা মায়ের মধ্যে ছেলে মেয়েরা আদর্শ খুজে পায় না। পরিবারে প্রবীনরা ও বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যত্ন পায় না

(গ) পরিবারে ও সমাজে নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও মূল্য দেওয়া হয় না; তাদের মতামতের উপর কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পরিবারে ও সমাজে তাদের ব্যাপক ভূমিকা থাকা সত্বেও তাদের কোন নেতৃত্বের আসন বা পদ দেওয়া হয় না। মণ্ডলিতেও এর কোন ব্যতিক্রম নয়, তারা ধর্মীয় উপাসনা ও সেবা কাজে বেশী উপস্থিত থাকলেও মণ্ডলি পরিচালনা কাঠামোতে বেশী গুরুত্ব পায় না। মণ্ডলির বিভিন্ন সংস্থায় একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়।  যুবক-যুবতীরা বর্তমানে খ্রিস্টবিশ্বাস ও নৈতিকতায় দুর্বল; তারা পরিবারে বা সমাজে আদর্শ খুঁজে পায় না, তাই তারা তাদের জীবনের জন্য এমন সব আদর্শ খুঁজে নেয় যা বা যাদের অনুসরণ করে তারা বিপথে ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যায়। পরিবার ও সমাজের কল্যাণের জন্য এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

(ঘ) মানুষের লিঙ্গ নিয়েও অনেক রকম মতবাদ বিস্তৃতি পাচ্ছে। আমরা জানি যে ঈশ্বর সকলকেই ভালবাসেন, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক বা অন্য কোন অরিয়েন্টেশনের মানুষ হোক। বর্তমানে বিশেষত: পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমকামিতার মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন এল.জি.বি.টি.কিউ.আই. প্লাস (LGBTQI+) আন্দোলন দেখা যাচ্ছে। এইটা যদি দেহ-মনস্তাত্বিক সমস্যা হয় তাহলে এই সমস্যার বিচার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মণ্ডলিতে আমরা পথ চলি মঙ্গল সমাচার, ঐতিহ্য ও মণ্ডলির শিক্ষামালা ও আইন দ্বারা, তাই এই আইনের বাইর আমরা কিছু করতে পারব না ঠিক; কিন্তু এই অরিয়েন্টেশনের মানুষকে আমরা গ্রহন করব না এমন নয়। মণ্ডলিতে আমরা তাদেরও সঙ্গে রাখতে পারি; তাদের কথাও শুনতে পারি। তবে যারা এই অরিয়েন্টেশনের মানুষ তারাও যেন আমাদের মণ্ডলির সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে আর যেন অযৌক্তিক দাবী উত্থাপন না করে।

(ঙ) যুবক-যুবতীদের বা তরুণদের গঠন দান ও সেবা মণ্ডলির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সমাজের যুবক-যুবতীরা যথেষ্ঠ শিক্ষা ও গঠন পাচ্ছে না। আমাদের স্থানীয় মণ্ডলির পক্ষ থেকে ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারগণ যুবক যুবতীদের গঠন দানের জন্য যথেষ্ঠ সময় দিলেও তা মনে হচ্ছে যথেষ্ঠ চৌকষ হচ্ছে না। আবার অনেক সমাজে ও ধর্মপল্লীতে সেই প্রচেষ্টা প্রায় নেই। এই কাজে জড়িত হতে হবে পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, সকলেরই। এই তরুণরাই আমাদের সমাজের নেতা-নেত্রী আর তাই তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা ভবিষ্যতে এই সমাজ ও মণ্ডলি ও সমাজকে যোগ্য পরিচালনা দিতে পারে। তাদের জীবন গড়া, লেখা-পড়া, ভবিষ্যতে যে কাজ করবে তার নির্দেশনা, ইত্যাদি বিষয় পরামর্শ দিতে হবে।

(চ) ডিজিটাল টেক্নোলজি মানুষের কল্যাণের জন্য বিজটঞানের একটি অভূতপূর্ব আশীর্বাদ। কিন্তু সেই ডিজিটাল টেক্নোলজি, গণমাধ্যম, আকাশ-সংস্কৃতি আমাদের সমাজ, পরিবার ও মণ্ডলির জন্য এক বিরাট হুমকী হয়ে আছে। কিভাবে আমরা এই ডিজিটাল টেক্নোলজি আমাদের দেশের, সমাজ ও মণ্ডলির উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে। এখন যে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে, সেই বিপ্লবে আমাদের যুবক-যুবতীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

(ছ) আমাদের এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির উপর স্থাপিত। এখন যদিও সর্বক্ষেত্রেই যন্ত্র-পাতি ও মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে, মনে রাখতে হবে যে যন্ত্র-পাতি নয় বরং মানুষই হচ্ছে কর্মের আসল মূল্য। প্রয়োজনে আমরা যন্ত্র-পাতি অবশ্যই ব্যবহার করব, কিন্তু মানুষকে যেন অবমূল্যায়ন করা না হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, শুধু কিছু মানুষের জন্য বা শুধু মালিক শ্রেণীর জন্য নয়, বরং তা হতে হবে গোটা সমাজের জন্য।

(জ) পৃথিবীটা হচ্ছে আমাদের সকল জীব-জন্তু, পৃথিবীর সকল প্রাণীর আবাস ভূমি বা বসবাটি।  এই পৃথিবীর ব্যবহারে যেন কোন মানুষই অপরিনামদর্শী না হয়। অপরিনামদর্শী ভোগবাদী আচরণের ফলে পৃথিবীর গাছ-পালা, বনবাদার ধ্বংস ও উজার হয়েছে, ভূগর্ভের সকল প্রকার খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে, ফসিল তেল বা পেট্রোল-ডিজেল পুড়িয়ে, কলকারখানার ধূয়া ও বর্জ্য দিয়ে, ইত্যাদি বহুবিধ প্রকারে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ‘ওজোন’ স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তার ফলে এখন পৃথিবীর বায়ু মন্ডল উত্তপ্ত হয়ে উত্তে মেরুতে অবস্থিত পাহাড়ের সকল বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জল বাড়িয়ে তুলছে। এর ফলে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ জলো নীচে তলিয়ে যেতে পারে। তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তাই আমাদের সকলকে এখনই দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের বেশী বেশী গাছ লাগাতে হবে; পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

(ঝ) সেতুবন্ধন রচনা করা ও সংলাপ গড়ে তোলার মধ্যেমে আমরা আমাদের এই পৃথিবীর ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে পারি। এখন দেকা যায় সামান্য কারণেই মানুষে মানুষে দ্বন্ধ দ্ব ও ঝগড়া-বিবাদ হয়; দেশে দেশে যুদ্ধ বাধে। সেই জন্য আমাদের পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস সর্বদাই শান্তি স্থাপনের কথা বলেন। আমাদের সমাজে ও পরিবারে যেমন তেমনি অন্য ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে মানুষে মানুষে বা জাতিতে জাতিকে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারি। আমরা যেন মানুষকে বিভক্ত করতে কাজ না করি বরং আমরা যেন মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মিলন স্থাপন করতে পারি সেই চেষ্টাই করা আবশ্যক।

৪র্থ ভাগ : আমাদের উপহার প্রদান –  এশীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতা

পূর্বদশেীয় পন্ডিতগণ যিশুকে বহু মূল্যবান উপহার দিয়েছেন; তারা দিয়েছেন স্বর্ণ, ধূপ ও গন্ধ নির্যাস (মথি ২; ১১)। আমরা যিশুকে কি দিতে পারি? তারা আনত হয়ে যিশুকে প্রণাম করেছেন। আমরাও গীর্জাঘরে বা অন্যত্র পায়ের জুতা খুলি, আনত হই ও ভক্তি নিয়ে প্রণাম করি। এশিয়া হলো বহু সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মহাদেশ। এখানে দেশে রয়েছে বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠি ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি। পৃথিবীর বড় বড় ধর্মগুলি সবই এশিয়া থেকে এসেছে। খ্রিসটধর্ম এশিয়ার ধর্ম হলেও, পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে ইউরোপে প্রতিষ্ঠা পায়। সেখান থেকে ইউরোপীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে মিশে মিশনারীদের মাধ্যমে আবার এশিয়ায় ফিরে আসে। আমরাও সেইভাবেই খ্রিস্টধর্ম লাভ করি। এখন আমরা খ্রিস্টধর্মকে এশীয়রূপ দিতে এক রকম গলদ-ঘর্মই হচ্ছি। স্থানীয়করণ ও সংস্কৃত্যায়নের মাধ্যমে আমাদের খ্রিস্টধর্মকে আমাদের দেশে ‘দেহধারণ’ করাতে হবে যেন আমাদের দেশের মানুষ খ্রিস্টানদের এ দেশীয় হিসাবে গ্রহণ করতে পারে।

ধ্যান ও মৌনতা এশিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য। দরিদ্রতার মধ্যেও মৌন থাকা ও মানিয়ে চলার চেষ্টা এশিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য। প্রবল প্রতিকুলতায়ও অটল থাকার ক্ষমতা আছে এশিয়ার মানুষের। সেইজন্য এশিয়ায় অনেক সন্ন্যাসী ও সাধুরা বিভিন্নভাবে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সাধনা করেছে, বিভিন্ন স্থানে আশ্রম ও মঠ গড়েছে। মানুষদের ধ্যান ধ্যান সাধনা করতে শিক্ষা দিয়েছে।

এশিয়ায় খ্রিস্টধর্মের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। মাত্র ফিলিপিন্স আর ইষ্ট তিমুর ছাড়া সব এশিয়ার সব দেশেই খ্রিস্টর্মের মানুষ নগণ্য। তা সত্ত্বেও বেশীর ভাগ এশীয় দেশেই মানুষ অন্য ধমের প্রতি সহনশীল। তারা বিভিন্ন ধর্মের হলেও পরস্পরের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর “ফ্রাতেল্লী তুত্তি” নামক পত্রে সকল মানুষকে পরস্পরের ভাইবোন হিসেবে জীবন যাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন। বংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশেই এটি একটি সাধারণ বিষয়। এশিয়ায় আর বিশেষ করে বাংলাদেশে সহাবস্থানের এই বৈশিষ্ট্যটি আরও টেকসই ও স্থায়ী করার প্রচেষ্টা নিতে পারি।

‘খ্রিস্ট ধর্মের বাইরে কোন পরিত্রাণ নেই’ এমন ঐশতত্ব আমরা আর মানি না। বরং আমরা স্বীকার করি যে অন্যান্য ধর্মের মধ্যেও পরিত্রাণের উপায় রয়েছে। তবে খ্রিস্টধর্মের মধ্যে যিশু খ্রিস্ট, যিনি ঈশ্বর পুত্র, তিনি মানুষ হয়েছেন যেন আমরা তাঁর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর সন্তান হতে পারি। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও পরম দয়ালু; তাই অন্যান্য ধর্মেও যদি ধার্মিক মানুষ থাকে, তারা যদি ঈশ্বরকে হৃদয় দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করে ও মানুষকে নিজের মত ভালবাসে তাহলে ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাদের পরিত্রাণ দিবেন (প্রভু যিশু)।

মিশনারীদের দ্বারা প্রচারিত খ্রিস্টধর্ম ইউরোপীয় পোশাকে আমাদের কাছে আনা হয়েছে। এখন কিন্তু সময় এসেছে যেন আমরা আমাদের খ্রিস্টধর্মকে এশীয়, বিশেষভাবে বাংলাদেশে, আমাদের নিজস্ব পোশাক পড়াতে পারি। দেশীয়করণ বা সংস্কৃত্যায়নের মাধ্যমে আমরা আমাদের উপাসনা ও আমাদের আচার আচরণ এদেশীয় রূপ দিতে পারি। তবে কাথলিক মণ্ডলির শুদ্ধতা, একতা ও শৃঙ্খলা যেন অটুট থাকে তার চেষ্টাও আমাদের করতে হবে।

৫ম ভাগ : নতুন পথের আরম্ভ – অন্য পথে ফিরে যাওয়া

“পরে তারা স্বপ্নে আদেশ পেলেন, হেরোদের কাছে যেন তাঁরা আর ফিরে না যান। তাই তাঁরা অন্য পথ ধরেই নিজেদের দেশে ফিরে গেলেন” (মথি ২: ১২)। প্রাচ্যদেশের পন্ডিতগণ যখন প্রথম জেরুশালেমে এসেছিলেন, তাঁরা নবজাত রাজা অর্থাৎ যিশুর খবর নিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ইহুদীদের নবজাত রাজা কোথায় জন্মেছেন? আমরা তাঁর তারাটি উদিত হতে দেখেছএবং তাঁকে প্রণাম করতে এসেছি” (মথি ২: ২)। এশিয়ার বিশপগণ এফ.এ.বি.সি.-এর ৫০ বছরের জুবিলীতে এসে একইভাবে অনুসন্ধান করছেন, “যিশু কোথায় জন্ম নিয়েছেন? আমরা তাঁকে প্রণাম জানাতে এসেছি!

(ক) আর বিদেশী ভাষায় ও অভিব্যক্তিতে নয়, বরং দেশীয় সংস্কৃতিতে মঙ্গল সমাচার ঘোষণা করা হবে আমাদের নতুন পথ।

(খ) ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় মণ্ডলি থেকে মৌলিক মানব সমাজ –  সকলের অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত থাকে।

(গ) শুধু সংলাপ নয়, বরং সিনোডাল পদ্ধতি –  মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ ।

(ঘ) ঘোষণা দিয়ে নয়, গল্প বলার ধরণে –  যিশুর কথা প্রচার করা।

(ঙ) গতানুগতিক পালকীয় কাজ নয় বরং নতুন পালকীয় অগ্রাধিকার নির্ণয় করা ও কাজ করা।

উপসংহার:

এশীয়দের কাছে সব কিছু হওয়ার জন্য আত্মনিয়োগ ও ত্যাগ স্বীকারের পথ ধরতে হবে। যিশুর শিষ্য হওয়ার বিষয় সাধু পল যেমন করিন্থীয়দের বলেছেন, “দুর্বলদের কাছে আমি তো দুর্বলই হয়েছি, যেন দুর্বলদের আমি জিতে নিতে পারি” (করি ৯: ২২)। এই কথা আমাদের জন্য প্রণিধানযোগ্য। এশীয় মণ্ডলি খ্রিস্টের মুক্তিদায়ী, ক্ষমতাদায়ী ও জীবনদানকারী মঙ্গল সমাচার এখানকার মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারবে শুধু যদি প্রাচ্যদেশীয় পন্ডিতদের মত সে তার উপহার দান ঈশ্বরের কাছে তুলে ধরতে পারে। ধন্যা মা মারীয়ার কাছে আমাদের এশীয় মণ্ডলির জন্য প্রার্থনা করি যেন তিনি এই মণ্ডলিকে রক্ষা করেন।

বিশপ জের্ভাস রোজারিও

রাজশাহী

Please follow and like us: