ফাদার সাগর কোড়াইয়া

ফাদার হারুন হেম্ব্রম সব সময়ই আমাকে ‘বাবু’ বলে সন্মোধন করতেন। ফাদারের সে ডাকটা এখনো চিন্তায় শুনতে পাই। অনেক সময় ফাদারের ডাকটা উঁনার শারীরিক দূর্বলতাবশত শুনতেন পেতাম না। তবে তিনি ছেড়ে দেবার পাত্র ছিলেন না। অনবরত বাবু…বাবু বলে ডাকতেই থাকতেন। সম্বিত ফিরে পেয়ে দাঁড়ালে এগিয়ে এসে বলতেন শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না তো তাই কণ্ঠও ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি অপারেশন হওয়ার পর ফাদার হারুন বলতেন, ‘এখন শরীরটা বেশ ভালো লাগে’। তবে নিয়তির অমোঘ শক্তিকে কেউ পরিত্যাগ করতে পারে না। ফাদার হারুনও এর বাইরে নন। জীবনের সব লেনাদেনা চুকিয়ে ১৮ অক্টোবর বেলা পাঁচটা পয়ত্রিশ মিনিটে অনন্তকালের যাত্রী হয়েছেন। ফাদারের মৃত্যুটা বেশ করুণ; তবে প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করার উপায়ও নেই। আমি চিন্তায় ভাবি, যখন তিনি মেডিকেলের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন কত না কষ্ট পেয়েছেন। নিশ্চয় যাজকীয় জীবনের সব স্মৃতিগুলোও কল্পনায় আনছিলেন সে সময়।

ফাদার হারুনকে আশাবাদী মানুষ হিসেবেই আমি দেখেছি। প্রেসবিটেরিউম বা অন্যান্য সভায় ফাদার হারুন অকপটভাবে নিজের চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করতেন। প্রতিটি কথার মধ্যে আশাবাদী হওয়ার প্রচ্ছন্ন একটি রূপ প্রকাশ পেতো। তিনি জানতেন না যে এর ফলাফল কি হবে; তবে আশাবাদী হয়ে আশার বসতি গড়তে জানতেন। আশাবাদী মানুষই স্বপ্ন দেখতে পারে। ফাদার হারুনও এর বাইরে নন। আশাবাদী মানুষই অন্যকে উৎসাহিত করার ক্ষমতা রাখে। ফাদার হারুন অন্যকে উৎসাহিত করতে পারতেন খুব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স সম্পন্ন হওয়ার খবর শুনে তিনি বেশ আশাজাগানিয়া কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের ফাদারদের এখন অন্যান্য বিষয়ের ওপরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অন্যথায় বাহিরের সাথে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবো না।

ফাদার হারুন হেম্ব্রম রহনপুর ধর্মপল্লীতে পাল-পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার যাজকীয় অভিষেকের আগে ও পরে আমিও রহনপুরে ছিলাম। ফাদার হারুন দেখা হলেই রহনপুরের স্মৃতি রোমন্থন করতেন। প্রায়ই বলতেন, দিঘীর পাড়ে যে আমগাছগুলো আছে না সেগুলো আমি থাকাকালীন রোপণ করেছি। আমার চিন্তা ছিলো যেন পরবর্তী ফাদারগণ এর সুফল ভোগ করেন। যখন ফাদার হারুন কথাগুলো বলতেন তাঁর চোখযুগল এক অন্যরকম তৃপ্তিতে ভরে যেতো। তিনি বলতেন, বাবু রহনপুরে বেড়াতে যাবো। তবে সময় করে উঠতে পারেননি। অল্প সময়ের জন্য মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে ফাদার হারুন কাজ করেছেন। আমি যখন মথুরাপুরে বদলী হলাম তিনি একদিন আনন্দের সাথে বলছিলেন, ‘আমার একটি প্রিয় জায়গায় গিয়েছ; মথুরাপুরে জনগণের সাথে মিশতে আমার বেশ ভালো লাগতো’।

ফাদার হারুন তখন বনপাড়া সেমিনারীতে আধ্যাত্মিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আমি ফৈলজানাতে রিজেন্সী করি। একবার বড়দিনে সাহায্য করার জন্য ফৈলজানাতে আসেন। তখন তিনি মোটরসাইকেল চালাতেন। বিকালে বাজারে যাবো। তাই মোটরসাইকেলটা চাইলাম। অবাক করে দিয়ে ফাদার মোটরসাইকেল দিলেন আমাকে। বাজার থেকে ফিরে আসার সময় মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় ভূপাতিত হই। কিন্তু মোটরসাইকেলের পাদানি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ বাঁকা হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারিনি। পরদিন ফাদার বনপাড়াতে ফিরে যাবেন। মোটরসাইকেল নিয়ে বেশ ক্ষাণিকটা দূর চলেও গিয়েছেন। হঠাৎ দেখি তিনি আবার ফিরে আসছেন। এসেই প্রথম কথা- তুমি মোটরসাইকেল ফেলে দিয়েছিলে। আমি যতই বলি ‘না ফাদার ফেলিনি’ ততই তিনি বলেন ‘তাহলে আমার মোটরসাইকেল শুধু একদিকেই চলে যায় কেন’? অগ্যতা কি করা নীরব থাকাটাকেই সন্মতির লক্ষণ বলে চালিয়ে দিলাম।

আশাবাদী মানুষ স্পষ্টকথা স্পষ্টভাবে বলতেই পছন্দ করেন। ফাদার হারুন মাঝে মাঝে নির্মম স্পষ্টকথা বলতে দ্বিধা করতেন না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, আদিবাসীরা একদিন সচেতন হবে। নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে লালন করবে। তিনি এটাও বলতেন, অসচেতনতা আমাদের আদিবাসীদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে না পারলে সন্মুখে সমূহ বিপদ। নিজে একজন সাঁন্তাল আদিবাসী হয়ে আদিবাসীদের নিয়ে প্রচন্ড ভাবনা তাঁর মধ্যে কাজ করতো। আর সেই জন্য অনেকবার লেখনীর আশ্রয় নিয়েছেন। সম্প্রতি জুন মাসে ফাদার হারুনের ‘সান্তাল সম্প্রদায়ের বিবাহ ও নিষিদ্ধ বিবাহ’ নামক একটি ছোট্র পুস্তিকা প্রকাশ সেটারই বহিঃপ্রকাশ। পুস্তিকাটি আমি এক বসাতেই পড়ে নিয়েছি। আমি মনে করি ‘এট অ্যা গ্লেন্স’ সাঁন্তাল বিবাহ বিষয়ক এমন তথ্য অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। পুস্তিকার ‘লেখকের কথা’ অংশের একটি জায়গায় তিনি নিরাশার মধ্যে আশার আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সান্তালরা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি ভুলে যাচ্ছে’। এই বাক্যে সমস্যা নিরূপণের মধ্য দিয়ে ফাদার হারুণের আশাবাদী একটি মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে।

ফাদার হারুন একদিন আন্ধারকোঠাতে আসেন। উদ্দেশ্য তাঁর পুরনো বইপত্র নিয়ে যাবেন। যেহেতু তিনি আন্ধারকোঠাতে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে কাজ করেছেন তাই তাঁর বইপত্র এখনো আন্ধারকোঠায় রয়ে গিয়েছে। পরদিন আন্ধারকোঠায় হস্তার্পণ সংস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। প্রার্থীরা ইতিমধ্যে পাপস্বীকার সংস্কারের জন্য চলে এসেছে। আমি একা থাকায় বড় সংখ্যক প্রার্থীর পাপস্বীকার শুনতে কষ্ট হবে। ফাদার হারুনও বিশপ হাউজে চলে যাচ্ছেন। কি করে বলি পাপস্বীকার শুনতে সহায়তা করতে! অগ্যতা ফাদারকে অনুরোধ করলাম। ফাদার হারুন অবাক করে দিয়ে বললেন, আমাদের কাজইতো বাবু সংস্কার প্রদান। চলো…বলে তিনি গির্জায় প্রবেশ করলেন। শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও একঘন্টা পাপস্বীকার শুনলেন।

ধর্মপ্রদেশীয় যাজক হিসেবে ফাদার হারুন হেম্ব্রম ছিলেন বিশ্বস্ত সেবক। সম্প্রতি শেষ হওয়া ধর্মপ্রদেশীয় যাজকদের বাৎসরিক নির্জন ধ্যানে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ্য থাকার পরও তিনি কোন বাঁধা মানেননি। প্রথমদিকে হয়তোবা না যাবারই মনোস্থির করেছিলেন তিনি। সেই জন্য বাস বা ট্রেনের টিকিট কাঁটেননি। একদিন সকালে আমাকে মোবাইলে বললেন ট্রেনের টিকেট কেঁটে দিতে। অতঃপর ট্রেনের টিকেট কেঁটে দিয়ে বললাম, আপনার না গেলে হয় না? তিনি আশাবাদীর মতো বললেন, ‘সুস্থ্য হয়ে গিয়েছি। ঔষধ খাচ্ছি। নির্জনধ্যানে না গেলে ভালো লাগবে না। যাই ঘুরে আসি’।

ফাদার হারুন হেম্ব্রম আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তবে তাঁর স্মৃতিগুলো আছে। স্মৃতিগুলোর মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। আমার জানা মতে ফাদারের বাবা দীর্ঘ সময় জীবিত ছিলেন। ফাদারদের গ্রামের বাড়ি চন্দনকোঠায় ফাদারদের পরিবার থেকে প্রদত্ত জমিতেই গির্জাঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গির্জা প্রাঙ্গণের পাশেই ফাদার হারুন ঘুমিয়ে আছেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন কোন একদিন হয়তো এই চন্দনকোঠায় মিশনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। পরিবারের একমাত্র ছেলে হবার পরও তিনি যাজকীয় জীবনে প্রবেশ করেছেন। পিতামাতাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বরকে দিতে চাইলে শ্রেষ্ঠটাই দিতে হয়। আশা আমাদের বাঁচিয়ে রেখে সামনে যেতে তাড়িত করে। ফাদার হারুনের আশাবাদী মুখোয়ব আমাদের আশায় বাঁচিয়ে রাখুক।

Please follow and like us: